ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

বিশ্বজুড়ে শোষিতের পক্ষে নিঃস্বার্থ সৈনিক এমএন রায়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:১৭, ২০ জানুয়ারি ২০২১

১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশ শোষণের শেকল আরও শক্তভাবে ভারতবর্ষকে বেঁধে ফেলে। মুক্তিকামী দেশবাসীর জন্যে সে এক দুঃসহ সময়। সিপাহী বিপ্লবের ৩০ বছর পর ১৮৮৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণায় জন্ম নেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তার পিতা স্থানীয় আর্বেলিয়া ইংলিশ স্কুলে সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। শৈশব থেকে প্রবেশিকা পর্যন্ত নরেন্দ্রনাথ পড়ালেখা করেন এই স্কুলেই।

এরপর ন্যাশনাল কলেজের পাট চুকিয়ে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে (বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন প্রকৌশল ও রসায়ন শাস্ত্রে। এখানেই তিনি দীক্ষিত হন সশস্ত্র বিপ্লবে। গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে সদলবলে গেলেন সুন্দরবন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের প্রধান ঘাঁটি ছিল বাংলা। ইংরেজরা তাই সবচেয়ে বেশি ভয় পেত বাঙালিদের। 

বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ প্রথম বন্দি হন ২৩ বছর বয়সে। জেলখানায় বসেই আরেক বিপ্লবী বাঘা যতীনের সাথে তিনি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করলেন। এরপর জেল থেকে বেরিয়ে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। শোষিতের অধিকার আদায়ে বেছে নিলেন এক অজানা পথ, রুদ্ধশ্বাস যাত্রা। এই নরেন্দ্রনাথই পরবর্তীকালে দুনিয়াব্যাপী খ্যাত হন এমএন রায় নামে।

বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে পৃথিবীর পথে পথে 
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলার বিপ্লবীরা জার্মানদের সহায়তায় ভারতবর্ষ স্বাধীন করার পরিকল্পনা করলেন। জার্মান সরকারের সাথে আলোচনার জন্যে নরেন্দ্র ১৯১৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় গেলেন চার্লস মার্টিন ছদ্মনাম নিয়ে।

জার্মান দূতাবাসের সাহায্য না পেয়ে তিনি দুর্গম নৌ-পথে চলে গেলেন জাপানে। উদ্দেশ্য জাপানে নির্বাসিত চীনের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সান ইয়েৎসিনের সাথে বৈঠক করা। মধ্যস্থতা করলেন জাপান প্রবাসী আরেক বাঙালি বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো- জার্মানদের অর্থে কেনা চীনা অস্ত্র বিপ্লবীরা সংগ্রহ করবে আসাম সীমান্তে। নরেন্দ্র বেইজিং ছুটলেন জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাথে চুক্তি করার জন্যে। রাষ্ট্রদূত প্রস্তাব করলেন চুক্তিটি বার্লিনে স্বাক্ষর করা হোক। ফাদার চার্লস মার্টিন নামে জার্মান পাসপোর্ট দেয়া হলো নরেন্দ্রকে।

যুক্তরাষ্ট্র হয়ে তার ফ্রান্সে যাওয়ার কথা নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে উচ্চতর পড়ালেখার জন্যে। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, কোরিয়া হয়ে তিনি পৌঁছলেন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে। পরদিন খবরের কাগজে ছাপা হলো-‘একজন বিপজ্জনক হিন্দু বিপ্লবী ও জার্মান গুপ্তচর আমেরিকায় ঢুকে পড়েছে!’ নরেন্দ্র তৎক্ষণাৎ হোটেল ছেড়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি অধ্যাপকের বাড়িতে উঠলেন। নিজের নাম বদলে রাখলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, সংক্ষেপে এমএন রায়।

একপর্যায়ে তিনি সানফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের কন্যা ইভলিনকে বিয়ে করলেন। ইভলিন রাজনৈতিকভাবে তার বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে যান। পরবর্তীকালে এমএন রায় সানফ্রান্সিসকো থেকে সস্ত্রীক নিউইয়র্কে যান। সেখানে মার্ক্সবাদ নিয়ে নিবিড়ভাবে পড়াশোনার সুযোগ ঘটে তার।

বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রয়াসে অতন্দ্র 
১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে জার্মান পাসপোর্ট তার জন্যে আর নিরাপদ থাকল না। এমএন রায় সস্ত্রীক পালালেন মেক্সিকোতে। মেক্সিকোর রাজনৈতিক কর্মী ও চিন্তাবিদদের সাথে দারুণ সখ্য গড়ে তুললেন। তবে তিনি শুধু বিপ্লবী ছিলেন না, জ্ঞানপিপাসু এ মানুষটি ১৭টি ভাষা জানতেন। স্প্যানিশ ভাষা শিখলেন এবং পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেন।

মেক্সিকোতে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯১৭ সালে তিনি সোশ্যালিস্ট পার্টি গড়লেন; যা ১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির রূপ নেয়। মেহনতি মানুষের পক্ষে তার রচিত পার্টির মেনিফেস্টো তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল। সর্বসম্মতিক্রমে এমএন রায় পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি হলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে প্রথম কমিউনিস্ট বিপ্লব করলেন। বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে মেক্সিকো ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ছিল বড় একটি সাফল্য।

১৯২০ সালে মস্কোতে সারা পৃথিবীর কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মহাসমাবেশে এমএন রায়কে আমন্ত্রণ জানালেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান লেনিন। লেনিন তখন বামপন্থীদের একচ্ছত্র নেতা। দুঃসাহসিক এমএন রায় লেনিনের তত্ত্বের বিকল্প তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন। লেনিন ও এমএন রায় দুজনের তত্ত্বই গৃহীত হলো কংগ্রেসে।

তার পরবর্তী মিশন ছিল উজবেকিস্তান। দুই ট্রেন ভর্তি অস্ত্র ও রসদসহ তিনি উজবেকিস্তানের তাসখন্দে যান এবং সেখানকার স্বৈরাচারী আমিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। মধ্য এশিয়ায় থাকাকালে তিনি ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং এ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। 

১৯২০-এর দশকে ভারতে চলছিল অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফত আন্দোলন। খেলাফত আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল তুরস্কের খলিফাকে সাহায্য করার জন্যে ভারতবর্ষ থেকে লোক পাঠানো। তাদের সাথে একদল বিপ্লবী আফগানিস্তান হয়ে তাসখন্দে প্রবেশ করল। এমএন রায় তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিলেন। গেরিলা যুদ্ধে তারা ইরানের খোরাসান থেকে ব্রিটিশ বাহিনীকে উৎখাত করল।

উজবেকিস্তানে এমএন রায়ের নেতৃত্বে গঠিত সোভিয়েত সরকারের প্রভাব বলবৎ ছিল ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। এরপর লেনিন মারা গেলে ক্ষমতায় এলেন জোসেফ স্ট্যালিন। তার সাথে এমএন রায়ের চিন্তাভাবনার মিল হলো না। ১৯২৯ সালে স্ট্যালিন তাকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করলেন।

এমএন রায় আবার নাম বদলালেন। এবার ড. মাহমুদ নাম নিয়ে ফিরে এলেন ভারতে। দীর্ঘ ১৬ বছর পর। তক্কে তক্কে অপেক্ষা করছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। ধরা পড়লেন এমএন রায়। ছয় বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন তিনি।

মানবতাবাদী বিপ্লবের এক অভিনব ধারণা 
নিভৃত কারাগারে এমএন রায়ের চিন্তাজগতে বিপুল পরিবর্তন আসে। ইসলাম ধর্ম নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনার সুযোগ পেলেন এসময়। জেলে বসেই তিনি লিখলেন দ্য হিস্টোরিক্যাল রোল অব ইসলাম। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে একজন সমাজবিপ্লবী হিসেবে এই বইটিতেই প্রথম আখ্যায়িত করা হয়। তার মতে, ইসলামের অভ্যুদ্বয় মানবতাকে রক্ষা করেছিল। সমাজের অধিকার-বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের ক্ষমতায়ন করেছিলেন নবীজী (সা.)। ইসলামের আবির্ভাবের আগে সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো ধারণা ছিল না। সামাজিক সম্পর্কের চিরায়ত ধারণাগুলোকে আমূল বদলে দেয় ইসলাম। ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত বিস্তার ঘটেছিল। কারণ শ্রমিকরাও মুনাফার একটা ন্যায্য অংশ পেত।

পারস্য এবং রোমান সাম্রাজ্য পরস্পরকে পরাজিত করার জন্যে দেড় হাজার বছর যুদ্ধ করেও সফল হয়নি। অথচ নবীজীর (সা.) বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে সঙ্ঘবদ্ধ কিছু মানুষ মাত্র ১৫ বছরে দুই সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিল। 

কারামুক্ত হওয়ার পর এমএন রায় গতানুগতিক রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে সরে আসেন। র‌্যাডিকেল হিউম্যানিজম বা বিপ্লবী মানবতাবাদ নামে একটি অভিনব ধারণা তিনি দেন, যা মানুষকে তার আত্মপরিচয় জানতে ও মুক্তির উপায় অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে।

১৯৫৪ সালে ভারতের দেরাদুনে মারা যান এমএন রায়। আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এই বিপ্লবী ছিলেন শোষিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের নিঃস্বার্থ সৈনিক। যিনি শোষিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ঘুরেছেন সারা পৃথিবী।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি