ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

হুদায়বিয়া: নবীজীর অহিংস নীতির ঐতিহাসিক সাফল্য

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৫২ পিএম, ২৪ মে ২০২০ রবিবার

[পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে। 

প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। 

সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। নবম পর্বে জেনেছেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান। দশম পর্বে আপনারা জেনেছেন বিপর্যয় থেকে বিজয়ে উত্তরণের কাহিনী। একাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন- হাজার বছরের শোষণের অবসান ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের বিবরণ। দ্বাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন সাহস ও সমঝোতায় বিজয়ের বিবরণ ও মুনাফেকদের অপপ্রচারের ব্যর্থতার কাহিনী। ত্রয়োদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন নবীজীর (স) কৌশলের কাছে কোরাইশদের পরাজয়ের বিবরণ। এবার চতুর্দশ পর্বে আপনারা জানবেন হুদায়বিয়া- নবীজীর (স) অহিংস নীতির ঐতিহাসিক সাফল্যের বিবরণ।]

স্বপ্ন দেখলেন নবীজী। প্রাণ জুড়ানো স্বপ্ন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা মক্কায় কাবা শরিফে ওমরাহ করছেন। কেউ চুল ন্যাড়া করেছে। কেউ চুল ছেঁটেছে। শত্রুর কোনোরকম ভয় ছাড়া, পথে কোনোরকম বাধা ছাড়াই তারা ওমরাহ পালন করেছেন। এমন স্বপ্ন দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন সাহাবীদের কাছে। শুনে তারাও খুব খুশি। কারণ নবীদের স্বপ্ন সবসময় সত্য হয়। তাঁদের স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়। তাঁদের স্বপ্ন হচ্ছে- আগাম সুখবর অথবা সতর্কবাণী।

নবীজী জিলকদ মাসে ওমরাহর ঘোষণা দিলেন। মদিনা ও তার আশেপাশের মুসলমানদের মধ্য থেকে আগ্রহী ১৪০০ জনকে নিয়ে শুরু করলেন ওমরাহের উদ্দেশ্যে যাত্রা। নবীজীর এ সফরে তাঁর সফরসঙ্গী হলেন উম্মে সালামা। মক্কার নিকটবর্তী জুল হুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছলে নবীজী কোরবানির পশু ৭০টি উটকে মালা পরাতে বললেন। আর বিশ্বাসীরা সবাই এহরাম বেঁধে ফেললেন।

তিনি সামনে বাশর ইবনে সুফিয়ানকে প্রেরণ করলেন শত্রুপক্ষের তথ্য সংগ্রহের জন্যে। তারা খবর দিল, মক্কার কাছাকাছি কয়েকটি গোত্র পথরোধ করে অবস্থান করছে। আর কোরাইশপক্ষে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ ও ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল ২০০ অশ্বারোহী নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেছে আক্রমণ চালানোর জন্যে। সংঘাত এড়ানোর জন্যে নবীজী বিশ্বাসীদের নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথে কাফেলার গতি পরিবর্তন করলেন। হুদায়বিয়ার উপত্যকায় কাফেলা পৌঁছার পর নবীজীর উট কাসওয়া হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মক্কা থেকে হুদাইবিয়া মাত্র একদিনের পথ। হুদাইবিয়ার এক অংশ পবিত্র এলাকায়। আর অপর অংশ পড়েছে সাধারণ এলাকায়।

সাহাবীরা অনেক চেষ্টা করেও উটকে দাঁড় করাতে পারলেন না। তখন নবীজী বললেন, আসলে যে শক্তি আবরাহার হাতিকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করেছিল, সেই একই শক্তি কাসওয়াকে বসতে বাধ্য করেছে। অতএব সেখানেই তাঁবু ফেলা হলো। কাফেলা তাঁবু ফেলার পর শুভাকাঙ্ক্ষী ও মিত্রস্থানীয় খুজাহ গোত্রের লোকজন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করতে শুরু করল।

খুজাহ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বুদায়েল ইবনে ওয়ারাকা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তিনি দ্রুত হুদায়বিয়ায় এসে নবীজীকে সতর্ক করলেন যে, কোরাইশরা কোনো অবস্থায়ই মুসলমানদের কাবায় প্রবেশ করতে দেবে না। এটা তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। নবীজী তাকে শান্তির বাণী দিয়ে মক্কায় ফেরত পাঠালেন। বললেন, তাদেরকে বলো, ‘আমরা যুদ্ধ করতে আসি নি। আমরা কাবাঘর তাওয়াফ করার জন্যে এসেছি। কেউ আমাদের পথরোধ করলে আমরা অবশ্যই লড়ব। তবে তারা যদি মনে করে সতর্কতা অবলম্বন ও পথ পরিষ্কার করে দেয়ার জন্যে সময় প্রয়োজন, তবে আমরা অবশ্যই সময় দেবো।’ 

কোরাইশরা এ বার্তাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে বেদুইন নেতা হুলাইস ইবনে আলকামাহকে হুদায়বিয়ায় পাঠাল। ফিরে এসে তিনি কোরাইশদের কাছে বুদাইলের কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন। কোরাইশ নেতাদের কাছে তার বক্তব্য মনঃপূত হলো না। তাদের কটু কথার প্রত্যুত্তরে হুলাইস হুমকি দিলেন, মুসলমানদের যদি কাবা তাওয়াফ করতে না দেয়া হয়, তবে মক্কার সাথে বেদুইনদের মৈত্রী বাতিল হয়ে যাবে।

কোরাইশরা এরপর মক্কায় অবস্থানকারী তায়েফের সাকীফ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উরউয়াহ ইবনে মাসুদকে প্রেরণ করলেন। তিনি ফেরত গিয়ে কোরাইশদের বললেন, ‘আমি রোমান সম্রাট, পারস্য সম্রাট ও নাজ্জাসির দেশে গিয়েছি। কিন্তু মুহাম্মদকে যেভাবে তার অনুসারীরা ভালবাসে, তেমন ভালবাসা সেই সব দেশের সম্রাটরা কখনো প্রজাদের কাছ থেকে পান নি। তোমরা নিশ্চিত থাকতে পারো, মুহাম্মদের অনুসারীরা কখনোই তাঁকে ছেড়ে যাবে না। তাঁর প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত। এখন তোমরা যা-ইচ্ছা করতে পারো।’

মক্কার চরমপন্থীরা নবীজীর শান্তিপূর্ণ অভিযাত্রায় অশান্তি সৃষ্টির জন্যে ৫০ জনের একটি দলকে হুদায়বিয়ায় প্রেরণ করল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের দুয়েকজনকে অপহরণ করে মক্কায় নিয়ে যাওয়া। কিন্তু রাতের আঁধারে মুসলিম শিবিরে এসে উল্টো তারা সবাই বন্দি হয়ে গেল। বন্দিদের নবীজীর সামনে হাজির করা হলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দিলেন। ফেরত পাঠিয়ে দিলেন মক্কায়। নবীজী এবার তাঁর তরফ থেকে দূত হিসেবে খুজাহ গোত্রের খাররাশ ইবনে উমাইয়াকে প্রেরণ করলেন। কোরাইশরা চিরায়ত রীতি লঙ্ঘন করে তার উটকে জবাই করল এবং খাররাশকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। তবে হাবাসী গোত্রের হস্তক্ষেপে তিনি বেঁচে গেলেন এবং নবীজীর কাছে ফিরে এলেন।

তখন নবীজী মনে করলেন, গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাহাবীকে শান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করলে হয়তো আলোচনায় অগ্রগতি হবে। নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সাথে আলোচনার পর নবীজী শান্তির দূত হিসেবে উসমানকে মক্কায় প্রেরণ করলেন। তিনি কোরাইশ নেতাদের সুস্পষ্টভাবে বললেন, মুসলমানরা শুধু ওমরাহ পালনের জন্যে এসেছে। তাদের অন্য কোনো অভিপ্রায় নেই। কাবার রক্ষক হিসেবে এই ব্যবস্থা করে দিলে আরবদের মধ্যেই কোরাইশদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। কিন্তু কোরাইশরা তাদের নেতিবাচক সিদ্ধান্তে অটল রইল। কোরাইশদের সাথে উসমানের আলোচনা অব্যাহত থাকল তিন দিন।

এদিকে কোরাইশদের মধ্যেই যারা গোপনে ইসলাম গ্রহণ করে মক্কাতেই বসবাস করছিল, তাদের অনেকের সাথেই তার যোগাযোগ স্থাপিত হলো। একথা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরই উসমানকে তারা গ্রেফতার করল। এরপর গুজব ছড়িয়ে যায় যে, উসমানকে হত্যা করা হয়েছে। উসমানের নিহত হওয়ার গুজব হুদায়বিয়ার প্রান্তরে পৌঁছলে মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। উসমানের দীর্ঘ অনুপস্থিতি এ গুজবকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল। নবীজী (স) অনুভব করলেন, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে কোরাইশদের ওপর মানসিক চাপ আরো বাড়াতে হবে। তাছাড়া তিনি এক আত্মিক তাগিদ অনুভব করলেন সবাইকে নতুন করে আত্মত্যাগের শপথের ডাক দেয়ার।

তিনি একটি একাশিয়া গাছের নিচে দাঁড়ালেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে এক এক করে সবাই তাঁর হাতের ওপর হাত রেখে বায়াত বা শপথ করলেন যে, ‘নিশ্চিত মৃত্যু হবে জানার পরও আমি রণক্ষেত্র থেকে পালাব না। নিহত না হওয়া পর্যন্ত আপনার জন্যে লড়াই করে যাব।’ আত্মত্যাগের এই শপথই ইতিহাসে পরিচিত হয় ‘বায়াত-এ রিদওয়ান’ নামে। যখন এই বায়াতের অর্থ সাহাবীদের জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তারা একবাক্যে বললেন, ‘মৃত্যু’।

এই বায়াতে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ আয়াত নাজিল করলেন: ‘হে নবী! যারা তোমার কাছে বায়াত অর্থাৎ আনুগত্যের শপথ নিচ্ছিল, তারা আল্লাহর কাছেই আনুগত্যের শপথ নিচ্ছিল। (তারা যখন তোমার হাতের ওপর হাত রেখেছিল তখন) তাদের হাতের ওপর ছিল আল্লাহর হাত। অতএব যে এ শপথ ভাঙবে সে এর পরিণাম ভোগ করবে। আর যে শপথ রক্ষা করবে আল্লাহ তাকে মহাপুরস্কারে সম্মানিত করবেন।’ (সূরা ফাতাহ : ১০)

‘আল্লাহ বিশ্বাসীদের ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা (হে মুহাম্মদ!) তোমার কাছে গাছের নিচে বায়াত অর্থাৎ আনুগত্যের শপথ করছিল। তাদের অন্তরের অবস্থা তিনি জানতেন। তাই তিনি তাদের অন্তরে নাজিল করলেন প্রশান্তি আর পুরস্কার হিসেবে দিলেন আসন্ন বিজয়।’ (সূরা ফাতাহ : ১৮)

বায়াতের কিছু পরে উসমান এসে হাজির হলেন। মুসলমানরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। উত্তেজনার আপাত অবসান ঘটল। উসমান কোরাইশদের অনড় নেতিবাচক অবস্থানের কথা উল্লেখ করলেন। অপরদিকে মুসলমানদের লড়াই ও জীবন বিসর্জন দেয়ার শপথের ঘটনা প্রবীণ কোরাইশ নেতাদের মধ্যে নতুন উৎকণ্ঠার জন্ম দিল। মক্কার নেতৃত্বে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক কম্পন সৃষ্টি করল। তারা বুঝতে পারল মুসলমানরা এমনি এমনি চলে যাবে না। তাদের অস্থিরতার কারণ প্রথমত, এর আগে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে তারা কখনো বিজয়ের স্বাদ পায় নি। দ্বিতীয়ত, যদি এবার যুদ্ধে বিজয় হয়ও, তবুও পবিত্র মাসে পবিত্র স্থানে রক্তপাত আরবভূমিতে কোরাইশদের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। বেদুইন গোত্রগুলোয় অসন্তোষ ছড়িয়ে যাবে।

স্বার্থচিন্তাই অবশেষে কোরাইশদের বাধ্য করল আপসরফা করার জন্যে সুহাইল ইবনে আমর আল আমিরির নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করতে। এ দলের অপর দুজন হলেন মিকরাজ ইবনে হাফস এবং হুয়াইতির ইবনে আবদ-আল উয্যা। নবীজী তাদের সবাইকে স্বাগত জানালেন। আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ সুহাইল যে শর্তই দিচ্ছিলেন নবীজী তা সাথে সাথে মেনে নিচ্ছিলেন। শর্ত উপস্থাপনায় সুহাইলের সময় লাগছিল। কিন্তু তা মেনে নিতে নবীজীর কোনো সময় লাগছিল না। কোরাইশ পক্ষের কাছে বিষয়টি যেমন ছিল অপ্রত্যাশিত, মুসলিম শিবিরেও ছিল একই বিস্ময়। কারণ তারা নবীজীকে এত নমনীয় হতে এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবীদের সাথে আলোচনা ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে কখনো দেখেন নি।

দুই পক্ষ দ্রুত সাতটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান: 
১. যুদ্ধবিরতি ১০ বছরের জন্যে। এ সময়ে সবাই শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করবে। কেউ কারো ওপর কোনো ধরনের আক্রমণ করবে না।

২. সুরক্ষাদাতা বা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কোরাইশদের কেউ মুহাম্মদের সাথে যোগ দিলে, তাকে কোরাইশদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

৩. তবে মুহাম্মদের কাছ থেকে কেউ কোরাইশদের কাছে আশ্রয় নিলে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না।

৪. কোনোপক্ষই চুরি, অন্যায় বা বিশ্বাসঘাতকতাকে প্রশ্রয় দেবে না।

৫. যে-কোনো গোত্রই মুহাম্মদ বা কোরাইশদের সাথে মৈত্রী বা শান্তিচুক্তি করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে।

৬. মুসলমানরা এ বছর ওমরাহ না করে এখান থেকেই মদিনায় ফেরত যাবে।

৭. আগামী বছর মুসলমানরা মক্কায় প্রবেশ করে ওমরাহ সম্পাদনের জন্যে মাত্র তিন দিন সময় পাবে। সে সময় তারা কোনো যুদ্ধ সরঞ্জাম বহন করতে পারবে না।

হুদায়বিয়ায় কোরাইশদের সাথে শান্তিচুক্তির পাশাপাশি নবীজী খুজাহ গোত্রের সাথেও তার মৈত্রীচুক্তি নবায়ন করলেন। খুজাহ গোত্র হুদায়বিয়ায় নবীজীর সঙ্গী ওমরাহকারীদের খুবই আন্তরিক সেবাযত্ন করছিল। তবে সাহাবীরা শান্তিচুক্তির শর্তাবলি নিয়ে তখন খুবই হতাশায় ভুগছিলেন আর ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। আর চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই তাদেরকে দিতে হলো ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা। কেননা কোরাইশ নেতা সুহাইলের বিশ্বাসস্থাপনকারী ছেলে আবু জান্দাল হাতে হাতকড়া ও পায়ে শেকল বাঁধা অবস্থায় এসে উপস্থিত হন সে সময়। সুহাইল তাকে শেকল বেঁধে বন্দি করে রেখেছিলেন।

সে কৌশলে পালিয়ে দুর্গম অপ্রচলিত পাহাড়ি পথ ধরে হুদায়বিয়ায় এসে উপস্থিত। ছেলেকে দেখামাত্র সুহাইল রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে মুখে চপেটাঘাত করে জামার কলার ধরে টেনে সামনে নিয়ে এলেন। আবু জান্দাল আর্তনাদ করে সাহাবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘ভাইসব, আমাকে কি অবিশ্বাসীদের হাতে ফেরত দিয়ে দেয়া হবে? তাহলে তো তারা আমাকে বিশ্বাস থেকে দূরে সরিয়ে নিতে আরো নির্যাতন করবে!’ এই কথাগুলো মুসলমানদের অন্তরে গভীরভাবে দাগ কাটল এবং অনেকে কাঁদতে শুরু করলেন। সুহাইল নবীজীকে পরিষ্কারভাবে বললেন, আপনার কথার সত্যতার প্রমাণ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নবীজী বললেন, এখনো তো চুক্তি স্বাক্ষর হয় নি। সুহাইল বলল, কিন্তু শর্তাবলি তো চূড়ান্ত হয়েছে।

নবীজী আবু জান্দালকে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন, ‘সবর করো। নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর সোপর্দ করো। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার ও তোমার অসহায় সাথিদের জুলুম থেকে রেহাই দেবেন এবং মুক্তির পথ করে দেবেন। আমরা যে শান্তিচুক্তি করেছি তাতে আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে তা পালন করার ওয়াদা করেছি। আমরা শপথ লঙ্ঘন করতে পারি না।’ মুসলমানদের অসহায় অশ্রুসিক্ত চোখের সামনে দিয়ে শেকলে বেঁধে কোরাইশরা আবু জান্দালকে মক্কায় ফেরত নিয়ে গেল।

হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তিতে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করলেন আবু বকর, ওমর ইবনে খাত্তাব, আলী ইবনে আবু তালিব, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, মোহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ এবং কোরাইশ নেতা সুহাইলের ইসলাম গ্রহণকারী আরেক পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে সুহাইল। কোরাইশ পক্ষে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করলেন মিকরাজ ইবনে হাফস এবং হুয়াইতিব ইবনে আবদ্-আল উয্যা। 

হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তির শর্ত প্রত্যেকটিই ছিল মুসলমানদের আপাত-বিপক্ষে। ফলে সাহাবীদের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড কষ্ট। কষ্টের প্রভাব কতটা তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর কোরাইশরা চলে গেছে। নবীজী সাথিদের বললেন, ‘হুদায়বিয়া প্রান্তরেই তোমরা ওমরাহর চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করো। তোমরা তোমাদের কোরবানির পশু জবেহ করো এবং মাথা মুণ্ডন করো।’ কিন্তু সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। দ্বিতীয়বারও কোরবানি ও মাথা মুণ্ডনের নির্দেশনায় তারা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তৃতীয়বারও নবীজী একই নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কারো কোনো নড়াচড়া নেই, যেন কেউ কিছু শোনে নি।

নবীজীবনে এরকম ঘটনা এই প্রথম। নবীজী নিজেই এবার আবেগ ভারাক্রান্ত হয়ে নিজের তাঁবুতে ফিরে গেলেন। তাঁবুতে বিবি উম্মে সালামা তাঁর চেহারা দেখেই বুঝতে পারলেন তিনি খুব আবেগ ভারাক্রান্ত। তিনি ব্যথিত হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। নবীজী ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, ‘মুসলমানরা নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা করছে। আমি তাদের নির্দেশ দিলাম, কিন্তু তারা তা পালন করল না।’ উম্মে সালামা সব শুনে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আপনি ওদের ওপর রাগ করবেন না। আসলে পুরো ঘটনায় ওরা খুব মানসিক চাপে ছিল। আর এখন মনে করছে লক্ষ্য অর্জন ছাড়াই তাদের ফেরতযাত্রা করতে হবে। আপনি ফিরে যান। কাউকে কিছু বলবেন না। নীরবে নিজের পশু কোরবানি করুন এবং নিজের মাথা মুণ্ডন করুন।’ নবীজী তাঁবু থেকে বাইরে এলেন। কাউকে কিছু না বলে নিজের উট কোরবানি করলেন। একজনকে ডাকলেন তার মাথা মুণ্ডন করার জন্যে।

নবীজীকে নীরবে কোরবানি দিতে দেখে সাহাবীদের যেন সংবিৎ ফিরে এলো। তারাও দ্রুত কোরবানি দিলেন এবং মাথা মুণ্ডনে একে অপরকে সহযোগিতা করলেন। প্রথমবারেই নবীজীর নির্দেশ অনুসরণ না করায় নিজেরাই অনুশোচনা করতে লাগলেন। সবাই কোরবানি শেষ করে ‘এহরাম’ মুক্ত হওয়ার পর নবীজী মদিনায় ফেরতযাত্রা করলেন। হুদায়বিয়ায় তারা মোট ২০ দিন ছিলেন।

আসলে হুদায়বিয়ার সন্ধি ছিল এক মহান বিজয়। কার্যত তা ছিল কোরাইশদের আত্মসমর্পণের সূচনা। হিংসামুক্ত শান্তিপূর্ণ ১০টি বছরের প্রতিশ্রুতি। কোনো নির্যাতন বা সশস্ত্র বিরোধিতার মুখোমুখি না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মপ্রচারের সুযোগ- একটি ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর জন্যে এর চেয়ে বেশি আর কী প্রয়োজন! নবীজী প্রকাশ্যে সত্যধর্ম প্রচার করার শুরুর দিন থেকেই সম্মুখীন হয়েছিলেন কোরাইশদের তরফ থেকে প্রচণ্ড বিরোধিতার। যার শুরুটা হয় অপপ্রচার দিয়ে। সেইসাথে নির্মম নির্যাতন। শুধু অনুসারীদের ওপরই নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয় নি, তিনিও সম্মুখীন হয়েছিলেন দৈহিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার। তাঁকেও হত্যার চূড়ান্ত প্রয়াস চালানো হয়েছিল। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা রাতের অন্ধকারে মক্কা ত্যাগ করেও রেহাই পান নি।

মদিনায় তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ-উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে তারা। বদর, ওহুদ, খন্দক- মুসলমানদের ধ্বংস করার সকল প্রয়াসের তারাই ছিল অনুঘটক। চারপাশের আরব গোত্রগুলোর শত্রুতার সাগরে মদিনা ছিল এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কোরাইশরা ছিল আরবের অবিসংবাদিত নেতা। ব্যবসা, ধর্ম ও ক্ষমতা ছিল তাদেরই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। আরব গোত্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের সাথে কোরাইশদের আচরণেরই পুনরাবৃত্তি করত। তারা সাধারণভাবে মদিনার সাথে যে-কোনো সম্পর্ক এড়িয়ে চলত, পাছে কোরাইশরা মনঃক্ষুণ্ন হয়, এই ভয়ে। প্রায় সব গোত্রই কোরাইশদের সাথে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ ছিল। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল চক্রান্ত ও শত্রুতার ক্ষেত্রে ইহুদি গোত্রগুলোর শক্তির উৎস ছিল কোরাইশরা।

হুদায়বিয়ার চুক্তিতে কলমের এক খোঁচায় উল্টে দিল আরবভূমির শক্তির সমীকরণ। ইসলাম বিরোধিতায় সহিংস অবস্থান থেকে কোরাইশরা এই প্রথম নেমে এলো অহিংস প্রক্রিয়ায়। ওমরাহ হজ পালনে আগত ১৪০০ নিরস্ত্র কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের কাবাঘর তাওয়াফ প্রতিহত করার জন্যে তারা বাধ্য হলো শান্তির প্রস্তাব দিতে।

মৃত্যুভয়কে যে জয় করে, জীবন তাকে আলিঙ্গন করে
বায়াত-এ রিদওয়ানের মাধ্যমে মৃত্যুভয়কে জয় করেছিল এই নিরস্ত্র তীর্থযাত্রীরা। বাস্তব সত্য হচ্ছে, যখন কেউ মৃত্যুভয়কে জয় করতে পারে, তখন মৃত্যুই তাকে ভয় পায়। মৃত্যু তখন দূরে সরে যায়। জীবন তাকে আলিঙ্গন করে। জীবনের মহিমা ও আনন্দ তার কাছে ধরা দেয়। 

দীর্ঘ দুই দশক ধরে কোরাইশরা যাদের অস্পৃশ্য করে রেখেছিল, হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে তাদেরকেই তারা গ্রহণ করল সমমর্যাদায়। বেদুইন গোত্রগুলোর সাথে পূর্বের সকল মৈত্রীর অবসান ঘটল। প্রতিটি গোত্র লাভ করল দুই পক্ষের যে-কারো সাথে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার। ফলে আরবের কোনায় কোনায় সত্যধর্মের বাণী প্রচারের পথ উন্মুক্ত হলো। কোনো ভয় ছাড়াই মদিনার সাথে যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হলো আরবের সকল গোত্রের। ফলে পরবর্তী দুই বছরে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ল দ্বিগুণেরও বেশি। 

অহিংস জনযুদ্ধের মহান সেনানায়ক যে কতটা অহমহীন হতে পারেন, হুদায়বিয়ায় আমরা পাই তারই বাস্তব চিত্র। কোরাইশ প্রতিনিধি দলের নেতা সুহাইল ইবনে আমর প্রথম থেকেই শক্তভাবে নিজের মতামত মানতে বাধ্য করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আলোচনা শুরু করলেন। চুক্তি লিপিবদ্ধ করার সময় উপস্থিত হলে লেখার দায়িত্ব আলীকে দেয়া হয়। নবীজী আলীকে বললেন, লেখ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। সুহাইল পরিষ্কার বললেন, এই রহিম ও রহমান কে আমি চিনি না। লেখ ‘আল্লাহুমা বিসমিকা’ (অর্থাৎ তোমারই নামে হে আল্লাহ!)।

নবীজী তখন আলীকে বললেন, ‘ঠিক আছে লেখ।’ এর পরের লাইন তিনি বললেন, ‘লেখ, আল্লাহর রসুল মুহাম্মদের সাথে .....।’ এখানে আসতেই সুহাইল বললেন, ‘না না কাটো! আমরা তোমাকে আল্লাহর রসুল বলে স্বীকার করি না। যদি স্বীকার করতাম, তাহলে তোমাদের সাথে আমাদের কোনো সংঘাতই হতো না। অতএব লেখ, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।’ নবীজী আলীকে বললেন, ‘আল্লাহর রসুল’ শব্দটি কেটে দাও। আলী তা কাটতে অস্বীকার করলেন। কারণ তিনি যা একান্তভাবেই বিশ্বাস করেন, তা তিনি বাদ দেবেন কীভাবে? নবীজী তখন দেখাতে বললেন, ‘আল্লাহর রসুল’ শব্দটি কোথায়? আলী দেখিয়ে দিলেন। নবীজী নিজে সে শব্দটি কেটে দিলেন।

চুক্তির পরই আবু জান্দালকে শিকল বেঁধে মক্কায় ফেরত নেয়ার ঘটনা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। নবীজী তখন অতি বিনীতভাবে সুহাইলকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে আবু জান্দালকে আমার হাতে তুলে দিন। অর্থাৎ আমি তাকে নিজ ছেলের মতো দেখব। তখন সুহাইল একটা কাঁটাযুক্ত গাছের ডাল ভেঙে তা দিয়ে ছেলেকে নির্মমভাবে পেটাতে শুরু করলেন। তখন নবীজীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারপরও তিনি আবু জান্দালকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া কাউকে কিছু করতে দেন নি শুধু শান্তির লক্ষ্যে। আলাপ-আলোচনায় সুহাইল যতটা অনড় ও একগুঁয়ে ছিল, নবীজী ছিলেন ততটাই বিনয়ী ও নমনীয়। কোরাইশদের চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক সব শর্তই তিনি মেনে নিয়েছিলেন অবলীলায়, শান্তির স্বার্থে।

একজন নেতার জন্যে অহমকে জয় করা অতি কঠিন কাজ। তিনি শুধু প্রতিপক্ষেরই নয়, সপক্ষীয়দের মোকাবেলায়ও অহমকে জয় করেছিলেন অবলীলায়। এছাড়াও হুদায়বিয়ার সন্ধির দুটি শর্ত নিয়ে মুসলমানদের একটি অংশে প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এক. ওমরাহ না করে ফিরে যাওয়া এবং দুই. আশ্রয়প্রার্থী মুসলমানকে ফেরত দেয়া। অধিকাংশের এই ক্ষোভের প্রকাশ আমরা ওমরের মধ্যে দেখতে পাই। ওমর নবীজীকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, আপনি কি আল্লাহর সত্যিকার নবী নন? নবীজী খুব শান্তভাবে জবাব দিলেন, কেন নই? 

ওমর: আমরা কি সত্যপথ এবং শত্রুরা কি ভ্রান্তপথের অনুসারী নয়? নবীজী: অবশ্যই! ওমর: তাহলে আমরা কেন ধর্মীয় ব্যাপারে এই অবমাননা সহ্য করব? নবীজী: আমি অবশ্যই আল্লাহর দাস ও তাঁর রসুল। আমি কখনোই তাঁকে অমান্য করব না। তিনি কখনো আমাকে ত্যাগ করবেন না। ওমর: আপনি কি বলেন নি যে, আমরা ওমরাহ করব? নবীজী: আমি কখনো বলি নি যে, আমরা এই বছরই ওমরাহ করব! ইনশাল্লাহ, আগামীতে আমরা ওমরাহ করব। ওমর ও উপস্থিত সাহাবীরা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। তবুও ওমরের অস্থিরতা দূর হলো না। 

ওমর আবু বকরের কাছে এর ব্যাখ্যা বোঝার জন্যে গেলেন। আবু বকর ওমরকে হাত ধরে বললেন, তুমি কি চিন্তা করেছ, কার নির্দেশে তিনি কাজ করছেন? কী করতে হবে- এ নির্দেশ তিনি কোত্থেকে পাচ্ছেন? তুমি কি স্মরণ করতে পারছ না, তিনি কে? একথা শোনার পর ওমরের সংবিৎ ফিরে এলো। নবীজীর কথা, সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনার ব্যাপারে আবু বকরের মনে কখনো কোনো প্রশ্ন ছিল না। ছোটবেলার বন্ধু হয়েও নবীজীর আদর্শকে তিনি মনের যত গভীরে লালন ও উপলব্ধি করেছিলেন, তা আর কেউ করতে পেরেছিলেন কিনা সেটা আল্লাহই ভালো জানেন।

নবীজীর জীবদ্দশায় যেমন, তাঁর ওফাতের পরও একইভাবে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর আদর্শ রক্ষায়। নবীজীর মৃত্যুসংবাদে সবাই যখন হতভম্ব, ওমর নাঙ্গা তলোয়ার হাতে নিয়ে মসজিদে নববীতে যখন বলছেন, যে বলবে মুহাম্মদ মারা গেছে, তিনি তার কল্লা কেটে ফেলবেন, তখন আবু বকর দাঁড়িয়ে শ্রোতাদের বাস্তব অবস্থা বললেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, যারা মুহাম্মদের উপাসনা করছো তারা শোন, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহর উপাসনা করছো তারা জেনে রাখো, আল্লাহ শাশ্বত, চিরঞ্জীব।

নবীজীর ওফাতের পর এই চিরঞ্জীব সত্তা প্রেরিত নৈতিক অনুশাসনের ভিত্তি সংহত করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় আবু বকরের ওপর। নবীর প্রতি বিশ্বাসে অনড়তা, নবীর নির্দেশনা পালনে ইস্পাতসম দৃঢ়তা, বাস্তবতা অনুধাবনে প্রজ্ঞার গভীরতা, আলাপচারিতায় কোমলতা আর সাধারণের প্রতি সমমর্মিতা দিয়ে তিনি ইসলামের নৈতিক অনুশাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। তিনি শুধু ভিত্তি সুদৃঢ়ই করেন নি, আরবভূমির অভ্যন্তরে ভণ্ড নবী ও স্বার্থান্বেষীদের তৎপরতায় দাবানলের মতো প্রজ্বলিত বিদ্রোহ ও সকল প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করেন। বিশ্বাসীদের যথার্থ অর্থেই এক সুসংবদ্ধ উম্মাহ ও রাষ্ট্রশক্তিতে রূপান্তরিত করেন। মাত্র দু’বছরের মধ্যে জনযোদ্ধাদের উত্তরণ ঘটে একক কমান্ডের অধীন এক সুশৃঙ্খল জানবাজ বাহিনীতে।

মানুষের মুক্তির জন্যে জীবন দিতে পারাটাই হয়ে ওঠে তাদের কাছে বেঁচে থাকার সার্থকতা। পারসিক ও রোমান শোষণের কবল থেকে শোষিতের মুক্তির লক্ষ্যে তারা প্রবেশ করে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য শাসিত ভূমিতে। নবীজীর খলিফা মনোনীত হওয়ার পর আবু বকর সর্বসমক্ষে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। সেখানে তিনি নিজের অবস্থান বিনয়ের সাথে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলিফার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমি চেয়েছিলাম অন্য কেউ দায়িত্ব নিক। আপনারা যদি আমার কাছ থেকে নবীর মতো আচরণ প্রত্যাশা করেন, তাহলে আমি অক্ষম। তিনি নবী ছিলেন। আর আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনারা যদি দেখেন নবীর শিক্ষা অনুসারে আমি ঠিক কাজ করছি, তাহলে আমাকে সহযোগিতা করবেন। আর যদি দেখেন আমি ভুল করছি, তাহলে আমাকে সতর্ক করে দেবেন।

আবু বকর খলিফা হিসেবে তার প্রথম সিদ্ধান্তেই গভীর প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি ওসামা ইবনে জায়েদের নেতৃত্বে চার হাজার জনযোদ্ধার বাহিনীকে সিরিয়ার পথে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। নবীজীর গুরুতর অসুস্থতার খবর শুনে ওসামার বাহিনী তখন মদিনার উপকণ্ঠে তাঁবু গেড়ে তাঁর সুস্থতার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু নবীজী আর সুস্থ হলেন না। তার ওফাতের খবরে সকল অপশক্তি একযোগে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। চারদিকে বিদ্রোহ। অনেক গোত্র ইসলাম ত্যাগ করল। অনেক গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করল। সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল ভণ্ড নবীর দল। তারা মদিনা আক্রমণ করতে পারে এমন আশঙ্কা সৃষ্টি হলো।

সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে ওমরসহ অধিকাংশ প্রবীণ সাহাবীই ওসামার অভিযাত্রা বাতিল বা অন্তত স্থগিত রাখার পরামর্শ দিলেন। আবু বকর দৃঢ়ভাবে বললেন, নবীজী মৃত্যুশয্যায় যে অভিযাত্রার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর খলিফা হিসেবে আমি সে নির্দেশ অবশ্যই বাস্তবায়িত করব। এরপর তারা বললেন, যদি একান্তই পাঠাতে হয়, তবে ২০ বছরের তরুণ ওসামার পরিবর্তে অভিজ্ঞ কাউকে সেনাপতি নিযুক্ত করুন। আবু বকর এবারও দৃঢ়ভাবে বললেন, স্বয়ং নবীজী যাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছেন, তিনিই এ অভিযানে সেনাপতিত্ব করবেন। তিনি যে নবীজীকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন, দৃঢ়ভাবে নিজ অবস্থানে অটল থেকে তা প্রমাণ করলেন।

যদিও বাস্তব বিচারে সিদ্ধান্তটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কিন্তু তার প্রজ্ঞা তাকে বলে দিল, ওসামার এই অভিযাত্রা রোমানদের উৎপীড়ন থেকে উত্তর আরবের মুসলমান ও মিত্রদের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আর হলোও তা-ই। উত্তর সীমান্ত থেকে আক্রমণের আশঙ্কা হ্রাস পেল। উত্তর সীমান্ত নিরাপদ করে তিনি যে গোত্রগুলো যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিলেন। পরামর্শ সভায় ওমরসহ সাহাবীদের একটা বড় অংশ এদের বিরুদ্ধে অভিযান না চালানোর পরামর্শ দিলেন। তারা বললেন, এরা তো স্বীকার করছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল। আর তারা নামাজও আদায় করে। এদের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ করবেন!

আবু বকর সুস্পষ্টভাবে বললেন, আল্লাহর শপথ! যারা নামাজ থেকে যাকাতকে আলাদা করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই অস্ত্রধারণ করব। নামাজ যেমন ফরজ তেমনি যাকাতও হচ্ছে ফরজ। তিনি গোত্রগুলোকে বাধ্য করলেন আল্লাহর বিধান অনুসারে যাকাত দিতে। আবু বকরের খেলাফতের সোয়া দু’বছর ছিল যুদ্ধ আর যুদ্ধ। আরবভূমি কখনো এত রক্তপাত, এত সংঘাতের সম্মুখীন হয় নি। উত্তরের সিরীয় সীমান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণের ইয়েমেন পর্যন্ত সর্বত্র সুযোগসন্ধানীদের বিদ্রোহ। সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় ভণ্ড নবীদের সাথে। শুধু ভণ্ড নবীদের সাথে এক যুদ্ধেই যারা শহিদ হন, তাদের মধ্যে সাতশরও বেশি ছিলেন কোরআনে হাফেজ। প্রতিপক্ষের মৃতের সংখ্যা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।

কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রসুলের জন্যে সর্বস্বত্যাগে উদ্বুদ্ধ অকুতোভয় জনযোদ্ধারা সকল বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করে রণক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরিণত হন জাত যোদ্ধায়, একক কমান্ডের অধীন এক সুশৃঙ্খল জানবাজ বাহিনীতে। যাদের কাছে বিশ্বাসের জন্যে মৃত্যু জীবনের চেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে। আবু বকরের সফল নেতৃত্বে পুরো আরব উপদ্বীপে অধর্মের বিনাশ এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের পর এই বাহিনী পারসিক ও রোমান সাম্রাজ্যের শোষণের জাঁতাকল থেকে শোষিতের মুক্তির জন্যে সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্তে অভিযাত্রা শুরু করে। 

খেলাফতের প্রথম ছয় মাস তিনি আধাবেলা নিজের খাবারের অন্বেষণে ব্যবসা এবং দিনের বাকিটা সময় রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় করতেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিনি নিজের ব্যবসা দেখার সুযোগ করতে পারছিলেন না। তখন সাহাবীদের অনুরোধে পরিবারের ভরণপোষণের জন্যে ন্যূনতম অর্থ বায়তুল মাল থেকে নেয়া শুরু করেন। সমমর্মিতায়ও আবু বকর ন্যায়পরায়ণ খলিফাদের কারো চেয়েই কম যান না।

তিনি লোকজনের অবস্থা দেখাশোনার জন্যে মদিনার অলিগলিতে যেতেন এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন। ওমর একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন: ‘আমি প্রায় দিনই সকালবেলা এক বৃদ্ধার ঘরের কাজ করে দিতাম। একদিন সেখানে যাওয়ার পর বৃদ্ধা বললেন, আজ আর কোনো কাজ নেই। কেন? ওমরের প্রশ্ন। বৃদ্ধা বললেন, একজন ভালো মানুষ খুব ভোরে এসে আমার কাজগুলো করে দিয়েছেন। আমি খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, সেই ভালো মানুষটি হচ্ছেন আবু বকর।’

খলিফা আবু বকরের সবচেয়ে দূরপ্রসারী কাজ হচ্ছে গ্রন্থাকারে কোরআনের সংরক্ষণ। ভণ্ড নবীদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধেই ৭০০ হাফেজ শহিদ হওয়ার পর ওমর আবু বকরকে পরামর্শ দিলেন কোরআনকে গ্রন্থাকারে সংরক্ষণের। পরামর্শটি বাস্তবসম্মত মনে হওয়ায় আবু বকর জায়েদ ইবনে সাবিতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করলেন। নবীজীর সামনে বসে কোরআন লিপিবদ্ধকারীদের একজন ছিলেন এই জায়েদ। ফরমান জারি করলেন, যার কাছে কোরআনের যে অংশ লিখিত আছে, তা জায়েদের কাছে হাজির করতে হবে। জায়েদ একই সাথে হাফেজ ও কাতিব ছিলেন। তিনি শুধু নিজের স্মৃতি ও লেখার ওপর নির্ভর করেন নি। তিনি তার কাছে লিখিত প্রতিটি আয়াতের সমর্থনে দুজন করে কাতিবের লেখার সাথে তা মিলিয়েছেন। সেই কাতিব, যিনি নবীজীর সামনে এই আয়াত লিপিবদ্ধ করেছেন, তার সপক্ষে দুজন সাক্ষীরও সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। আর সেই আয়াত দুজন হাফেজ একইভাবে মুখস্থ করেছেন কিনা এবং তিনি যে নবীজীর সামনে সেই আয়াত শুনে মুখস্থ করেছেন তার সপক্ষে দুজন সাক্ষীও তলব করেছেন।

এক সাইজের কাগজে লিপিবদ্ধ করে একটার পর একটা কাগজ সাজিয়ে ওপরে-নিচে শক্ত মলাট দিয়ে বাঁধাই করার কারণে একে বলা হয় ‘মসহাফ’।  মসহাফ তৈরি হওয়ার পর বিজ্ঞ সাহাবীরা একে সর্বসম্মতভাবে সঠিক বলে সত্যায়িত করেন এবং আবু বকরের কাছে তা সংরক্ষণের জন্যে পেশ করেন। ইতিহাসে কোরআনের এই আদি কপিটি ‘মসহাফে সিদ্দিকী’ নামে পরিচিত। আবু বকরের মৃত্যুর পর ওমর এটি সংরক্ষণ করেন। ওমরের মৃত্যুর পর উম্মুল মোমেনিন হাফসা এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন। হাফসার কাছ থেকে নিয়ে ওসমান এর অনেকগুলো কপি করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। ওসমান কপি করানোর পর তার নামানুসারে মসহাফের নামকরণ হয় ‘মসহাফে উসমানী’।

অস্তিত্ব সংহত করার সার্বক্ষণিক সংগ্রাম। বিরামহীন পরিশ্রম। আবু বকর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন, মৃত্যু আসন্ন। তিনি মা আয়েশাকে বললেন, দেখ, খলিফা হওয়ার পর আমার সম্পদ কী পরিমাণ বেড়েছে। যা অতিরিক্ত পাবে তা পরবর্তী খলিফার কাছে প্রদান করবে। আয়েশা বলেন, আমরা সব অনুসন্ধান করলাম। পেলাম একজন দাস ও একটি উট। পরবর্তী খলিফা ওমরের কাছে আমরা তা উপস্থাপন করলাম। ওমর কেঁদে ফেললেন। বললেন, তিনি তার উত্তরসূরিকে জবাবদিহিতার খুব কঠিন অবস্থানে ফেললেন। 

মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসছে। শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। আয়েশা এ সময় দুটি পঙক্তি রচনা করলেন। আবু বকর মুড়ি দেয়া চাদর সরিয়ে মুখ বের করে বললেন, এভাবে নয়, বরং এভাবে বলো: ‘মৃত্যুর হতচেতন অবস্থা তোমার সামনে আসল সত্যকে উন্মোচন করবে। যার মুখোমুখি হওয়া তোমরা এড়াতে চাও।’ এরপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে তার ইচ্ছানুসারে নবীজীর পাশেই সমাহিত করা হয়।

যাইহোক, হুদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদনের সময়ই নবীজী বুঝেছিলেন কী অসাধারণ বিজয় ঘটতে যাচ্ছে। আর মদিনায় ফেরার পথেই নাজিল হলো সূরা ফাতাহ। এই সূরায় আল্লাহ হুদায়বিয়ার সন্ধিকে মহান বিজয় হিসেবে বর্ণনা করেন। ‘সত্য অস্বীকারকারীরা যখন ক্রমাগত অন্তরে জাহেলিয়াত বা অবিদ্যাপ্রসূত অহমিকা ও ঔদ্ধত্য পোষণ করছিল, তখন আল্লাহ তাঁর রসুল ও বিশ্বাসীদের অন্তর প্লাবিত করলেন অনাবিল প্রশান্তিতে। তাদের বিশ্বাস ও আল্লাহ-সচেতনতাকে করলেন আরো দৃঢ়। আসলে তারাই এ রহমত পাওয়ার যোগ্য। আল্লাহ সবকিছু জানেন। আল্লাহ তাঁর রসুলকে সত্য-স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই (আগামী বছর) কাবাঘরে নিরাপদে প্রবেশ করবে--কেউ কেউ মুণ্ডিতমস্তকে, কেউ কেউ চুল ছেঁটে। তোমাদের কোনো ভয় থাকবে না। তোমরা যা জানো না, আল্লাহ তা জানেন। এ-ছাড়াও তিনি তোমাদের জন্যে নিশ্চিত করেছেন আসন্ন বিজয়। আল্লাহ তাঁর রসুলকে হেদায়েত ও সত্যধর্ম প্রচারের জন্যে পাঠিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত ধর্মের নামে প্রচলিত সকল মিথ্যার ওপর এই সত্যধর্মকে বিজয়ী করবেন। এ সত্যের সাক্ষী আল্লাহর মতো আর কেউই হতে পারে না। মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল। তার সঙ্গীরা সত্য অস্বীকারকারীদের মোকাবেলায় দৃঢ় ও অনমনীয় আর নিজেরা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি কামনায় তোমরা তাদের রুকু ও সেজদায় নিমগ্ন অবস্থায় দেখবে। তাদের চেহারা ও আচরণে এ সেজদা অর্থাৎ সমর্পিত জীবনেরই প্রতিফলন ঘটবে। তাওরাত ও ইঞ্জিলে তাদের উপমা হচ্ছে, তারা এমন বীজের মতো, যা অঙ্কুরিত হয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। একসময় কাণ্ডের ওপর শক্ত হয়ে আকাশে মাথা উঁচু করে আর চাষীকে দেয় অপার আনন্দ। আল্লাহও একইভাবে বিশ্বাসীদের সমৃদ্ধ করবেন, আর তাতে সত্য অস্বীকারকারীদের অন্তর্জ্বালা বাড়তে থাকবে। (বিভ্রান্তদের মধ্য থেকেও) যারা বিশ্বাস স্থাপন ও সৎকর্ম করবে, আল্লাহ তাদেরকেও ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা করেছেন।’ (সূরা ফাতাহ : ২৬-২৯)

ইতিহাস বলে, যারাই শান্তিচুক্তি করার সময় অনড় ও একরোখা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, যারাই জোর করে প্রতিপক্ষের ওপর কঠোর শর্ত চাপিয়ে দিতে চায়, পরবর্তীকালে সেই শর্তই তাদের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়, অনুশোচনার ধারক হয়। হুদায়বিয়ার চুক্তির ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটল। নবীজী মদিনায় ফিরে আসার পর পরই কোরাইশদের মিত্র সাকীফ গোত্রের আবু বশির (উত্‌বা ইবনে উসাইদ) মদিনায় আসেন। নবীজীর কাছে তার মুসলমান হওয়ার কথা জানান। এর কয়েকদিন পর কোরাইশরা তাকে ফেরত পাঠানোর জন্যে চিঠি দেয় এবং আবু বশিরকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমির গোত্রের একজনকে তার দাস-সহ প্রেরণ করে। নবীজী আবু বশিরকে ডাকেন এবং তাকে শান্তভাবে বুঝিয়ে বলেন যে, মুসলমানরা কখনো চুক্তিভঙ্গ করে না। অতএব তোমাকে এই দুই জনের হাতে ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। তবে আল্লাহ তোমার ও তোমার মতো নির্যাতিতদের মুক্তির পথ করে দেবেন। আবু বশির দুজনের সাথে মক্কার পথে যাত্রা করল।

যুল হুলাইফায় পৌঁছে বিশ্রাম নেয়ার জন্যে বসে গল্প করার একপর্যায়ে আবু বশির তার আটককারীর তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে। মালিকের হত্যার দৃশ্য তার দাসকে এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে যে, সে মদিনার দিকে দৌড়াতে থাকে। মদিনায় এসে সে দম নেয়। পুরো ঘটনা বর্ণনা করে নবীজীর সামনে। কিছুক্ষণ পরে আবু বশিরও মদিনায় এসে উপস্থিত হলেন। নবীজী তাকে যেখানে খুশি চলে যেতে বললেন। কারণ শান্তিচুক্তি অনুসারে তাকে তিনি আশ্রয় দিতে পারছেন না। আবু বশির মসজিদ ছেড়ে যাওয়ার সময় নবীজী তাকে দেখিয়ে সাহাবীদের বললেন, ‘সে যদি কিছু সহযোগী পায়, তাহলে কোরাইশদের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়েই ছাড়বে।’

আবু বশির মদিনা থেকে পশ্চিমদিকে লোহিত সাগরের নিকটবর্তী কোরাইশদের উত্তরাঞ্চলীয় বাণিজ্যপথে সাইফুল বাহার এলাকায় আত্মগোপন করলেন। তিনি বুঝলেন তার বেঁচে থাকার জন্যেই কোরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করতে হবে। তিনি গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালিয়ে যতটা সম্ভব মালামাল লুট করা শুরু করলেন। এই আক্রমণের খবর মক্কায় পৌঁছার পর সেখানকার মুসলিম বন্দিদের মধ্যে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। আবু জান্দাল ইবনে সুহাইল এবং ওয়ালিদ ইবনে আল ওয়ালিদসহ ৭০ জনের বেশি যুবক গোপনে পালিয়ে সাইফুল বাহারে চলে এলো।

আবু বশিরের নেতৃত্বে গঠিত এই জনযোদ্ধার দল বাণিজ্য কাফেলায় গেরিলা হামলা চালিয়ে কোরাইশদের উত্তরাঞ্চলীয় ব্যবসায় অচলাবস্থা সৃষ্টি করল। কোরাইশরা সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করেও তেমন কোনো সুবিধা করতে পারল না। আবু বশিরের লোকবল বাড়তেই লাগল। কোনো উপায়ান্তর না দেখে কোরাইশরা মদিনায় এলো। আবু বশিরের পুরো দলকে নবীজীর তত্ত্বাবধানে মদিনায় এনে তাদের বাণিজ্যপথ নিরাপদ করার আবেদন জানাল। নবীজী আবু বশির ও তার দলের সবাইকে মদিনায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসার নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ যখন আবু বশিরের কাছে পৌঁছল, তখন তিনি মারাত্মক আহত হয়ে মৃত্যুশয্যায়। তবে তিনি তৃপ্তির সাথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আর আবু জান্দাল ও অন্যান্যরা মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এভাবেই কোরাইশদের চাপিয়ে দেয়া শর্ত কোরাইশদের অনুরোধেই বাতিল হয়ে গেল।

এনএস/