ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সফল মানুষদের অনন্য দৃষ্টান্ত সুফি মিজান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৩৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সুফি মিজানুর রহমান। একজন সফল মানুষ। বাংলাদেশের শীর্ষ শিল্প-মালিকদের একজন তিনি। যাকে সবাই সুফি মিজান বলেই চেনেন। একইসঙ্গে এদেশের সফল শিল্প-মালিক এবং নতুন উদ্যোক্ততাদের কাজে প্রেরণার গল্প হিসেবে চমৎকার উদাহরণ এই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি।

অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন সুফি মিজানুর রহমান। তিনি ১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলায় রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম সুফি মুহাম্মদ দায়েম উদ্দিন ও মাতা রাহেতুন্নেছা। তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। গ্রামেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভারত চন্দ্র স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তী সময়ে ওই কলেজে বি.কম ক্লাসে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পাশ করেন।

নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বি.কম পড়া অবস্থায় কাজ নেন অদূরের জালাল জুট ভ্যালি কোম্পানিতে। বেতন মাত্র ১০০ টাকা। ওই কাজটিই ছিল সূচনা। তিনি সে-সময় থেকেই ভাবতে শুরু করেন, কবে তার নিজের একটা প্রতিষ্ঠান হবে। ছোট্ট একটা অফিস থাকবে। এমন একটি সংকল্পে তিনি শুরু থেকেই স্থির থেকেছেন।

১০০ টাকা বেতনে চাকরি নেওয়ার পরের বছরেই তা বেড়ে হয় ১৬৭ টাকা। সারাদিন চাকরির পর সন্ধ্যার সময় আবার কলেজে পড়তে যেতেন। কলেজ থেকে প্রায় চার মাইল দূরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন। আবার পরদিন কর্মস্থলে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানো। এভাবে কঠিন পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গেছেন তিনি। এমনকি তোলারাম কলেজে স্নাতক পাশ করার পূর্বেই তিনি চট্টগ্রামে এসে ব্যাংকে চাকরি নেন। নতুন চাকরি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (সোনালী ব্যাংক) চট্টগ্রামের লালদীঘি শাখায়। সরকারি চাকরি, তবে পদে জুনিয়র ক্লার্ক। এর দুই বছর পর ১৯৬৭ সালে জয়েন করেন তৎলীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে, বর্তমানে যেটি পূবালী ব্যাংক। তিনি এ ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় বৈদেশিক বিভাগের ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। বেতন ছিল ৮০০ টাকা। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূবালী ব্যাংকেই চাকরি করেন। স্বাধীনতার পর তিনি চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি প্রথমে ব্যবসার জন্য যার কাছ থেকে বেশি সহায়তা পেয়েছিলেন তিনি হলেন পূবালী ব্যাংকের তার পূর্বের কর্মস্থলের কর্মকর্তা আলতাফুর রহমান। আলতাফুর রহমান তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন—ব্যাংকের টাকা নিয়ে লোকসান করলে কোত্থেকে টাকা ফেরত দেবেন। তখন তিনি বলেন, ‘তিনি রক্ত বিক্রি করে হলেও ব্যাংকের টাকা ফেরত দেবেন।’ সে-সময় মূলত ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তার মধ্যে সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া যেত। তাছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ব্যবসাক্ষেত্রেও একটা শূন্যতা ছিল। কারণ এদেশের অধিকাংশ বড় ব্যবসায়ী ছিল অবাঙালি। আবার ব্যাংকে বৈদেশিক শাখায় চাকরির সুবাদে আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ছিল তার।

চাকরিতে তিনি কখনো ঠিক প্রাণ খুঁজে পেতেন না। নিজের কাজে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখালেও ভেতরে ভেতরে অন্য কিছুর জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। এর সঙ্গে বুঝতে পারেন, তাকে ব্যবসায়ই জড়াতে হবে, না হয় শান্তি পাবেন না। এ নিয়ে তিনি একটা পরিকল্পনা করে ফেললেন, টাকা জোগাড় বা কিভাবে এগোবেন তার একটি রূপরেখা।

জীবনে আমদানি করা প্রথম জিনিসটি ছিল ব্রিজস্টোন টায়ার। সময়টা ছিল ১৯৭২, দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। এ ব্যবসায় তিনি বিনিয়োগ করেন চার হাজার ডলার। প্রতি ডলারের বিপরীতে তখন পাওয়া যেত ১১ টাকা। বর্তমান বাজারদর অনুসারে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার টাকা। প্রথমবারের মতো এই আমদানি থেকে তিনি মুনাফা করেন এক লক্ষ টাকা। শুরু হলো প্রতিযোগিতার বাজারে নাম লেখানো। তিনি পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হিসেবে কার্যক্রম চালাতে লাগলেন। একসময় দেখলেন হাতে কয়েক কোটি টাকা জমে গেছে। তার মানে এখন চাইলে বড় কোনো কাজে হাত দেয়া সম্ভব। বঙ্গোপসাগর উপকূলে সীতাকুণ্ডে প্রতিষ্ঠা করলেন শিপইয়ার্ড। পুরনো জাহাজ কেটে আসবাবপত্র বিক্রি করা হতো সেই শিপইয়ার্ড থেকে। এখান থেকে অর্জিত আয় দিয়ে ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন রি-রোলিং মিল। তারপর ১৯৮৪ সালে, মংলা ইঞ্জিনিয়ার্স ওয়ার্কস নামে বিলেট তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন, ওটাই ছিল দেশের প্রথম বিলেট কারখানা। এভাবেই পুরোদস্তুর বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠেন সুফি মিজান।

সুফি মিজানকে নিয়ে ব্যবসায়ীমহলে প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে। তিনি যেখানে হাত দেন তা সোনা হয়ে যায়। একজীবনে বহু ব্যবসায় জড়িয়েছেন। যে কাজে হাত দিয়েছেন, সফল হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় ঢেউটিনের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন, পিএইচপি রানী মার্কা ঢেউটিন। এরপর সীতাকুণ্ডের কুমিরায় দেন সিআর কয়েল কারখানা। এভাবে একের পর এক বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন এবং সফল হন।

সুফি মিজানুর রহমান স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাই স্ত্রী তাহমিনা রহমানের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে পিএইচপি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। এমন একটা প্রবাদ চালু রয়েছে সর্বত্র। পিএইচপি দেশে ২৩টির বেশি খাতে বিনিয়োগ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—কোল্ড, স্টিল, ফিশারিজ, স্টকস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, পাওয়ার জেনারেশন প্লান্ট, কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং মিলস, শিপিং অ্যাজেন্সি, ফ্লাট গ্লাস, লেটেক্স অ্যান্ড রাবার প্রোডাক্টশন, টার্মিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, প্রপার্টিজ, রোটারি ক্লাব, পেট্রো রিফাইনারি, এগ্রো প্রোডাক্ট, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স, কোল্ডস্টোরেজ, শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং, ওভারসিজ, হাসপাতাল, অ্যায়ারলাইন্স ও ইলেক্ট্রিক খাত।

ব্যক্তিজীবনে সাত ছেলে এক মেয়ের গর্বিত পিতা সুফি মিজানুর রহমান। বড় সন্তান মো. মোহসিন পিতার মতোই দেশসেরা একজন শিল্পোদ্যোক্তা। তার অন্য ভাইবোনেরা হলেন—ইকবাল হোসেন, আনোয়ারুল হক, আলী হোসেন, আমির হোসেন, জহিরুল ইসলাম ও আক্তার পারভেজ হিরু ও ফাতেমা তুজ-জোহরা। তাদের মা তাহমিনা রহমান।

পারিবারিকভাবে ঢাকার কাঞ্চননগর গ্রামে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন তারা। মাত্র পাঁচ টাকায় সেখানে রোগীদের দেয়া হয় চিকিৎসাসেবা। চট্টগ্রাম শহরের আসকারদীঘি পাড়ে মাউন্ট হাসপাতালসহ শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে উচ্চশিক্ষার জন্য ‘ইউআইটিএস’ গড়ে তুলেছেন তিনি।

সুফি মিজানুর রহমানের আরেকটি স্বপ্ন আছে দেশের ভেতর একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার। পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার জন্য ‘জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অ্যান্ডস কমার্স’ গড়ে তোলার ইচ্ছে আছে।

এবছর তিনি একুশে পদকের জন্য মননিত হয়েছেন। এছাড়া সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সুফি মিজান লাভ করেছেন ২০০৩ সালের দ্য ডেইলি স্টার অ্যান্ড ডিএইচএল বেস্ট বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, ২০০৭ সালে ব্যাংক বীমা অ্যাওয়ার্ড, ২০০৯ ও ২০১১ সালের ব্যাংক বীমা অর্থনীতি অ্যাওয়ার্ড।
এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি