ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কৌশলের কাছে কোরাইশদের পরাজয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:২৮ পিএম, ২৩ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৮:৩৬ পিএম, ২৩ মে ২০২০ শনিবার

পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে। 

প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। 

পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। নবম পর্বে জেনেছেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান। দশম পর্বে আপনারা জেনেছেন বিপর্যয় থেকে বিজয়ে উত্তরণের কাহিনী। একাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন- হাজার বছরের শোষণের অবসান ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের বিবরণ। দ্বাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন সাহস ও সমঝোতায় বিজয়ের বিবরণ ও মুনাফেকদের অপপ্রচারের ব্যর্থতার কাহিনী। এবার ত্রয়োদশ পর্বে আপনারা জানবেন নবীজীর (স) কৌশলের কাছে কোরাইশদের পরাজয়ের বিবরণ।

আরবের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ক্রমশ কোরাইশদের প্রতিকূলে যাচ্ছিল। বদরের পরাজয়। ওহুদে মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করতে না পারা, আর চ্যালেঞ্জ দিয়েও মুসলমানদের মোকাবেলায় পরবর্তী বছরে বদরে না এসে কাপুরুষ বলে পরিগণিত হওয়া-এই সংকটাপন্ন ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্যে ওহুদের চেয়েও বড় কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করল কোরাইশরা। কিন্তু কীভাবে সম্ভব তার পথ বের করে দিল খায়বরে আশ্রয় গ্রহণকারী ইহুদিরা। বনু মুস্তালিক অভিযানের দু’মাস পর বনু নাদিরের সাল্লাম ইবনে আবু হুকাইক, কিনানা ইবনে আল রাবি, হুয়াই ইবনে আখতাব এবং বনু ওয়াইল-এর হাওদা ইবনে কায়েস, আবু আম্মার-সহ ২০ জন গোত্রপতি মক্কায় গিয়ে দেখা করল কোরাইশদের সাথে। কোরাইশ নেতাদের তারা বলল, তোমাদের ধর্ম মুসলমানদের ধর্মের চেয়ে ভালো। আসো, আমরা মৈত্রীবন্ধনে একত্র হই।

লক্ষ্য একটাই- মদিনা থেকে মুসলমানদের সমূলে উচ্ছেদ। মুহাম্মদ ও তাঁর লোকবল ধ্বংস করার জন্যে মদিনায় জড়ো করতে হবে সকল মিত্রকে। ইহুদি প্রতিনিধি দল আরবের সকল প্রান্তে গিয়ে গড়ে তুলল অধর্মের পতাকাবাহী সম্মিলিত বাহিনী। দক্ষিণ আরবের কোরাইশ, কিনানা ও তিহামাদের মিত্র গোত্রগুলো থেকে ৪০০০ সৈন্য আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে। এর সাথে মদিনার পূর্বাঞ্চল থেকে সুলাইম, গাতাফান, মুররা, ফাজারাহ, আশজা এবং অন্যান্য গোত্রের ৮০০০ সৈন্য। ফাজারাহর সেনাপতিত্ব করবে উয়াইনা ইবনে হিসন, মুররার সেনাপতিত্ব করবে হারিস ইবনে আউফ। আশজার সেনাপতিত্ব করবে মিসার ইবনে রাখিলা। সুলাইমের সেনাপতিত্ব করবে সুফিয়ান ইবনে আবদ শামস। তাদের সবার লক্ষ্য হবে মদিনা। সমবেত হবে পূর্বনির্ধারিত দিনে।

সবমিলিয়ে সমাবেশ করা হবে ১২ হাজার সৈন্য। বিশাল বাহিনী দেখে যেন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মুসলমানদের অন্তরাত্মা! কারণ নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ মদিনার মোট মুসলিম জনসংখ্যাই ১০ হাজারের কম। অকস্মাৎ আক্রমণ করতে পারলে তারা হত্যা করতে সক্ষম হবে সকল মুসলমানকে। নির্ধারিত দিনে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০ অশ্বারোহী এবং গাতাফানদের ৩০০ ঘোড়াসহ ১২ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী মদিনার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত। এত বড় বাহিনীর সমাবেশ এর আগে আরবে কেউ কখনো দেখে নি। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা দিয়েই মদিনার পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ সুরক্ষিত। এই তিন দিক দিয়ে আক্রমণকারী কোনো বাহিনীর মদিনায় প্রবেশ করা সম্ভব নয়। আক্রমণকারী বাহিনীর জন্যে একটাই পথ-উত্তরের সমতল ভূমি।

বিশাল বাহিনী উত্তরের সমতল ভূমিতে এসে বিস্মিত হতবাক। সামনে এগোনোর কোনো উপায় নেই। বিশাল পরিখা পথরোধ করে অবস্থান করছে। পদাতিক বা অশ্বারোহী কোনো বাহিনীর পক্ষেই এই পরিখা পার হওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধ করতে এসে আরবদের কোনো বাহিনীই কখনো এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হয় নি। যোদ্ধার দল দুই পাশে। মাঝখানে অনতিক্রমণীয় পরিখা। পরস্পরের প্রতি তীর ও পাথর নিক্ষেপ ছাড়া আক্রমণের আর কোনো পথ নেই।

আরবে কোরাইশ, ইহুদি ও মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণকারী এই অবরোধই ইতিহাসে পরিচিত ‘খন্দকের অবরোধ’ নামে। এত বিশাল আয়োজন। একমাস অবরোধ। মারমুখী আচরণ। তারপরও দুই পক্ষে নিহতের সংখ্যা ২০ জনেরও কম। আসলে খন্দকে লড়াই অস্ত্রের হয় নি। হয়েছে কৌশলের, কূটনীতি ও মনস্তত্ত্বের। গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে নবীজী বুঝতে পারলেন, সারা আরবের পৌত্তলিক ও ইহুদিরা বিশাল বাহিনী নিয়ে মদিনায় চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন তিনি সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন। সালমান ফারসির পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলো, পরিখা খনন করে আক্রমণকারী বাহিনীর গতি থামিয়ে দিতে হবে।

পরিখাকে ফার্সি ভাষায় বলা হয় খন্দক। পরিখা দৈর্ঘ্যে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার, একটু আঁকাবাঁকা (ইংরেজি এন অক্ষরের মতো) হবে ভূপ্রাকৃতিক কারণে। আট থেকে ১০ হাত গভীর এবং ২০ হাত প্রশস্ত। পরিখার মাটি মদিনার দিকে প্যারাপিটের মতো উঁচু করে রাখা, যাতে ঘোড়সাওয়ারেরা লাফ দিয়ে পার হতে না পারে। আর শত্রুবাহিনী যাতে মাঠ থেকে কোনো ফসল না পায় সে জন্যে এক মাস আগেই মাঠ থেকে সকল ফসল কেটে নেয়া হয়। ঘোড়ার জন্যেও কোনো ঘাস অবশিষ্ট ছিল না মাঠে। রসদ না থাকলে অবরোধ যে বেশি দিন অব্যাহত রাখতে পারবে না, তাও পরিস্কার বুঝেছিলেন নবীজী। ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন সেভাবেই। এমনকি অবরোধ চলাকালে খায়বর থেকে কোরাইশদের জন্যে পাঠানো ২০ উট বোঝাই খাদ্য সামগ্রীও মুসলিম টহলদল কৌশলে নিজেদের শিবিরে নিয়ে আসে।

৩০০০ স্বেচ্ছাসেবী। ১০ জন করে একেকটা দল। ৩০০ দলে বিভক্ত করে সবাইকে সমপরিমাণ পরিখা খনন করার দায়িত্ব দেয়া হলো। শিশু, কিশোর ও বয়স্কসহ সবাই প্রচণ্ড উৎসাহে খনন ও মাটি সরিয়ে প্যারাপিট তৈরির কাজে নেমে পড়ল। স্বেচ্ছাসেবকরা সারাদিন কাজ করত। রাতে ঘরে ফিরে যেত। কিন্তু নবীজী একটি টিলায় তাঁবু স্থাপন করে দিনরাত সেখানেই অবস্থান করতেন। নবীজীও সবার সাথে একইভাবে কুড়াল দিয়ে পাথর ভাঙা, বেলচা দিয়ে মাটি আলগা করা ও মাটি বহন করে নিয়ে যাওয়া-প্রতিটি কাজেই সমান তালে অংশ নিলেন। পরিখায় মাটি টানার কাজ করতে করতে একদিন ক্লান্তিতে তিনি পরিখার পাশে হেলান দিয়ে বসেছেন। ক্লান্তি এতটাই ছিল যে, তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

আবু বকর ও ওমর কাছে দাঁড়িয়ে অন্যদের ইশারায় সরিয়ে দিচ্ছিলেন, যাতে কেউ তাঁর বিশ্রামে বিঘ্ন না ঘটায়। হঠাৎ তিনি জেগে উঠলেন। তাদেরকে ভর্ৎসনা করলেন। আমাকে তোমরা ঘুমাতে দিলে কেন? আমাকে ডাকা উচিত ছিল। পরিখা খননের কাজটি নিঃসন্দেহে তাদের জন্যে ছিল কষ্টকর। কারণ সাধারণ আরবেরা এ ধরনের কাজে অভ্যস্ত নয়। খোঁড়াখুঁড়ির কাজ দাসরাই করত। কিন্তু বিশ্বাস ও অস্তিত্ব রক্ষা করার তাগিদেই এ কাজে তাদের তাড়া ও গতি দুটোই ছিল। ইহুদি গোত্র বনু কোরাইজা তখনও মৈত্রীচুক্তি অনুসারে সকল খনন উপকরণ পাঠিয়ে সহযোগিতা করছিল। 

খনন কাজ চলাকালে একবার একটা বড় পাথর বেরিয়ে এলো। কয়েকজন সাহাবী মিলে চেষ্টা করেও তা ভাঙতে ব্যর্থ হলেন। নবীজী সেখানে গেলেন এবং পর পর তিন বার আঘাতের মাধ্যমে পাথর গুড়া করে ফেললেন। পাথর আঘাত করার সময় তিন বার বিদ্যুতের মতো ঝলকানি সৃষ্টি হলো উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে। সালমান ফারসি এই আলোর ঝলকানির রহস্য জানতে চাইলে নবীজী বললেন, আল্লাহ শিগগিরই তাঁর রসুলকে দক্ষিণে ইয়েমেন, উত্তরে সিরিয়া ও পূর্বে পারস্যের নিয়ন্ত্রণ প্রদান করবেন।

পরিখা খননকালে এক ক্লান্ত দিনের শেষে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ নবীজীকে রাতে খাবারের জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন। নবীজী তাঁর আশেপাশের সবাইকে ডাকলেন তাঁর সাথে যাওয়ার জন্যে। এতো জনকে খাওয়ানোর মতো কোনো খাবারই তার ঘরে ছিল না। জাবির ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়তে শুরু করলেন। নবীজী জাবিরের বাসায় এসে খাবারে দোয়া করলেন। সবাই তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পরও দেখা গেল, অনেক খাবার রয়ে গেছে।

এদিকে, খনন কাজে অংশগ্রহণকারীদের জন্যে প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থাও হয়ে উঠল দুরূহ। যবের গুড়া। খেজুর। তা-ও অপর্যাপ্ত। অর্ধাহার, কখনো অনাহার। একবার পুরো তিন দিন কোনো খাবার নেই। কিন্তু খনন চলছে বিরতিহীন। এসময় একজন এসে নবীজীকে বলল, ইয়া রসুলুল্লাহ! খুব ক্ষুধা লেগেছে- বলে পেটের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখালো যে, পেটে একটা কঠিন পাথর বাঁধা। নবীজী মুচকি হেসে বললেন যে, আমি তোমার কষ্ট বুঝি।

‘দেখ’ বলে তিনি নিজের পেটের কাপড় তুললেন। সাহাবী দেখল তাঁর পেটে দুটো পাথর বাঁধা (ক্ষুধা লাগলে পেটে পাথর বাঁধার কারণ হচ্ছে, এসিডিটি ও ক্ষুধা পেট গরম করে দেয়। পেটে পাথর বেঁধে রাখলে পেট ঠান্ডা থাকে)। অর্থাৎ নবীজী সর্বাবস্থায়ই ছিলেন সাহাবীদের রোল মডেল। দুঃখ-কষ্ট-বেদনার সাথী। ফলে এত অল্প সময়ে এত মাটি সরিয়ে ও সাজিয়ে মুসলমানরা পরিখা খনন সম্পন্ন করল। শত্রুকে থমকে দেয়ার প্রথম উদ্যোগ সফল হওয়ায় নবীজী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ান, সমরনায়ক খালেদ ইবনে ওয়ালিদ, ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল প্রবেশপথে অনতিক্রম্য পরিখা দেখে যুগপৎ বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। তাদের সমরনায়কেরা ক্ষুব্ধচিত্তে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু মুসলমান তীরন্দাজরা বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ করে তাদেরকে বাধ্য করল ফিরে যেতে। মুসলমানরা দিনরাত পাহারায় নিয়োজিত থাকল। কারণ তারা জানত, কোনো দুর্বল স্থান দিয়ে একবার যদি সম্মিলিত বাহিনী কোনোভাবে ঢুকে পড়ে, তবে পরিণতি কী হবে! ছোট বা বড় যে-কোনো গ্রুপ হামলা চালানোর চেষ্টা করলেই সাথে সাথে তারা বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ করে তা প্রতিহত করতেন।

কোরাইশদের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও চৌকস যোদ্ধা আমর ইবনে আবদ্ উদ-এর নেতৃত্বে অশ্বারোহীদের একটি দল পরিখার সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ দিয়ে একদিন মুসলিম এলাকায় প্রবেশ করল। আলীর নেতৃত্বে মুসলমানরা তাৎক্ষণিক বাধা দিল। দ্বন্দ্বযুদ্ধে আলীর হাতে আমর নিহত হলো। অন্যান্যরা পালিয়ে গেলেও নওফেল আল মাখজুমী ঘোড়াসহ পরিখায় পড়ে গেল। মুসলমানদের হাতে নিহত হলো। কোরাইশরা তার লাশ ফেরত দেয়ার জন্যে ১০ হাজার দিরহাম দেয়ার প্রস্তাব পাঠাল। নবীজী কোনো অর্থ ছাড়াই লাশ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করলেন।

অবরোধের প্রথম সপ্তাহ পার হতেই আবু সুফিয়ান বুঝতে পারলেন জয়-পরাজয় এত সহজে নিষ্পত্তি হবে না। পরিখা অতিক্রম করে মদিনা জয় করা অসম্ভব। আর দীর্ঘমেয়াদী অবরোধ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তার কোনো প্রস্তুতিই সম্মিলিত বাহিনীর নেই। বনু নাদির গোত্রপতি হুয়াই ইবনে আখতাব নতুন কৌশল নিয়ে আবু সুফিয়ানকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন। বনু কোরাইজাকে মুসলমানদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তাহলে মদিনার দক্ষিণে বনু কোরাইজার স্থান দিয়ে সম্মিলিত বাহিনী মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে। 

যেই ভাবা সেই কাজ। হুয়াই বনু কোরাইজা গোত্রপতি কাব ইবনে আসাদ-এর সাথে দেখা করল। কাব প্রথম হুয়াই-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও শেষ পর্যন্ত প্রলোভনে পড়ে গেল। হুয়াই তাকে বোঝাল, মুসলমানদের শেষ করার এটাই উপযুক্ত সময়। এত বড় সুযোগ আগে কখনো আসে নি। সম্মিলিত বাহিনীর শক্তি ও লক্ষ্য সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা দিয়ে সে বলল, বিজয়ীপক্ষেই তোমার থাকা উচিত। হুয়াই-এর প্রলোভনে বনু কোরাইজা বিশ্বাসঘাতকতার ফাঁদে পা দিল। তারা মুসলমানদের সাথে মৈত্রীচুক্তি বাতিল করল। সম্মিলিত বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে হামলার প্রস্তুতি নিতে সময় নিল ১০ দিন।

আর বলল, এর মধ্যে কোরাইশ ও গাতাফানরা যেন ক্রমাগত হামলা চালিয়ে মুসলমানদের ব্যাপক চাপের মুখে রাখে। তারা যেন বনু কোরাইজার দিকে কোনো দৃষ্টি দিতে না পারে। মুসলমানদের সাথে বনু কোরাইজার মৈত্রীচুক্তি বাতিল করায় মদিনার পুরো সামরিক সমীকরণ বদলে গেল। দক্ষিণের প্রতিরক্ষা সবটাই নির্ভর করছিল তাদের ওপর। আর দক্ষিণভাগের মোটামুটি সুরক্ষিত ঘরগুলোতেই আশ্রয় নিয়েছিল মুসলিম নারী ও শিশুরা। মুসলমানদের সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত হানার জন্যে ইহুদিদের একটা দল তৈরি হলো। একজনকে পাঠালো চর হিসেবে সবকিছু পর্যবেক্ষণের জন্যে। সে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে মুসলিম এলাকায় ঢুকে পড়ল।

নবীজীর ফুফু সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন নারী ও শিশুসহ দক্ষিণ মদিনায় হাসান ইবনে সাবিতের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘরের ছাদ থেকে তিনি এই ইহুদির গতিবিধি লক্ষ্য করলেন। হাসানকে তিনি বললেন, ‘দেখ এ নির্ঘাত চর। সবকিছু দেখে সে ওদের জানাবে। তারপরই ওরা আমাদের ওপর হামলা করবে। এক কাজ করো, তুমি তলোয়ার নিয়ে যাও এবং ওকে হত্যা করো।’ হাসান খুব বিব্রতভাবে জবাব দিল, ‘হে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। আমি যোদ্ধা নই। অস্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত নই। আমি একজন কবি। আমি কথার মালা গাঁথি।’

সাফিয়্যা তখন নিজেই ছাদ থেকে দ্রুত গতিতে নেমে তাঁবুর খুঁটি নিয়ে লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে সর্বশক্তি দিয়ে মাথায় আঘাত করলেন। প্রচণ্ড আঘাতে দ্রুতই মৃত্যুবরণ করল সে। সাফিয়্যা ওপরে উঠে এসে হাসানকে বললেন, ‘যাও এবার তুমি তার বর্মটি খুলে নিয়ে আসো। কারণ পুরুষদের পোশাক খোলা কোনো মহিলার জন্যে শোভন নয়।’ হাসান এটাতেও অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘কবির কোনো বর্মের প্রয়োজন নেই।’ তবে এই ছোট্ট ঘটনায় দক্ষিণের রণাঙ্গনের কার্যত ইতি ঘটে।

বনু কোরাইজা ধরে নিল যে, তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার এবং নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্যে মুসলিম বাহিনী প্রস্তুত হয়ে আছে। তারা এদিকে আর কোনো আক্রমণ চালায় নি। অবরোধ সমাপ্তির পর সাফিয়া একজন পুরুষ সৈনিকের সমপরিমাণ পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। বনু কোরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার খবর যখন নবীজীর কাছে পৌঁছল, তখন তিনি সাদ ইবনে মুয়াজের নেতৃত্বে চার জনের একটি প্রতিনিধি দল পাঠালেন আসল খবর সংগ্রহের জন্যে। তারা ফিরে এসে আসল খবর জানালেন। নবীজী একটি চাদর জড়িয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। ধ্যান শেষে তিনি উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, ‘আল্লাহ মহান! হে মুসলমানরা শোনো! আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর সাহায্য ও বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছেন!’

ইহুদি নেতা হুয়াই কোরাইশ শিবিরে গিয়ে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে বনু কোরাইজার যোগদানের কথা জানালে তাদের মধ্যে আনন্দ-হিল্লোল সৃষ্টি হলো। কোরাইশরা পরিখার ওপর চাপ বাড়িয়ে দিল। বাহিনী অদলবদল করে আক্রমণ পরিচালনা অব্যাহত রাখল। রাতে বিশাল বিশাল আগুন জ্বেলে মুসলমানদের অন্তরে আতঙ্ক বিস্তারের চেষ্টা করল। হঠাৎ করেই সবচেয়ে জোরালো আক্রমণ হলো নবীজীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে। তিনি পরিখার কাছে একটি ছোট্ট টিলায় তাঁবু লাগিয়ে অবস্থান করছিলেন। তিনি এবং তাঁর সাহাবীরা অসীম সাহসিকতার সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে লাগলেন। লড়াই সারাদিন পার হয়ে রাতে গড়াল। নবীজী ও সাহাবীরা জোহর আসর মাগরিব নামাজ পড়ার সুযোগ পেলেন এশার সময়। তীব্র হামলা অব্যাহত থাকল দিনের পর দিন। অপরদিকে দক্ষিণ প্রান্তে বনু কোরাইজারও সাজসাজ রব। মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক বিস্তারের উদ্দেশ্যে।

কোরআনে তখনকার অবস্থার বর্ণনা
সূরা আহজাবে তখনকার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার চমৎকার বিবরণ এসেছে: ‘(স্মরণ করো!) শত্রুবাহিনী যখন ওপর ও নিচ, দুদিক থেকেই তোমাদের ওপর হামলা করল, তখন তোমাদের চোখ হয়েছিল বিস্ফারিত, প্রাণ হয়েছিল ওষ্ঠাগত আর আল্লাহ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী ভাবনায় মন হয়েছিল আচ্ছন্ন। আসলে বিশ্বাসীরা তখন পড়েছিল গুরুতর পরীক্ষায়, হয়েছিল আতঙ্ক কম্পিত। আর মুনাফেকরা, যাদের অন্তরই রুগ্ণ, তারা (একে অপরকে) বলেছিল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।’ আর ওদের আরেক দল বলেছিল, ‘হে মদিনাবাসীরা! তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করতে পারবে না, তাই ঘরে ফিরে যাও!’ এরপর এদের মধ্যে একটি দল এসে নবীর কাছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে বলল, ‘আমাদের ঘরবাড়ি অরক্ষিত (অতএব যাওয়ার অনুমতি দিন)।’ 

অথচ তাদের ঘরবাড়ি অরক্ষিত ছিল না। রণক্ষেত্র থেকে পালানোই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যদি চারদিক থেকে শত্রুরা মদিনায় ঢুকতে পারত, তাহলে এ মুনাফেকদের সাথে মিলিত হওয়ার পর ওদেরকে বিদ্রোহের উসকানি দিলে ওরা তখনই বিদ্রোহ করে বসত। অথচ ওরাই পূর্বে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, ওরা কখনো (রণক্ষেত্র থেকে) পালাবে না। আল্লাহর সাথে করা এই অঙ্গীকারের জবাব অবশ্যই ওদের দিতে হবে।’ (সূরা আহজাব : ১০-১৫) 

‘আল্লাহ ও মহাবিচার দিবস সম্পর্কে যারা সচেতন এবং আল্লাহকে যারা বেশি বেশি স্মরণ করে, নিশ্চয়ই তাদের জন্যে আল্লাহর রসুলের মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। বিশ্বাসীরা শত্রুবাহিনীকে দেখেই বলে উঠল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসুল সত্য বলেছিলেন।’ এ ঘটনায় তাদের বিশ্বাস ও আনুগত্য আরো বেড়ে গেল।’ (সূরা আহজাব : ২১-২২)

‘তোমরা কি মনে করো, তোমরা কোনো পরীক্ষা ছাড়া এমনি এমনি জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমরা তো এখনো পূর্ববর্তীদের মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হও নি? তোমাদের পূর্ববর্তী বিশ্বাসীরা অভাব, কষ্ট, বিপদ, মুসিবত এবং অত্যাচার-নির্যাতনে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল যে, নবীসহ তারা আর্তনাদ করে বলেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য সবসময় খুবই কাছে।’ (সূরা বাকারা : ২১৪)

শত্রু বিভাজনের নীতি, কিন্তু মতামত নেয়ার পর গাতাফানদের সাথে আলাদা সমঝোতার উদ্যোগ পরিত্যক্ত হলো বনু কোরাইজা সম্মিলিত বাহিনীতে যোগ দেয়ায় যে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে নবীজী শত্রু বিভাজনের নীতি অনুসরণের উদ্যোগ নিলেন। তিনি শক্তিশালী গাতাফান গোত্রকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলেন কোরাইশদের থেকে। তিনি তাদের দুই গোত্রপ্রধান উয়াইনা ইবনে হিসন এবং আল হারিস ইবনে আউফকে প্রস্তাব পাঠালেন যে, তারা তাদের বাহিনী নিয়ে ফিরে গেলে মদিনায় বার্ষিক উৎপাদিত খেজুরের এক-তৃতীয়াংশ তাদের দেয়া হবে। তারা রাজি হলো।

গাতাফানের সাথে চুক্তি চূড়ান্ত করার আগে নবীজী আনসারদের নেতা সাদ ইবনে মুয়াজ ও সাদ ইবনে উবাদাকে ডাকলেন পুরো বিষয়ে তাদের মতামত জানার জন্যে। সাদ বিনয়ের সাথে পরিষ্কার বললেন, গাতাফানদের খেজুর দেয়ার চেয়ে আমরা অস্ত্র দিয়েই মোকাবেলা করতে চাই। গাতাফানদের সাথে আলাদা সমঝোতার উদ্যোগ পরিত্যক্ত হলো।

যখন আশার ক্ষীণ আলোও নিভে যায় ধৈর্যশীলদের জীবনে, আল্লাহর সাহায্য তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অবরুদ্ধ বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে গাতাফানদের অন্যতম নেতা নুয়াইম ইবনে মাসুদ গোপনে মুসলিম শিবিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। নুয়াইম নবীজীকে বললেন, আমি আপনার জন্যে কাজ করতে চাই। নবীজী তাকে বললেন, তুমি আমাদের সাথে যোগ দিলে আমাদের সংখ্যা একজন বাড়বে। আর তুমি যদি শত্রুদের যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে পারো, তবে তা হবে অনেক বড় কাজ। জানো তো যুদ্ধ হচ্ছে আসলে কৌশল। নুয়াইম বুদ্ধিমান। আলাপচারিতায় দক্ষ। বন্ধুবৎসল। গাতাফান গোত্রের হলেও কোরাইশ ও ইহুদি অভিজাত মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা অনেক।

এক বছর আগেও নুয়াইম আবু সুফিয়ানের চর হিসেবে মদিনায় এসে মুসলমানদের দ্বিতীয় বদর অভিযাত্রা থেকে নিবৃত্ত রাখার প্ররোচনায় লিপ্ত ছিল। নুয়াইম যেমন গোপনে নবীজীর কাছে এসেছিলেন, তেমনি গোপনে প্রবেশ করলেন বনু কোরাইজা শিবিরে। নেতাদের সাথে তার ছিল দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের সুবাদে জমে উঠল আলোচনা। অবস্থা বুঝে তিনি বললেন, ‘দেখ কোরাইশ ও গাতাফান আর তোমাদের অবস্থান এক নয়। মদিনা তোমাদের শহর। তোমাদের সবকিছুই এখানে। কোরাইশ ও গাতাফানরা এসেছে মুসলমানদের বিনাশ করতে। কিন্তু তাদের স্ত্রী পুত্র সম্পত্তি সবই অন্যত্র। জয় হলে তো ভালো কথা। কিন্তু যদি কোনো কারণে পরিস্থিতি বিরূপ হয় তবে তারা চলে যাবে। তখন মুসলমানদের সকল আক্রোশের শিকার হবে তোমরা। তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে, কোরাইশ ও গাতাফানদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে তোমাদের নিকট জিম্মি হিসেবে না পাওয়া পর্যন্ত তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে নামবে না। নেতৃস্থানীয়দের জিম্মি হিসেবে পেলে তোমরা নিশ্চিত থাকতে পারবে যে, কোরাইশরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়বে।’

কোরাইজা গোত্রপতিরা নুয়াইমের পরামর্শকে যথার্থ মনে করে তাকে ধন্যবাদ দিল। ইহুদি শিবির থেকে নুয়াইম সরাসরি কোরাইশ শিবিরে গেলেন। আবু সুফিয়ানের কাছে সূত্র গোপন রাখার অঙ্গীকার নিয়ে খুব গোপন খবর জানালেন যে, ‘বনু কোরাইজা মুহাম্মদের সাথে চুক্তি-লঙ্ঘন করায় অনুতপ্ত। তারা নিয়মিত মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। তারা তাদের বিশ্বস্ততার প্রমাণ হিসেবে কোরাইশ ও গাতাফানদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মুসলমানদের হাতে তুলে দিতে চায়। আমার এ কথার প্রমাণ হচ্ছে- আগামী শনিবার যখন আপনি তাদের যুদ্ধের আহ্বান জানাবেন, তখন তারা যুদ্ধে যেতে গড়িমসি করবে এবং আপনাদের আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে কয়েকজন নেতাকে জিম্মি হিসেবে চাইবে। জিম্মিরা কোরাইজা শিবিরে যাওয়া মাত্র তাদেরকে তারা মুসলমানদের কাছে হস্তান্তর করবে। অতএব সাবধান!’ নুয়াইম গাতাফান নেতাদেরও একই তথ্য দিলেন।

নুয়াইম খুব সফলভাবেই এই ত্রিপক্ষীয় জোটে বিভেদের বীজ বপন করতে সক্ষম হলেন। প্রত্যেকপক্ষই এখন প্রত্যেকের অভিপ্রায় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাচ্ছে। কোরাইশ ও গাতাফানরা যখন চূড়ান্ত আক্রমণের দিন ঠিক করে কোরাইজাকে যুদ্ধে অংশ নেয়ার আহ্বান জানালো, তখন সাবাথ হওয়ায় শনিবার তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকার করল। আর যুদ্ধে কোনো অঘটন ঘটলে তারা যে কোরাইজাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা হিসেবে জিম্মি দাবি করল। তখন নুয়াইমের দেয়া তথ্যের সত্যতার ব্যাপারে কোরাইশ ও গাতাফানদের আর কোনো সন্দেহ রইল না। 
তারা পুনরায় কোরাইজাকে খবর পাঠালো জিম্মি ছাড়াই যুদ্ধ শুরু করার। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়তে লাগল। তারা তাদের মনোবল ও নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলল। অবরোধের ২৭ রজনী পার হওয়ার পর প্রকৃতিও আক্রমণকারীদের জন্যে হয়ে উঠল বিরূপ। ২৮তম রজনীতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি আর কনকনে ঠান্ডা বাতাস। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে কানে তালা লাগার অবস্থা। অবরোধকারীদের আগুন নিভে গেল। হাঁড়িপাতিল গড়াগড়ি খেতে লাগল। গবাদি পশু মারা গেল। বহু তাঁবু ছিঁড়ে গেল বা উড়ে গেল। প্রচণ্ড ঠান্ডায় সৈনিকরা একজন আরেকজনকে জড়াজড়ি করে কাঁপতে লাগল। বিরূপ প্রকৃতিকে অশুভ লক্ষণ ভাবায় হতাশ আবু সুফিয়ান কোরাইশদের তাঁবু গোটাতে বলে উটের পিঠে উঠে বসলেন। কোরাইশরা ফেরত যাত্রা শুরু করল। কোরাইশদের দেখাদেখি গাতাফান ও অন্যান্য গোত্রও সূর্যোদয়ের অনেক আগেই অবরোধ তুলে চলে গেল।

কোরআনে বিষয়টি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে: ‘হে বিশ্বাসীগণ! স্মরণ করো! তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা! শত্রুবাহিনী যখন তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন আমি ওদের বিরুদ্ধে ঘূর্ণিঝড় ও অদৃশ্য বাহিনী পাঠিয়েছিলাম। আসলে তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখেন।’ (সূরা আহজাব : ৯)

ভোরবেলা সাহাবীদের নিয়ে নবীজী যখন শত্রুর পরিত্যক্ত শিবিরে গিয়ে দাঁড়ালেন কৃতজ্ঞতায় তাঁর হৃদয় উথলে উঠল। তিনি স্পষ্টতই বুঝলেন আল্লাহর অশেষ করুণায় এমন অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। বাস্তব সত্যকেও তিনি উপলব্ধি করলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘এটাই কোরাইশদের শেষ আক্রমণ। ওরা কোনোদিনই আর আমাদের আক্রমণ করতে আসবে না। ওদের ঘাঁটিতে এরপর আমরাই যাব।’ 

কোরাইশ ও তাদের মিত্রদের সম্মিলিত বাহিনী ভোর হওয়ার আগেই রণাঙ্গন ত্যাগ করেছে। মাসব্যাপী অবরোধ ও ক্রমাগত সংঘর্ষে ক্লান্তশ্রান্ত মুসলমানরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যার যার ঘরে ফিরে গেছে। গোসল-টোসল করে হয়তো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এদিকে দুপুর হতেই নবীজী ঘোষণা দিলেন, দ্রুত তৈরি হও এবং যাত্রা করো। বনু কোরাইজার দুর্গদ্বারে গিয়ে আসর নামাজ পড়বে। তিন হাজার সৈন্য যুদ্ধ যাত্রা করল। কিন্তু তারা গন্তব্যে পৌঁছার আগেই সূর্য অস্তমিত হতে শুরু করল। 

সাহাবীরা দ্বিধায় পড়লেন। যদি তারা নবীজীর নির্দেশ পালন করতে যান, তবে নির্ধারিত সময়ে নামাজ পড়তে পারবেন না। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনায় দ্বিমত সৃষ্টি হলো। এক অংশ নির্ধারিত সময়ে যাত্রা থামিয়ে নামাজ পড়ে তারপর গন্তব্যের দিকে ছুটলেন। অপর অংশ গন্তব্যে পৌঁছে তারপর নামাজ পড়লেন। সাহাবীরা নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ব্যাখ্যাটা সঠিক ছিল। নবীজী দুটো ব্যাখ্যাই ঠিক বলে গ্রহণ করলেন। ভবিষ্যত মুসলিম উম্মাহর জীবনে এই দৃষ্টিভঙ্গির সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। একটি অংশ নবীজীর বাণী ও নির্দেশকে আক্ষরিক অর্থেই পালনে আগ্রহী। আর অপর অংশ বাণী ও নির্দেশের উদ্দেশ্য ও অন্তর্নিহিত লক্ষ্য এবং বিশেষ প্রেক্ষাপটের আলোকে করণীয় নির্ধারণ ও অনুসরণ করে। নবীজীর দৃষ্টান্তের আলোকে তাঁর শিক্ষার অনুসারী হওয়ার জন্যে দুটো প্রক্রিয়াই অনুমোদিত ও সঠিক।

বনু কোরাইজার দুর্গদ্বারে আসরের নামাজ পড়ার নির্দেশ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রু কোনোরকম সতর্কতা বা প্রস্তুতি নেয়ার আগেই উপস্থিত হয়ে তাদের বিভ্রান্ত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়া। হলোও তা-ই। বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ মুসলমানরা নেবে এ ব্যাপারে বনু কোরাইজাও নিশ্চিত ছিল। কিন্তু একমাস অবরুদ্ধ ও যুদ্ধরত থাকার পর সপ্তাহখানেক বিশ্রাম না নিয়ে সকালে ঘরে ফিরে দুপুরেই যুদ্ধযাত্রা, এটা তারা ভাবতেই পারে নি। তাছাড়া কোরাইশ ও গাতাফানদের নীরবে মদিনা ত্যাগের খবরও তাদের কাছে পৌঁছে নি। 

মুসলমানদের উপস্থিতি দেখে বনু কোরাইজা প্রথমে মনে করেছিল রণক্ষেত্র থেকে কিছু সংখ্যক সৈনিককে পাঠানো হয়েছে তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে। প্রথমে বনু কোরাইজার লোকজন রসুলসহ মুসলমানদের অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিল। আস্তে আস্তে যখন তারা দেখল বিশাল বাহিনী, তাদের চোখে-মুখে নেমে এলো আতঙ্কিত নিস্তব্ধতা। দ্রুত দুর্গের ভেতরে আশ্রয় নিল তারা। ২৫ দিন অবরোধের পর বনু কোরাইজা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল। নবীজী কোরাইজা পুরুষদের একপাশে এবং নারী ও শিশুদের আরেক পাশে দাঁড় করানোর নির্দেশ দিলেন।

কোরাইজাদের পূর্বতন মিত্র আউসরা নবীজীর কাছে কোরাইজাদের জন্যে ক্ষমা ও দয়ার আবেদন জানাল। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে যদি বনু কোরাইজা ও আমার মধ্যে ফয়সালা করার দায়িত্ব দেই, তাহলে কি তোমরা খুশি হবে?’ তারা একবাক্যে সম্মতি জানাল। তারপর কোরাইজাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা আউসদের মধ্য থেকে কাকে সালিশ মানবে?’ তারা আউস নেতা সাদ ইবনে মুয়াজের নাম বলল। সাদ ইবনে মুয়াজ এলেন। তিনি যখন নবীজীর তাঁবুতে প্রবেশ করলেন, তখন নবীজী সবাইকে দাঁড়িয়ে নেতাকে সম্মান প্রদর্শন করতে বললেন। সবাই দাঁড়িয়ে সাদকে সম্মান প্রদর্শন করলেন। এরপর নবীজী তাকে ফয়সালার দায়িত্ব দিলেন।

সাদ তখন প্রথমে মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলেন যে, সবাই তার রায়ই চূড়ান্ত বলে মেনে নেবে। একইভাবে কোরাইজারাও প্রতিশ্রুতি দিল যে, তারা সাদের রায়ই চূড়ান্ত বলে মেনে নেবে। আউস নেতা সাদ এরপর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে তাওরাতের বিধান উল্লেখ করে রায় ঘোষণা করলেন, যুদ্ধলিপ্ত কোরাইজাদের মৃত্যুদণ্ড এবং তাদের পরিবারকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে গণ্য করা হবে। রায় সেভাবেই কার্যকর করা হলো।

কোরাইজার দণ্ডপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের মদিনায় ওসামা ইবনে জায়েদের বাড়িতে আটক রাখা হয় আর তাদের পরিবারের নারী ও শিশুদের আটক রাখা হয় কাইয়াসা বিনতে আল হারিসের বাড়িতে। ১৫০০ তরবারি, ২০০০ বল্লম, ৩০০ বর্ম, ১৫০০ ঢাল এবং সকল অস্থাবর সম্পত্তি মদিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও সীরাতকার আল ওয়াকিদি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। সাদ ইবনে মুয়াজের দণ্ডাদেশ অনুসারে হুয়াই ইবনে আখতাব, কাব ইবনে আসাদ, আল জুবায়ের ইবনে বাতা, গাজ্জাল ইবনে সামুয়েল, নাব্বাস ইবনে কায়েস, ওহাব ইবনে জায়েদ, উকবা ইবনে জায়েদসহ কোরাইজার মোট ২৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

খন্দকের অবরোধের পাঁচ মাস পর জায়েদ ইবনে হারিসার নেতৃত্বে ১৭০ জনের বাহিনী সিরিয়া থেকে ইরাকের পথ ধরে মক্কায় প্রত্যাবর্তনকারী সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করলেন। সব মালামালসহ কয়েকজন কোরাইশকে আটক করে মদিনায় নিয়ে এলেন। নবী তনয়া জয়নবের স্বামী আবু আল আস কাফেলায় থাকলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। তিনি মক্কার দিকে না গিয়ে সবার অগোচরে রাতের অন্ধকারে মদিনায় জয়নব ও কন্যা উমামার গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।  পরদিন নবী তনয়া জয়নব ফজর নামাজের শেষে মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, আমি আবু আল আস ইবনে আল রাবীকে সুরক্ষা প্রদান করেছি। সে এখন আমার আশ্রয়ে আমার ঘরে অতিথি হিসেবে অবস্থান করছে।

নবীজী তার কন্যার তরফ থেকে প্রদত্ত সুরক্ষাকে আমলে গ্রহণ করলেন কিন্তু বললেন, ‘যেহেতু আবু আল আস ইসলাম গ্রহণ করে নি, তাই তাদের বিয়ে অকার্যকর।’ বাণিজ্য কাফেলা থেকে আটককৃত মালামালের মধ্যে একটা অংশ ছিল আবু আল আসের দায়িত্বে। জয়নব মালামালের সেই অংশ তাকে ফেরত দেয়ার আবেদন জানালেন। সাহাবীরা জয়নবের আবেদনে সাড়া দিলেন। আবু আল আস মক্কায় গিয়ে লাভসহ সব মালামাল মালিকদের বুঝিয়ে দিলেন। এরপর সুযোগমতো মদিনায় ফিরে ইসলাম গ্রহণ করে জয়নবের সাথে পুনরায় দাম্পত্য জীবন শুরু করলেন।

এনএস/