ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

আকবর হোসেনের উপন্যাসে কালচেতনা ও সমাজভাবনা ওয়েবিনার 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:১০, ১০ অক্টোবর ২০২০

নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের উপন্যাসে কালচেতনা ও সমাজভাবনা বিষয়ক ওয়েবিনার। সভাপতিত্ব করেন বাংলা বিভাগের প্রধান বহুমাত্রিক লেখক ড. রকিবুল হাসান। প্রধান অতিথি ছিলেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, সম্মানিত অতিথি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্য ও ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর প্রথিতযশা কলামিস্ট-প্রাবন্ধিক ড. রাশিদ আসকারী, বিশেষ অতিথি নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির পাবলিক হেলথ বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি এম এ ওয়াদুদ সরকার। 

আলোচনা করেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি কবি ইসরাফিল হোসেন, প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক শাফিক আফতাব। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি শারমিন জামান। অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের সন্তান বাংলাদেশ বিমানের সাবেক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক আলমগীর খসরু, চিত্রশিল্পী নাসির হাসান ও ওয়াজির হাসান, শিশুসাহিত্যিক-সাংবাদিক ড. জ্যোৎস্নালিপি, প্রাবন্ধিক ইসরাফিল হোসেন। এছাড়া দেশ-বিদেশের অনেক অতিথি ও বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেন।

আলোচকরা বলেন, আকবর হোসেন বাংলা কথাসাহিত্যে নিভৃতচারি অথচ শক্তিমান এক কথাসাহিত্যিক। ঊনিশ ও বিশশতক সময়কালে বাংলা সাহিত্যে অল্প কয়েকজন মুসলমান লেখকের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানের সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর।  সময় ও সমাজভাবনার নিরিখে স্বতন্ত্র শিল্পমেধায় তিনি যে সাহিত্য নির্মাণ করেছেন তা বহুল পঠিত শুধু নয়, মীর মশরারফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু ও নজিবর রহমানের আনোয়ারা উপন্যাসের পর অবাঞ্ছিত উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিলেন। আকবর হোসেন ১ অক্টোবর ১৯১৭ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।  গ্রামের স্কুলেই তাঁর পড়ালেখা শুরু হয়। পরবর্তীতে কুষ্টিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ আইএ এবং কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি চাকুরী জীবনের সূচনা করেন। দীর্ঘকাল সরকারি চাকুরিতে কর্মরত ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। আকবর হোসেন ছাত্র জীবন থেকে সন্ধানী, শিখা, দৈনিক আজাদ, নবযুগ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। 

এই উপন্যাসটি এক সময়ে প্রায় ঘরে ঘরে পঠিত হতো। ১৯৬৯ সালে জুপিটার ফিল্মস্ কামাল আহমেদের পরিচালনায় এটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়। ছবিটির শিল্পসফলতায় সারাদেশে ব্যাপক যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করে তেমনি আকবর হোসেনও আরও জনিপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেন। তাঁর মেঘ বিজলী বাদল  উপন্যাস নিয়েও ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এপার ওপার বাংলা মিলেই ছিলো তাঁর উপন্যাসের পাঠক। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যখন ভারতীয় লেখক ছাড়া পূর্ব বাংলায় আর কারো বই বাজারে বিক্রি হত না, সে সময় আকবর হোসেনই একমাত্র লেখক যাঁর বই ওপার বাংলার বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজার দখল করেছিলো। 

দীর্ঘদিন তিনি সরকারি চাকুরিতে কর্মরত ছিলেন আকবর হোসেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনাকালীন সময় থেকেই সাহিত্য চর্চা করতেন আকবর হোসেন। শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটিয়ে পুরোদমে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন তিনি। "সন্ধানী" "শিক্ষা" "দৈনিক আজাদ" ও "নবযুগ" ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ভেতর দিয়ে তাঁর সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে।তার সাত্যিজীবন মূলত ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। তিনি এই তিন দশক জনপ্রিয়তায় একাই রাজত্ব করেছেন। তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন প্রকৃতি ও অন্তরের টানে ; সেখানে অনিবার্যভাবে প্রোথিত হয়েছে সমাজভাবনা ও কালচেতনা। সময় ও সমাজবাস্তবতার নিরিখে তিনি ব্যক্তি ও ব্যক্তিমননের যে রূপান্তর, রক্তক্ষরণ ও টানাপড়েন তাই চিত্রিত হয়েছে তাঁর কথাসাহিত্যে। তাঁর উপন্যাসে জমিদারী আমল তাদের অত্যাচার-শোষ নিপীড়ন নির্যাতন, স্বদেশি আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গ, ব্যক্তিস্বার্থ লোভ-লালসাকেন্দ্রিক অসুস্থ রাজনীতি, শ্রেণি বৈষম্য, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ Ñযে দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ লোক মৃতুবরণ করেছিল, অভাব-অনটন-ক্ষুধা দারিদ্রে বহু নারী সম্ভ্রম বিকিয়েছিল, ভাত-কাপড়ের মহাসঙ্কট তৈরি হয়েছিল, ১৯৪৭ এর দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬০ এর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ছয়দফার আন্দোলন-বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ কর্মীদেও গ্রেফতার, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদেও হাতে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি বুয়েট ছাত্র নিহত, মুক্তিযুদ্ধ, দেশের স্বাধীনতা অর্জন,  বিপদগামী কতিপয় সেনাদেও হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়া-এসব বিষয় আকবর হোসেনের উপন্যাসে গুরুত্বেও সঙ্গে স্থান পেয়েছে। সমাজ-সমকাল সম্পর্কে সচেতন একজন লেখকের পক্ষেই সম্ভব এভাবে মুন্সিয়ানা দেখানো।  গ্রামীণ সমাজ সংস্কার, সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খা, নাগরিক জীবনের দুঃখ-বেদনা, সমসাময়িক জীবনচিত্র, সমকালীন চিন্তা-চেতনা, চারপাশের চেনাজগত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভৃতিও স্বতন্ত্রশিল্পস্বরে উপস্থাপিত হয়েছে আকবর হোসেনের উপন্যাসে।  তাঁর বহুল বহুল পঠিত ও  জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে অবাঞ্ছিত (১৯৫০), কী পাইনি (১৯৫২, মোহমুক্তি (১৯৫৩), ঢেউ জাগে (১৯৬১), আলোছায়া (১৯৬৪), দু’দিনের খেলাঘরে (১৯৬৫), মেঘ বিজলী বাদল (১৯৬৮), নতুন পৃথিবী (১৯৭৪) অন্যতম। 

আকবর হোসেনের উপন্যাসের ঘটনা বর্ণনা, ভাষার কাব্যময়তা, গতিশীল ভঙ্গি এবং শৈল্পিক সন্নিবেশ উপন্যাসগুলোকে জনপ্রিয় করেছে। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে যে দুটি বিষয় সর্বাগ্রে আছে তা হলো মানুষের মন কিংবা সমাজজীবনকে স্পর্শ করা। সেই সমাজকে কলচেতনার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে ব্যক্তিমননের রূপান্তরটি বিশ্লেষণ করা। এই শিল্পনিরীক্ষাটি তিনি করেছেন বলে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র উত্তরপর্বে তিনি জনপ্রিয়তার গৌররবে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। শব্দ ব্যবহার, কাহিনি বিন্যাস, চরিত্র চিত্রণ, শিল্প-সুষমা প্রকাশে তাঁর অপার দক্ষতা তাঁকে কালজয়ী ঔপন্যাসিকের আসনে বসিয়েছে। সময়কে সংরক্ষণ করার শৈল্পিক প্রয়াসে তিনি সফল, শিল্পী হিসেবে নিজ কর্তব্য পালনে তিনি একনিষ্ঠ। 

সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়া জেলার মাটি ও মানুষ শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সব সময় গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। কুমারখালীর শিলাইদহে এসে সাহিত্য চর্চা করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়া বাউল সম্রাট লালন ফকির, বিষাদসিন্ধু রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, কাঙ্গাল হরিণাথ মজুমদার, কবি ডক্টর হরগোপাল বিশ্বাস, বাউল সাধক গগন হরকরা, কবি আজিজুর রহমান, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, শিশু সাহিত্যিক জোবেদা খানম, কবি জলধর সেন, বিপ্লবী নেতা কাজী মিয়াজান, বিপ্লবী বাঘা যতীন, কলকাতার বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কবি-গীতিকার আবু জাফর, ছড়াকার নাসের মাহমুদ, কবি-গবেষক বিলু কবীর এবং কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক ড. রকিবুল হাসান কুষ্টিয়ার অহংকার। 

এদের মধ্যে বিপ্লবী বাঘা যতীন ও রকিবুল হাসানের জন্ম কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে। এই গ্রামেরই সন্তান ঔপন্যঅসিক আকবর হোসেন। তাঁর লেখা সমাজ ও কালচেতনায় অনন্য। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই লেখককে আমাদের অজ্ঞানতা ও পাঠহীনতায় আমরা ভুলতে বসেছি। কিন্তু তাঁর সাহিত্য-শিল্প নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। 

আরকে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি