ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

রুমীর অমর কাব্য

দেলোয়ার আরজুদা শরফ

প্রকাশিত : ১৪:৫১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

‘মৃত্যুর কাছে অধিকাংশ মানুষ হেরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যান, আবার কিছু মানুষ মৃত্যুকে পরাজিত করে পৃথিবীতে অমর হয়ে যান’- সত্যিই তাই! যুগে যুগে মহা মানবরা যে আলোক বর্তিকা বহন করেছেন তা এমনই বর্তা দেয়।

আজ মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী (রঃ) এর তিরোধান দিবস (৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭—১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩)। এই দিনে এই মহান সুফি সাধক মহানন্দে পরম প্রভুর সাথে পরম আত্মার সাথে মিলিত হয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় বিশ্বাসী ও আল্লাহ ভক্ত মানুষকে দেখিয়েছেন সত্য সুন্দর প্রশান্তিময় সরল পথ। সাধারণ সহজ সরল জীবন যাপন ছিলো তাঁর। পরিপূর্ণ আল্লাহ সমর্পিত ছিলেন তিনি।

মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী (রঃ) রচিত গ্রন্থ ‘মসনবী’ ও ‘দিওয়ান’ তাঁকে অমর করে রেখেছে। পারস্যে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের পরই ‘মসনবী’কে যথার্থ পথ প্রদর্শক বলে মনে করা হয়।

রুমী (রঃ) ছিলেন মহাপণ্ডিত। অসামান্য পাণ্ডিত্য তাঁকে দরবেশ বা সুফিতে পরিণত করেছে। ‘ইলমে মারেফাত’ ও ‘এলমে লাদুনিতে’ তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন। এটা হলো শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের আলয়। সুফির মতে দেহই মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের মহা অন্তরায়। দেহের ভিতরে যে কামনা ও বাসনা মানুষকে সর্বদা সত্যপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যা মানুষকে ব্যক্তিত্ব বা অহংকার প্রদান করে, ভোগলিপ্সু করে, সে জৈব আকাংখার নাম সুফিদের ভাষায় ‘নফর’। নফসের ধ্বংসই দেহের কর্তৃত্বের অবসান ও আত্মার স্বাধীনতার পূর্ণতা। তাই নফসের বিরুদ্ধে সুফিদের আজীবন সংগ্রাম। রুমী (রঃ) তাঁর সারাটা জীবন নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।

তিনি লিখেছেন- 
‘ভুলে যাও বিশ্বের সব জাতি, ধর্ম, বর্ণের সকল ভেদা ভেদ। কেবল নিজের লক্ষ্য ও গন্তব্য ঠিক করে নাও। মনে রেখ তুমি হলে একটি আত্মা আর তোমার কর্ম হল শুধুই ভালবেসে যাওয়া।’ 

রুমীর মতে বুদ্ধি, যুক্তি ও ভক্তি এক নয়। বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে চিনা, বুঝা ও পাওয়া যায়না। বরং এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি। ভক্তিই সোপান। আর ভক্তির উৎস হচ্ছে প্রেম ও আসক্তি।

এ নিয়ে তিনি বলেছেন-
‘স্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর অজস্র পথ আছে। তার মাঝে আমি প্রেমকে বেছে নিলাম।’

রুমীর মতে আল্লাহ নির্গুণ নন। জ্ঞান, দয়া, করুণা, প্রেম ও ক্রোধ ইত্যাদি অসংখ্য গুণাবলী রয়েছে তাঁর। কিন্তু মানুষ তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তির মাপকাঠি দিয়ে আল্লাহর গুণাবলী অনুধাবন করতে পারেনা। কারণ বুদ্ধি ও যুক্তি নিজেই একটি সৃষ্ট বস্তু এবং মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমন্ডলীর সক্রিয়তার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং সৃষ্ট দিয়ে অসৃষ্টকে বুঝা সম্ভব নয়। আল্লাহকে বুঝতে ও চিনতে হলে ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রয়োজন। তাহলেই অন্তর দিয়ে আল্লাহকে অনুধাবন করতে পারবে। 

তিনি লিখেছেন- 
‘আমি খোদাকে খুঁজলাম, কিন্তু কেবল নিজেকেই খুঁজে পেলাম। আর যখন নিজেকে খুঁজলাম তখন কেবল খোদাকেই খুঁজে পেলাম।’

‘হে প্রভু আসলে তোমার আত্মা আমার আত্মা একই।তুমি আমার ভিতর আছ। আমি তোমার ভিতর আছি।আমরা দুইজন ই একে অন্যের ভিতর লুকিয়ে আছি।’

মানুষ যখন মারেফাতের ঊধ্বর্তন স্তরে উন্নীত হয়ে আপনার ভিতর আল্লাহর প্রকাশ অনভুব করে তখন তাঁর ব্যক্তিত্বের সীমা কোথায় ভাসিয়ে যায়। তিনি তখন অসীমের ভিতর আপনাকে হারিয়ে ফেলেন। কিংবা তিনি নিজের সীমার ভিতরেই অসীমের সন্ধান লাভ করেন। তখন তিনি আনন্দে বিভোর হয়ে বিশ্ব ভ্রহ্মাণ্ডের রাজৈশ্বর্যকে একেবারেই তুচ্ছ বোধ করেন। মারেফাতের স্তর উন্নীত হলে আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে আর কোনো ভেদাভেদ থাকে না। এ অবস্থার নাম হলো ‘হাল’। এ কথাগুলো পৃথিবীর মানুষের সামনে পেশ করে গেছেন মাওলানা রুমী (রঃ)। ইহজগতে থেকে মানবাকৃতি বজায় রেখে মানুষ কীভাবে অস্তিত্বহীন হতে পারে তা মাওলানা রুমী (রঃ) দেখিয়েছেন। 

তার লেখার মধ্যে রয়েছে-
‘মুহাম্মদের আলো কোন অগ্নিপুজারি বা ইহুদিকে পরিত্যাগ করে না। তাঁর সৌভাগ্যের ছায়া যেন সবার উপর উজ্জ্বল হয়! তিনি সুপথে নিয়ে আসেন যারা পথভ্রষ্ট হয়েছিল মরুভূমিতে।’

তাকে বলতে দেখা গেছে-
‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমার প্রাণ আছে আমি কোরআনের দাস।
আমি মোহাম্মদের রাস্তার ধূলিকণা, নির্বাচিত ব্যক্তি।
যদি কেউ আমার বলা বাণী ছাড়া অন্য কিছু আমার নামে চালায়,
আমি তাকে ত্যাগ করব সেসকল শব্দের প্রতি ক্ষুব্দ হয়ে।’

(বিশ্ব শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত)
লেখক : গীতিকার
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি