ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

(পর্ব-৩)

মৃত্যুকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে ইয়াবা

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৭:২৫, ৮ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৭:৪৬, ২০ মে ২০২২

মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা একটি পরিচিত নাম। যার গ্রাসে ধ্বংস হচ্ছে তারুণ্য। বর্তমানে এ পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। স্কুল পড়ুয়ারাও জড়িয়ে পড়ছে এই সর্বনাশা নেশায়। মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা ‘বাবা’ নামেও পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনেই এর লেনদেন হয়। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইম এর তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকসেবীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ হলো ইয়াবা সেবনকারী। আর এদের মধ্যে ৩০ শতাংশই নারী। আসক্তদের অধিকাংসই তরুণ-তরুণী।

ইয়াবা সেবন করলে দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে স্নায়ুতে উত্তেজক ক্রিয়া শুরু হয়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এ সময়ের মধ্যে ব্যবহারকারী অতিপুলক অনুভব করে। অন্যরকম এক জগতে বাস করে। কিন্তু এর প্রভাব কেটে যাওয়ার পর মাদকটি গ্রহণ না করলে সোজা আকাশ থেকে পাতালে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়।

এ প্রসঙ্গে মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘প্রশান্তি’র প্রশাসক ফারুক রহমান মিন্টু ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “এক সময় শুধু একটা শ্রেণির মানুষেরা মাদক গ্রহণ করতো। আর এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী সব শ্রেণি পেশার মানুষই এতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো অষ্টম-নবম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরাও এই নেশায় ডুবে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে একটি গণজোয়ার তৈরি করতে হবে।

মরণ নেশা ইয়াবা গ্রামে-গঞ্জে শহরে সব জায়গায় এখন ছড়িয়ে আছে। প্রতিবছর ভারত ও মিয়ানমারসহ পাশের দেশগুলো থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা বাংলাদেশ আসে। এর মাধ্যমে এ দেশের মেধাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার একটি চক্রান্ত চলছে। ইয়াবা সেবনের মধ্য দিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। 

এ সম্পর্কে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘অর্জন’ এর কেইস ম্যানেজার রিয়াদ রহমান ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ইয়াবা সেবনে সাময়িক আনন্দ পাওয়া গেলেও পরে আসক্ত ব্যক্তি নানা ধরণের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মূলত ইয়াবার মাধ্যমে আমাদের দেশের মেধাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র চলছে। এখন পরিবার উদ্যোগী হয়ে যদি আসক্তদের সঠিকভাবে কাউন্সিলিং করে বা চিকিৎসা দেয় তাহলে তাদের নেশা থেকে ফেরানো সম্ভব।  

কেন তরুণ-তরুণীরা ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে?

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ‘অর্জন’এর কেইস ম্যানেজার রিয়াদ রহমান ইটিভি অনলাইনকে বলেন, সাময়িক আনন্দো লাভের জন্যই সবাই ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে। তাছাড়া তরুণ-তরুণীদের মাঝে ইয়াবাকে আকর্ষণীয় করার জন্য মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে আঙ্গুর, কমলা ও ভ্যানিলার ফ্লেভার। লাল ও কমলা রংয়ের ট্যাবলেটটি দেখতে ও খেতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো। এটি সহজে লুকিয়ে রাখা যায় এবং বহনেও সহজ। ইয়াবা সেবনে ক্ষুধা কমে যায় বলে অনেক তরুণী স্লিম হওয়ার আগ্রহে খাওয়া শুরু করে। ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব বুঝার আগেই এর নেশায় জড়িয়ে পড়ে। 

ইয়াবা সেবনে যেসব ক্ষতি হয়-

ইয়াবা সেবনের ফলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যা একজন মানুষকে মৃত্যুর দিকেই ধাবিত করে। এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, নিয়মিত ইয়াবা সেবন করলে ফুসফুস, লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন ইয়াবা সেবনের ফলে স্পিড বাগ বা ক্র্যাঙ্গ বাগ নামক হেলুসিনেশন তৈরি হয়। এতে ব্যবহারকারীর মনে হয় তার শরীরের চামড়ার নিচ দিয়ে ছারপোকা কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। তখন সেবনকারী এদের টিপে মারার জন্য মরিয়া হয়ে উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকে। এছাড়া দীর্ঘদিন আসক্তির ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অনিদ্রা দেখা দেয়-এটি এতটাই ভয়ংকর যে টানা সাত থেকে ১০ দিনও জেগে থাকতে বাধ্য হয় সেবনকারীরা। নাড়ির গতি বেড়ে যায়, রক্তচাপ, হেপাটাইটিস বি, সি ও এইডসের মতো জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।   

ইয়াবার বিস্তার রোধে করণীয়-

ইয়াবা গ্রামে গঞ্জে শহরে সর্বত্রই এখন ছড়িয়ে আছে। এর রোধ করা অতীব জরুরি। এ সম্পর্কে রিয়াদ রহমান বলেন, ইয়াবা বিস্তাররোধে প্রয়োজন সামগ্রিক প্রতিরোধ। এর জন্য যুব সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। তরুণ-তরুণীদেরকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে ইয়াবা। ১৯৯৮ সাল থেকে এ দেশে ইয়াবা আসা শুরু হয়। শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করেই ইয়াবা তৈরি করছে মায়ানমার। আবার ভারত থেকেও সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে অবাধে। তাই সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।    

তবে ইয়াবাকে বন্ধ করার জন্য সরকারও নানা ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। নিয়মিত চালাচ্ছে অভিযান। তাদের কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াবারোধে।

এ সম্পর্কে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ঢাকা উত্তর) মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ইয়াবার মতো ভয়াবহ নেশা থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করতে আমরা দিন রাত চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। প্রতিটি জায়গায় অভিযান চলছে, অনেককে গ্রেফতারও করেছি। ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করার ফলে সীমান্তে ৭৪টি ফেনসিডিল কারখানা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। এভাবে আমাদের মাদক নির্মূলের সর্বাত্বক চেষ্টা চলছে।  

ইয়াবা থেকে মুক্তির উপায়-

যারা ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে তাদের জীবন শেষ এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। তারা অবশ্যই সুস্থ হবে বলে জানিয়ে ফারুক রহমান মিন্টু বলেন, আমাদের নিরাময় কেন্দ্রে অনেক রুগি আসে। বা অনেক অভিভাবক নিয়ে আসে। আমরা তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করি। এবং এক সময় তারা সুস্থ হয়ে যায়। সুতরাং নিরাময় কেন্দ্রে আসলে অবশ্যই ভাল হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।    

দীর্ঘ ১৮ বছর মাদক সেবন করে বর্তমানে সুস্থ রয়েছেন হুমায়ুন কবির। পরিবারের সঙ্গে থাকেন রাজধানীর গোড়ানে। তিনি বলেন, আমি যখন মাদক গ্রহণ করতাম তখন ভালো-মন্দ কিছুই বুঝতাম না। আমার কারণে আমার পরিবার আত্মীয়-স্বজন সবাই হেয় হয়েছে। কষ্ট শিকার করেছে। এক সময় মনে হতো আমি আর বাঁচবো না। কিন্তু আমি একটি পূর্ণবাসন কেন্দ্রে ভর্তি হলে পরে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠি। এখন বর্তমানে আমার আর কোনো সমস্যা নেই। একটু চেষ্টা করলে যে কেউ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। আমার মত আবার সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে পারেন।  

 

এসি/এসএইচ

 

 

 

 

 

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি