ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

মেলায় নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ`র `নিসর্গের বাঁশি বাজে বিপ্লবীর বুকে`

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৬, ২৪ মার্চ ২০২১

তিনি দিগন্তে মুখ তুলে ডাকতেন
অমনি এসে যেত বঙ্গোপসাগর থেকে
জেলভাঙা কয়েদীর মত বাতাসেরা
আমরা প্রাণ ভরে শ্বাস নিতাম।

তিনি কথা বলতেন তরঙ্গের ভাষায়
আমাদের ভেতর মুহূর্তে বয়ে যেত    
                    অমন তরঙ্গভরা নদী ।

সমুদ্রের ডাক প্রত্যেক নদীর
পরম কাক্সিক্ষত; তিনি আমাদের
ভেতরের নদীগুলোকে সমুদ্রের ডাক
দিয়েছিলেন। তার ডাকে বন্দুকের ছায়ায়
কাঁপতে থাকা আমরা সংহত হলাম
ঝড়ের মুখে বেতসের মত।
ধনুকভাঙা পণে নিজেদের সজ্জিত করলাম
               বারুদের বিপরীতে গোলাপে
               হিংসার বিপরীতে সঙ্গীতে
অর্ধনমিত পতাকার বিপরীতে
ঘুড়ির রঙিন উৎসবে।

এক সময় আমাদের তরুপল্লব
নত হতে যাচ্ছিল ফুলের ভারে
আকাশ ভিজে উঠছিল জোছনার জলরঙে।

তারপর আমরা 
তার নাম মুছে দিতে চাইলাম।
                    (সমুদ্রের ডাক)


রূপক ও চিত্রকল্প ব্যঞ্জনায় শেখ মুজিবকে নিয়ে এমন অসাধারণ কবিতা রয়েছে গ্রন্থটিতে। কবিতার কোথাও শেখ মুজিবের উল্লেখ নেই। কিন্তু কবিতাটির পঙক্তির ভাঁজে ভাঁজে উঁকি দেয় তাঁর দ্যুতি। কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, বেলাল মোহাম্মদ, ময়ুখ চৌধুরী, ত্রিদিব দস্তিদারকে নিবেদিত কবিতা রয়েছে। কে না জানে বাঙলা কবিতা থেকে ছন্দ ক্রমশ নির্বাসিত হতে চলেছে। কবিতায় ছন্দ নিয়ে দক্ষতা ও সূক্ষ্মতার কাজ বিরল হয়ে উঠছে। ছন্দ নিয়ে কথা বলবার লোকও দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। সেখানে নব্বই দশকের কবি নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ ব্যতিক্রম। প্রথম কাব্যগ্রন্থ আটটি পাতার তলে ফাল্গুনীর চোখ(২০০৮) এর পর নিসর্গের বাঁশি বাজে বিপ্লবীর বুকে কাব্যগ্রন্থটি  ছন্দের কারুকাজে ভরিয়ে তুলেছেন। গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই ছন্দে রচিত।‘তিল ও তিলোত্তমা’ কবিতাটি বিরল ছন্দ সাতমাত্রার স্বরবৃত্তে রচিত। ‘ছা-পোষা কেরাণীর কাব্য’ বিরল দশমাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা। বিষয়বৈচিত্র্য, অন্ত্যমিল, শব্দের চৌকস ব্যবহার গ্রন্থটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। 
প্রাণের প্রবাহ নেই আছে শুধু বিষাক্ত নিঃশ্বাস
বর্জ্যরে ভাগাড় তুমি পণ্যক্লেদ বুকে অনিঃশেষ;
তোমাকে ঘিরেছে দেখি সর্বনাশা অই অক্টোপাস
নদীর কঙ্কাল বুকে কেঁদে ওঠে আমার স্বদেশ।
মাছের ফসিল দেখে কেউ খোঁজে নদীর সুঘ্রাণ
এখানে সে-নদী ছিল পূর্ণ প্রাণ জীবনের ধারা
সেসব স্মৃতির লাভা বুকের অতলে বহমান
রক্তের ভেতরে শুনি ডাক,‘কুশিয়ারা’,‘কুশিয়ারা’।
    
তোমাকে বলিনি আমি পাথরের ঘুম ভেঙে কবে
এনেছে নদীরা জেনো পৃথিবীর প্রথম সকাল
শস্যের সম্ভার আর সৃজনের তুমুল উৎসবে
নদীরা দিয়েছে মুছে জনপদে নিরন্নের কাল।
মাছের কল্লোল আর শ্যাওলার হরিৎ কারুকাজে
ধ্বনির মূর্ছনা তুমি বাকরুদ্ধ জীবনের ভাঁজে।
                            (নদীর লিরিক ০২)

বাঙলার মানচিত্র থেকে,প্রাত্যহিক জনজীবন থেকে নদী ক্রমশ অপসৃত হতে চলেছে। তার চিত্ররূপময় আখ্যান গ্রন্থটির পাতায় পাতায়। নদীমাতৃক জীবনের প্রতি নদীমুগ্ধ ভালোবাসার উচ্চারণে মুগ্ধ হতে হয়। কাব্যগ্রন্থের এ সনেট যুক্তরাষ্ট্র হতে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক কবিতাপত্রিকা শব্দগুচ্ছ-এর দ্বাবিংশবর্ষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। নদী বিষয়ক দশটি সনেটের চমৎকার সিকোয়েন্স ‘নদীর লিরিক’। পাঠকমনকে আর্দ্র করে তুলবে নিঃসন্দেহে। সনেট সিকোয়েন্স গ্রন্থের উজ্জ্বল দিক নিঃসন্দেহে। মাছের চোখের মত মুছাপুর গ্রাম অনন্য কবিতা। প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রান্তিক মানুষের উত্থানই কবিতাটির মূল সুর। বাংলাদেশের আদিবাসী জনপদের সৌন্দর্য ও সংগ্রামশীলতার চেতনায় ভাস্বর এবং কল্পনা চাকমা কবিতাটি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মধ্যযুগীয় জলদস্যুতা, গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, রানা প্লাজার দুর্ঘটনা, আদিবাসী, মৎস্যজীবির প্রসঙ্গসহ প্রান্তিক মানুষের ওপর ক্রমাগত শোষণ ও তাদের প্রতিরোধের নান্দনিক উপস্থাপনই কাব্যগ্রন্থের মূল সুর। নরনারীর শাশ্বত প্রণয় তো অবশ্যই রয়েছে। কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই জাতীয়/আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের ওপর ক্রমাগত শোষণ ও তাদের প্রতিরোধের নান্দনিক উপস্থাপনই কাব্যগ্রন্থের মূলসুর। প্রকট ধনবৈষম্য, ক্রমাগত শোষণ, জনজীবনে হতাশার বিপরীতে পাঠককে উজ্জীবিত করতে নির্মাণ করেছেন এমন আশাব্যঞ্জক পঙ্ক্তিমঞ্চ

০৬.
স্বপ্ন ভাঙার শব্দে কেঁপে কেঁপে
উঠলেও পৃথিবী, স্বপ্ন কখনো ভাঙে না
নিসর্গের বাঁশি বাজে বিপ্লবীর বুকে।
০৭.
ধূসর পৃথিবী থেকে 
যারা জেগে উঠছে, যারা জেগে উঠবে
প্রিয় মনুষ্যচেতনা
প্রিয় অরণ্যচারী প্রতিনিধিবর্গ,
বিষণ্ণতার মত অপচয় নেই
অপেক্ষায় নত হওয়াটাই ভুল
শত্রুর নিঃশ্বাস যখন ঘাড়ে পড়ছে
সময় নষ্ট করাটাই তখন অপরাধ।
(নিসর্গের বাঁশি বাজে বিপ্লবীর বুকে)
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ উপলক্ষে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনী। কখনো বাউল, কখনো বিপ্লবী এমন নান্দনিক ভাষ্যে গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবি শামীম রেজাকে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আল নোমান। চারফর্মার গ্রন্থটির মূল্য ২০০/-টাকা।

কেআই//


 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি