ঢাকা, শনিবার   ০৪ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২১ ১৪৩১

মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট: একটি পর্যালোচনা

এ এইচ এম এমরানুর রহমান

প্রকাশিত : ০৫:৩৭ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ০৬:৩৩ পিএম, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮ শনিবার

মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের এক বিচারক একটি জেলার সিভিল সার্জনকে সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে আবারও নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়।

সম্প্রতি বিশিষ্ট আইনবিদ এবং বিজ্ঞ আইনজীবী মহল থেকে একটি দাবি উত্থাপিত হয়েছে যে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পরিবর্তে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হওয়া উচিত। মোবাইল কোর্টের কতিপয় সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী এ দাবিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। মোবাইল কোর্টের বিদ্যমান প্রক্রিয়াটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আইনবিদরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। মোবাইল কোর্টের বিচার প্রক্রিয়ায় একই ব্যক্তি একই সঙ্গে বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা এবং বিচারকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিগত ১১ মে ২০১৭ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালন অবৈধ এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে মূল্যবান রায় দিয়েছেন। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ মতামত প্রকাশ করেছেন যে ‘‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের উপর বিচারিক ক্ষমতা অর্পন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর তীর্যক আক্রমণ এবং ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ তত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আরও মত প্রকাশ করেছেন যে ‘‘মোবাইল কোর্ট আইনের ৫, ৬(১), ৬(২), ৬(৪), ৭, ৮(১), ১০, ১১ এবং ১৩ ধারার মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতা অর্পনের মাধ্যমে আইনবিভাগ ( লেজিসলেচার) সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন এবং এরূপ লঙ্ঘন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর তীর্যক আক্রমণ এবং সেপারেশন অব পাওয়ার ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’’

অন্যদিকে মোবাইল কোর্ট আইনের ১৫ ধারাটি উক্ত আইনের আরেকটি ভয়ংকর দিক যার মাধ্যমে সরকারকে উক্ত আইনের তপসিল সংশোধন করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এ ১৫ ধারা প্রসঙ্গে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘‘এটা অত্যন্ত বিষ্ময়ের ব্যাপার যে মূল আইনের তপসিল সংশোধন করার মত অবাধ ক্ষমতা ( প্লিনারি পাওয়ার) পার্লামেন্ট সরকারের উপর ন্যাস্ত করেছেন............ এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে গৌণ ও সহায়ক ( সাব অর্ডিনেট ও সাবসিডিয়ারি) আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পার্লামেন্ট সরকারের হাতে কিংবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত করতে পারেন কিন্তু মূল আইন ( প্যারেন্ট স্টেটিউট) সংশোধন করার অবাধ ক্ষমতা ( প্লিনারি পাওয়ার) পার্লামেন্ট সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে পারেন না। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আরও মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘‘মোবাইল কোর্ট আইনের ১৫ ধারা কর্তৃক সরকারের উপর আইনের তপসিল সংশোধনের অবাধ ক্ষমতা অর্পনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট সন্দেহাতিতভাবে সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো বলে খ্যাত সেপারেশন অব পাওয়ার থিওরি লঙ্ঘন করেছেন।

কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর ১১(৪) ধারা উল্লেখ করে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ বলেছেন যে- ‘‘হাইকোর্ট বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকার কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা অর্পন করতে পারেন এবং এরূপ অর্পিত দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তিনি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কোন দায়িত্ব পালন করবেন না।’’ মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন আরো মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘‘জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যেতে পারে।’’

ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৯(২) ধারা অনুসারে সরকার অফিসিয়াল গেজেটে সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দায়রা আদালতের কার্যক্রম কোথায় বসে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করে দিতে পারেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার স্থান সম্পর্কে এরুপ অফিসিয়াল গেজেট নোটিফিকেশন সংক্রান্ত কোন বিধান ফোজদারি কার্যবিধির কোথাও নেই। এ দৃষ্টিকোণ থেকে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অপরাধ সংঘটনস্থলে গিয়ে বিচার কার্য পরিচালনা করলেও তা আইন বহির্ভুত হবেনা। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিউট (এমেন্ডমেন্ট) এক্ট এর ৩৩ক ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটগণকে মোবাইল কোর্ট হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

উক্ত ধারায় বলা হয়েছে যে - ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এ যাহা কিছুই থাকুকনা কেন এ আইনের অধীন বিচার্য কোন অপরাধের বিচার কোন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ারভুক্ত যেকোন এলাকায় বসে পরিচালনা করা যাবে। অপর দিকে ফার্টিলাইজার (ম্যানেজমেন্ট) এক্ট, ২০০৬ এ বলা হয়েছে যে এ আইনের অধীন বিচার্য কোন অপরাধের বিচার আদালতের স্থানীয় অধিক্ষেত্রের মধ্যে যেকোন স্থানে বসে পরিচালনা করা যাবে।

এছাড়াও ২১ ডিএলআর ১০ এ বলা হয়েছে- ‘‘যে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার স্থান নির্ধারনের পূর্ণ স্বাধীনতা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের রয়েছে। কোন ভবনের সীমাবদ্ধ কক্ষে বসেই বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে এরুপ কোন বাধা ধরা আইন নেই বরং অপরাধ সংঘটনের উন্মুক্ত স্থানে বসেও বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।’’ ন্যায় বিচারের স্বার্থে অপরাধ সংঘটনস্থলে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করার বিবেচনামূলক ক্ষমতা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের রয়েছে ( ২১ ডিএলআর ৩০৭).

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, বিভিন্ন আইনে বর্ণিত বিধান অনুসারে এবং উপরোল্লিখিত মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ ভ্রাম্যমান আদালত হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকে অবৈধ ঘোষণা করে যে রায় প্রদান করেছেন তার বিরুদ্ধে মহামান্য আপিলেট ডিভিশনে আপীল চলমান রয়েছে। সংবিধানের অভিভাবক এবং জাতির সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য আপীলেট ডিভিশন এ বিষয়ে যে মূল্যবান সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন তাই জাতির জন্য অবশ্য পালনীয় হবে।

লেখক পরিচিতঃ এ এইচ এম এমরানুর রহমান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে আইন বিষয়ে স্নাতক এবং  ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি সহকারী জাজ হিসেবে পটুয়াখালীতে কর্মরত আছেন।