ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

অসহায়দের পাশে দাঁড়াই

মঈন বকুল

প্রকাশিত : ১৪:০৭, ৩০ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ০৯:৩৩, ৩১ মার্চ ২০২০

‘মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কি/ মানুষ পেতে পারে না…ও বন্ধু’ ভুপেন হাজারিকার এই জীবনমুখী গানের পঙক্তি আজও মানুষের মনে দোলা দেয়। আমরা তো সবাই মানুষ। পার্থক্য শুধু একটাই কারো অর্থবিত্ত বেশি আর কারও কম। কিন্তু আমরা সবাই সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করি। এই সমাজবদ্ধ অবস্থায় যদি মানুষের দুঃসময়ে, বিপদে-আপদে, মহামারিতে আমরা একে অন্যের প্রতি সদয় না হই, বিপদে আপদে যদি এগিয়ে না আসি তাহলে আমরা কিসের মানুষ। তারা মনুষত্বহীন মানুষ। যারা মানবিক নয়।  

আমরা সেই মানুষ হতে চাই, যে মানুষ হবে একজন মানবিক, অন্যের বিপদে ছুটে আসবে, মানুষের কষ্টে কষ্টিত হবে, যারা একমুঠো ভাতের জন্য দিশেহারা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। তারাই হচ্ছে সত্তিকারের মানবিক মানুষ। 

দেশ, জাতি, বিশ্ব আজ চরম সংকটে। মাহামারি আকার ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস। হাজার হাজার মানুষ আজ মারা যাচ্ছে। ভবিষ্যত খুবই ভয়ঙ্কর। কত লাখ মানুষ মারা যাবে তার কোনো ইয়ত্বা নাই। বিশ্বের পাশাপাশি আজ বাংলাদেশের অবস্থা চরম খারাপের দিকে। সবশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক মানুষ মারা গেলেও সরকারি হিসেব মতে, করোনায় মারা গেছে ৫ জন। এছাড়া এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৪৯ জন। তবে আশার বাণী হচ্ছে অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। 

করোনা ভাইরাসের কারণে যাদের কপালে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, তারা হল দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ। আমাদের অনেকের ঝুঁকিটা স্বাস্থ্যগত। কিন্তু তাদের ঝুঁকিটা শুধু স্বাস্থ্যগত নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি সংকটাপূর্ণ।

তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিটাও আমাদের থেকে বেশি। তারা থাকে অস্বাস্থ্যকর, ঘিঞ্জি ও নোংরা পরিবেশে। সেখানে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ছোট্ট একটি কামরায় অনেক মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি।

তবে করোনা মহামারীর কারণে নিম্ন আয়ের এ সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, তার থেকে বেশি উৎকণ্ঠিত খাদ্য নিয়ে। তাদের একটাই কথা- ‘কাম না করলে খামু কেমনে? বউ-বাচ্চারে কী খাওয়ামু? বুড়া বাপ-মা’রে কেমনে দেখুম? আমগোরে করোনায় মরতে অইবো না। বেশিদিন এমন চললে আমরা এমনেই না খাইয়া মইরা যামুগা।’

দেশে এমন নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা কত? বিশ্বব্যাংকের ‘দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২ কোটি ৪১ লাখ লোক দৈনিক ৬১ টাকা ৬০ পয়সাও আয় করতে পারেন না।

৮ কোটি ৬২ লাখ লোকের দৈনিক আয় ৩ দশমিক ২ ডলার বা ২৭০ টাকার চেয়ে কম। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯-এর পরিসংখ্যানও এর কাছাকাছি তথ্যই দিচ্ছে। বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান (২০১৯) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৬ লাখ মানুষের মধ্যে সোয়া তিন কোটি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

বিবিএসের আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় পৌনে ২০ লাখ এমন পরিবার (ব্যক্তি নয়) রয়েছে, যাদের প্রতি মাসের গড় আয় মাত্র ৭৪৬ টাকা।

তাই আসুন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি সদয় হই। নিজেদের সাধ্যানুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদের প্রতি একটু খেয়াল রাখি, যাতে তারা অভুক্ত না থাকে। তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিটা একটু কমানোর চেষ্টা করি। করোনা সম্পর্কে তাদের বুঝাই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করি। সম্ভব হলে সাবান, মাস্ক, স্যানিটাইজার, খাবার ও ওষুধ দিয়ে তাদের সহযোগিতা করি।

ইতিমধ্যে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ মানবিক কাজগুলো শুরু করেছে। তাদের সাধুবাদ জানাই। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এখনও তা সীমিত ও অপ্রতুল। গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারবে না।

সমাজের উচ্চবিত্ত ও সুবিধাপ্রাপ্ত সবারই উচিত এ ভয়াবহ দুর্যোগে সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানো। বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিশ্বব্যাংকের মতে অতি ধনী বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে বিশাল একটি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে, যাদের ক্ষুদ্র সাহায্যও এ অসহায় মানুষগুলোর কষ্ট লাঘবে বড় ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশের ইতহাসে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জন। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার সূর্য সন্তানরা একে অন্যের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছে আমাদের এই দেশ। সেই দিন শত্রুর মোকাবেলায় সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যার যা আছে তাই নিয়েই মাঠে নেমেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। বৃদ্ধ, নারী, শিশু সবাই সবার জায়গা থেকে এক হয়ে সহযোগিতা করেছিল। 

সেই ১৯৭১ সালের মতো আজ শত্রু আমাদের সন্নিকটে। তাদের সঙ্গে লড়াই করার দিন আজ। মহামারি আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাসের কারণে দেশ আজ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এমতাবস্থায় শত্রুর মোকাবেলায় আমাদের একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যার যা আছে তাই দিয়ে মানুষকে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এদেশের দিনমজুর-অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবেই আমরা সেই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবেলা করতে পারব।  

এছাড়া প্রাচুর্যের পঞ্চসূত্রের একটি হলো দান। কারণ, দানের মাধ্যমে যখন সম্পদ বা অর্থ হস্তান্তরিত হয়ে সাময়িক শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তখন তা পূরণের জন্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অর্থের গতিশীলতা সৃষ্টি হয় এবং অর্থাগম ঘটে।

প্রাচুর্যের ক্ষেত্রে দান পাঁচভাবে ভূমিকা পালন করে। প্রথমত, দান উপার্জনকে শুদ্ধ করে। কারণ উপার্জন করতে গিয়ে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে যে অন্যায় হয়, অতিরঞ্জন হয় দান সে অন্যায়কে কাটায়। দ্বিতীয়ত, দান পাপমোচন করে। তৃতীয়ত, দান বালা-মুসিবত ও রোগ দূর করে। চতুর্থত, দান দারিদ্র্য বিমোচন করে ও দাতার অন্তরে তৃপ্তি প্রদান করে। পঞ্চমত, দান সম্পদে বরকত দেয়।

দান নিয়ে আল্লাহ তাআলা কোরআনুল করীমে বলেন: ‘হে ঈমানদারগণ! আমার দেওয়া রিজিকের কিয়াদাংশ দান করে দাও এমন এক মহা সংকটপুর্ণ দিন আসার পূর্বে, যে দিন না কোন বেচা-কিনা চলবে, না কোন বন্ধুত্ব কাজে আসবে এবং আল্লাহর অনুমতি ভিন্ন না কোন সুপারিশের সুযোগ হবে।’

–সুরা বাকারা, আয়াতঃ ২৫৪।

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- “সদকা (দান) আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ প্রশমিত করে এবং মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব করে।”

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার কছে সদাকা বা সাধারণ দানের অনেক মূল্য। দানের দ্বারা আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ প্রশমিত হয়। দানের দ্বারা বালা-মসিবত দূর হয়। রোগবালাই থেকে মুক্তির জন্যেও দান একটি ফলপ্রসু আমল।

দানের ব্যাপারে শুধু ইসলাম তথা কোরআন ও হাদিসে নয়, ঋগবেদ, ভগবদ্গীতা, বাইবেলেও দানের ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। 

ঋগবেদে বলা হয়েছে, “নিঃশর্ত দানের জন্যে রয়েছে চমৎকার পুরস্কার। তারা লাভ করে আশীর্বাদধন্য দীর্ঘজীবন ও অমরত্ব”-ঋগবেদ-১.১২৫.৬

বাইবেলে ঘোষণা করা হয়েছে, “ যখন দান করো গোপনে কর। তোমার নীরব দান সদাপ্রভু দেখছেন। তিনি তোমাকে পুরস্কৃত করবেন।”-মথি ৬:৩-৪

বেদে দান করা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি দুঃস্থদের সাহায্য করে না, অজ্ঞানী এবং অন্তঃদৃষ্টিহীন তার সকল উন্নতিই বৃথা, সকল সম্পত্তিই অনর্থক। যে অন্যদের সাহায্য করে না, অন্যকে অভুক্ত রেখে কেবল নিজে খায় সে মূলত পাপই ভোজন করে।’

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আসুন আমরা সবাই এগিয়ে আসি। একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। অসহায় দিনমজুরদের পাশে দাঁড়াই। তাদের প্রতি একটু সহানুভূতি প্রকাশ করি। আমাদের তো আল্লাহ অনেক দিয়েছেন, সেখান থেকে না হয় একটু দেই। এভাবে যদি আমরা সবাই একটু একটু করে এগিয়ে আসি তাহলে আর কোনো অভাব থাকবে না। তাদের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। অসহায়দের আর কাজের জন্য রাস্তায় নামতে হবে না। তাহলে আর ছড়াবে না করোনা নামের এই ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস। আসুন আমরা সবাই ভাল থাকার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের এই বিপদ-মসিবত থেকে রক্ষা করবেন। 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি