ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

অশ্রুর সাগরে বিদায় নিলেন সাংবাদিক মামুন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ২৩:০৫, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 

খবর সংগ্রহ করা ছিল যার কাজ, অাজ তিনি নিজেই খবরের বিষয়। যে সহকর্মীদের সঙ্গে এতোদিন তিনি অফিস করেছেন, অাড্ডা দিয়েছেন, এ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছেন, জরুরি সময়ে রাত জেগে কাজ করেছেন- অাজ তারাই তার খবর লিখছেন। তার স্মৃতিচারণ করে অশ্রুসিক্ত হচ্ছেন। সহপাঠী, সহকর্মী, অগ্রজ, অনুজরা অাজ তাকে পরম মমতায় ভালোবাসায় বিদায় জানিয়েছেন। এমন বিদায় দৃশ্য খুব বেশি দেখা যায় না। এযেন সে কবিতার মতোই ছিল তার জীবন।

"প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদেছিলে একা তুমি, হেসেছিলো সবে
এমনো জীবন তুমি করিবে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন"

মাত্র ৩২ বছরের জীবন। অাজ তার ৩৩ বছরে পদার্পণ করার কথা। সোমবার রাতে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। রোববারও সুস্থ থাকা মানুষটা সোমবারে নেই!

মামুনুর রশীদের সঙ্গে অামার ব্যক্তিগত সখ্যতা গড়ে উঠার সুযোগ হয়নি। লিফটে, সিঁড়িতে দেখা হতো। ইশারায় সালামের ভঙ্গিমা করতাম। হাসিমুখে উত্তরের ভঙ্গিমা করতেন। কিন্তু তার জানাজায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজে নিজেই ধাক্কা খাই। মনে হচ্ছে, সাংবাদিকতা করতে এসে বোকামী করিনি। সাংবাদিকদের জন্যও মানুষ কাঁদে।

পৃথিবীতে সাধারণত দু`ধরনের মানুষ অাসে। এক ধরনের মানুষ জীবন গড়ে তোলে নিজের বা পরিবারকে কেন্দ্র করে। অারেক ধরনের মানুষ পৃথিবীতে দাগ কাটে বা রেখে যায় তার অাগমনী বার্তা। মানুষকে ভালোবাসা বা মানুষের জন্য কাজ করে যায় নিরন্তর। তাদের মৃত্যুর পর পৃথিবীর মাটি নাড়ী ছেঁড়া ব্যথা অনুভব করে। মামুন ভাই চলে যাওয়ার পরে অামরা দেখেছি, তিনি তেমনি দাগ কেটে গেছেন। শুধু নিজের পরিবার নয়; যেখানে যেখানে তিনি পা রেখেছিলেন সেখানেই তৈরি করেছেন নিজের ভালোবাসার ভুবন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাংবাদিকতা, একুশে টেলিভিশন, প্রধানমন্ত্রীর বিটে যারা কাজ করেন সব বলয়ে, সব ঘরানায় মামুনুর রশীদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। এসবের বাইরেও তার অারেকটি পরিচয় ছিল। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত থাকা মামুন ভাইয়ের মৃত্যুর পর প্রমাণিত হলো, মামুন ভাই ছিলেন সাবেক ও বর্তমান ছাত্রনেতাদের কাছে একটি অাবেগের নাম।

এক বিবেচনায় সংখ্যা বা পরিমাপের দিক থেকে ৩২ কোন বয়স নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অাশি বছর বেঁচেছিলেন। অাবার অারেক বিবেচনায় ৩২ অনেক বয়স। মহাবীর অালেকজান্ডার দ্যা গ্রেট এই বয়সে সারা পৃথিবী জয় করেছিলেন। মামুন ভাইয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন তিনি অনেকের মনোরাজ্যে `অালেকজান্ডার` হয়তো নন, তবে সুন্দর জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন।

মামুন ভাইয়ের জানাজায় ছাত্ররাজনীতির সাবেক ও বর্তমান নেতাদের অশ্রুসজল উপস্থিতি ছিল। বড় ছোট ভেদাভেদ ভুলে অনেককেই দেখা গেল হাউমাউ করে কাঁদতে। রাজধানীর বুকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা কে কাকে সান্ত্বনা দিবে? মামুন ভাইয়ের পর পর দুটি জানাজা যথাক্রমে ইটিভি ভবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। এরপরও অনেকে তার জানাজায় অংশ নিতে না পেরে অাফসোস করতে দেখা গেছে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব অাশরাফুল অালম খোকন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে খোকন ভাই ছিলেন একটি সাহসী নাম। সেই খোকন ভাইকে যখন কাঁদতে দেখি তখন ধাক্কা খাই। সমাজসেবা নয়, দানবীর নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নয়, একজন তরুণ সাংবাদিকের মৃত্যুও তাহলে মানুষকে কাঁদায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার কারণে ঢাকার বুকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মামুন ভাইয়ের প্রচুর বন্ধু-সহপাঠী কর্মরত অাছেন। তাদের ঠেলাঠেলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে পা রাখার জায়গা নেই। ক্যাম্পাসের বড় বড় গাছের পাতা ভেদ করেও কড়া রোদ মাঠটিতে। এতগুলো পরিচিত মানুষ নিজেদের কান্না চাপতে গিয়েই হয়তো অন্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না।

অাওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. অাবু কাউছার ছিলেন বাকরুদ্ধ দু`জনেই জানাজায় ছিলেন নীরব। তাদেরকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ডাকা হলে চোখ মুছতে মুছতে ইশারায় না বললেন।

মামুন ভাইকে শেষ দেখা দেখতে এসেছেন অাওয়ামী লীগের তরুণ নেতা ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। দাদা নিজেও সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দাদাকে বললাম, দাদা মামুন ভাইকে নিয়ে একটা কমেন্ট করুন। দাদা অামার কাঁধে হাত রেখে কেঁদে উঠলেন।

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রোটন ভাই ও জাকির সমস্বরে বললেন, সাংবাদিকতা করতে করতে অনেকের মধ্যে অহংকার অাসে। কিন্তু মামুন জানতো না অহংকার কী জিনিস। ছাত্রলীগের সাবেক উপ প্রচার সম্পাদক ও বর্তমানে প্রচার উপ কমিটির সদস্য রাসেল ভাই বললেন, অাদনান, অামরা অামাদের একটা ভাই হারালাম।

সোমবার রাতে মামুন ভাই মারা যাওয়ার পর মৃত্যুর খবর মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে যায় পরিচিত মহলে। মধ্যরাতেই হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ছিল সহকর্মীদের ভীড়। রাত দ্বিপ্রহরের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জায়গা করে নেয় মামুন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ। তাকে নিয়ে সেলফি, স্মৃতিচারণ তখন ভাইরাল হচ্ছে। হায়! যেন এক রাজকীয় মৃত্যু! মাত্র বত্রিশ বছরে এই প্রতিযোগীতামূলক সমাজে এমন গর্বিত বিদায়!

সাংবাদিকতা অনেকেই করে। কিন্তু নিজের কর্মক্ষেত্রের সীমানাকে ডিঙিয়ে অন্য অনেকের মাঝে একজন হয়ে উঠা একটি কঠিন কাজ। খুব অল্প সময়ে মামুন ভাই সেই কাজটি করতে পেরেছিলেন শুধু ভালোবাসা দিয়ে।

মামুন ভাইয়ের কর্মস্থল একুশে টেলিভিশনে অাজ শোকের ছায়া। অামাদের কাছে ইটিভি একটি পরিবার।

প্রবাদ আছে, অাল্লাহকে পাওয়া যায়, মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। মামুন মানুষকে ভালোবেসেছিল- তার প্রমাণ তার মৃত্যুর পর হয়েছে। তাহলে কী তিনিও অাল্লাহকে পেয়েছেন? মানুষের চোখের পানির চেয়ে পবিত্র এ পৃথিবীতে অার কিছু নেই। অাল্লাহ নিশ্চয় এতগুলো মানুষের চোখের পানি উপেক্ষা করতে পারবেন না।

প্রভু, অামাকে- অামাদেরকে যেন অার কোন সহকর্মী বা অাপনজনের মৃত্যু সংবাদ নিজ হাতে লিখতে না হয়। তবে তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি