ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

লকডাউন কঠোরভাবে ফিরিয়ে আনা দরকার

সাব্বির আহমেদ

প্রকাশিত : ০৩:৫০ পিএম, ২৯ মে ২০২০ শুক্রবার

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের উর্ধ্বমূখী আস্ফালনের মধ্যে সাধারণ ছুটি আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। ৩১ মে, রোববার থেকে সব অফিস-আদালত খুলে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলা হয়েছে অফিসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। ছোটবড় কারখানাগুলো আগেই খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রশাসনের অনুমতি না থাকলেও তখন থেকেই খুলে দেয়া হয়েছিল অনেক বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলে দেওয়ার পাশাপাশি শর্তসাপেক্ষে গণপরিবহন চালুরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

দেশে যখন দৈনিক করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ৫/১০/২০/৫০ জন তখন ছিল কড়া লকডাউন। আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটা একটা করে খুলে দেয়া হয়েছে লকডাউনের ফিতা। বাড়তে বাড়তে যখন দিনে ২,০০০ ছাড়ানো শুরু করেছে তখন খুলে দেয়া হল সবই। করোনার সামনে এখন প্রতিরক্ষাহীন উলঙ্গ বাঙালি। অদ্ভুত!

স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোদ হোয়াইট হাউস, ক্রেমলিন, বাকিংহ্যাম প্যালেস, ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীট করোনা ঠেকাতে পারেনি; আমরা ছোট-বড় অফিসে আমরা পারব এমন আশা করা বাতুলতা। শর্তসাপেক্ষে গণপরিবহন চালুরও সিদ্ধান্তকে প্রয়োগযোগ্য মনে করে না কেউই। প্রশাসনের ছাড় পাওয়ার পরেও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে ঈদের আগে দোকানপাট খুলেনি বড় বড় শপিংমলগুলো।

গতকাল বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, প্রশাসনের ছাড় পাওয়ার পরেও শপিংমলগুলোর মত ঠিক একইভাবে খুলছে না স্বাস্থ্য সচেতন, কর্মীদের প্রতি দ্বায়িত্ববান ব্যবসা ও লোকহিতকর প্রতিষ্ঠান। তারা ঘরে থেকেই যার যার কাজ চালিয়ে যাবে; অনলাইনে চালাবে, আলোচনা; নিতান্ত প্রয়োজন হলে অফিসে গিয়ে সই-স্বাক্ষর করে আসবে। তাদের এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অযথার্থতা প্রমাণ করে।

জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে করোনা ব্যবস্থাপনার জন্য কোন প্রস্তুতি নেয়নি প্রশাসন। তারপর যখন দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হল তখন তারা বেশ ভাল রিয়্যাকশন দেখিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে স্কুল কলেজ এবং মার্চের শেষের দিকে এসে পুরো দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রশাসনের এসব কাজে সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সমর্থন দিয়ে যার যার দ্বায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছে। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও বস্তুত ১৮/১৯ মার্চ থেকেই অঘোষিত লকডাউন শুরু হয়ে যায়।

দলমত নির্বিশেষে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য বৃহত্তর পরিসরে একে অন্যকে সচেতন হতে সাহায্য করেছে। সরকার প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে করোনার বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ  ঘোষণা করেছিলেন, খাদ্য ঘাটতি নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতি পরিচালনার জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

করোনা নিয়ন্ত্রণের শুরুটা দেরীতে হলেও ভালই হয়েছিল। করোনা মোকাবেলায় সার্থক কয়েকটি দেশের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, মার্চের শেষ এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল সে অবস্থা ধরে রাখতে পারলে করোনা আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা ৪০,০০০ ছুঁতে পারত না; আরও আগেই করোনা নিয়ন্ত্রণ করে লকডাউন তুলে নেয়া যেত; স্বাস্থ্য, জীবন আর অর্থনীতির এত ক্ষতি হত না।

শ্রমিকদের বেতন অব্যাহত রাখার জন্য ৫,০০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা পছন্দ হয়নি গার্মেন্টস মালিকদের। তাদের প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমে দেখে বোঝা গিয়েছিল যে টাকাটা এমনি এমনি পেতে চেয়েছিলেন। ঋণ হিসেবে চাননি। এরপর থেকে শুরু হয়ে গেল একের পর এক অঘটনের ঘটনা। প্রথম অঘটনঃ চাকুরি খাবার ভয় দেখিয়ে গ্রাম-গঞ্জ থেকে শত শত মাইল হাঁটিয়ে শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে আসলেন দেশের বৃহত্তম শিল্প খাত, তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকেরা। তার সঙ্গে চাল চোর পর্ব, মাস্ক ও পিপিই দুর্নীতি। ডাক্তার বনাম প্রশাসন দ্বন্দ্ব, আরও কত কি।

সচেতন ব্যক্তি মাত্রই প্রতিটি অঘটনের বিস্তারিত জানেন। প্রশাসকেরা মাস্ক এবং পিপিই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার জন্য তাদের শাস্তি পেতে হয়নি। যদিও চাল চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সামান্য কয়েকজন জনপ্রতিনিধি, তাদের যথার্থ শাস্তিও যথাসময়ে নিশ্চিত করা হয়েছে, তবুও তা ব্যাপকভাবে মিডিয়ায় প্রচারের ফলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ইমেজ ঘাটতি হয়েছে। এর সুযোগ নিয়েছে প্রশাসকেরা। করোনা যুদ্ধের সকল দ্বায়িত্ব পেয়েছেন তারা। এমপি এবং মন্ত্রীরা নিজও এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা ছাড়া করোনা মোকাবেলায় নীতি নির্ধারণ বা আর কোন কাজে আসেননি।

বস্তুত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খুলে দেয়ার জন্য শত শত মেইল হাঁটিয়ে শ্রমিক আনার দিন থেকে করোনা নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। সেই নষ্ট পরিবেশ পচে গিয়েছে যে দিন প্রশাসন কারখানা খোলার অনুমতি দিল। তার উপর বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়েছে “জীবন বনাম জীবিকার কাল্পনিক দ্বন্দ্ব”। তারপর থেকে অল্প কিছু সচেতন মানুষ ছাড়া আর কেউই “ঘরে থাকার নীতি” গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। প্রশাসন একের পর এক লকডাউন শিথিল করার ঘোষণা দিতে দিতে লকডাউন বিষয়টাকে হাস্যকর করে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে অনেক হাসিঠাট্টা, কার্টুন, ভিডিও।

সুশীলেরা এবং গণমাধ্যম তুলেছিলেন “জীবন বনাম জীবিকার কাল্পনিক দ্বন্দ্ব”। বিভ্রান্ত হল সাধারণ মানুষ। দেশে যথেষ্ট খাদ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ থাকা সত্ত্বেও জীবিকাকে জীবনের মুখোমুখি করা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ষড়যন্ত্রের ঘোলাজলে অর্থনীতি গেল গেল বলে মাছ ধরতে নেমে গেলেন সুযোগসন্ধানীর দল। যার ফলে প্রশাসন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করেছে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সিদ্ধান্ত বদলেছেও অনেক।

তারা অর্থনীতির দোহাই দিয়ে প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করে লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য করেছে। বড় বড় কারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা আছে মাসাধিক কাল ধরে। এদের কেউই এ সময়ে মুনাফা করতে পারেনি। যে পরিমাণ বিক্রয় তারা করতে পেরেছেন তাতে মুনাফা দূরে থাক, কারখানা আর অফিস পরিচালন ব্যয় তুলে আনাও সম্ভব নয়। মুনাফা করতে পারেনি রফতানীকারকেরাও। লকডাউন শিথিল করে স্বাস্থ্য, জীবন আর অর্থনীতির ক্ষতি শুধু বেড়েই চলেছে।

সরকার নিয়োজিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কমিটি গতকাল নির্দিধায় বলেছে, প্রশাসনের নতুন সিদ্ধান্তের কারণে করোনা সংক্রমণ বাড়বে। তাঁরা আগেই বলেছিলেন, ঈদের পরের দুই সপ্তাহে করোনার ছোবল মারাত্মক হবে। কমিটির এক সদস্য গতকাল সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঈদের সময়ে জনগণের দেশব্যাপী যাতায়ত বন্ধ রাখতে ঈদের আগে তারা প্রশাসনকে কার্ফিউ জারি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রশাসন বরং উল্টো সাধারণ মানুষকে বাড়ি যাবার সুযোগ করে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন এক রকম, আমলারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অন্য রকম। চিকিৎসক আর বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে বার বার। প্রশাসনের নির্দেশ সত্ত্বেও হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মরেছে সাধারণ মানুষ, এমনকি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। চিকিৎসক আর প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা গিয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে। অনেক ক্ষেত্রে তারা মুখোমুখি হয়েছেন। বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন।

করোনার মত একটা ব্যাপক সামাজিক সমস্যার ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কোন ভূমিকা নেই। আমলারাই এখন সর্বেসর্বা। শুধু প্রশাসকেরা করোনা মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলেই বারবার ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে, অনাচার চলছে। করোনা ব্যবস্থাপনার জন্য পরামর্শ দেবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীগণ; নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ; প্রশাসনের কাজ তা বাস্তবায়ন করা। যার যা কাজ তা না করলে ফলাফল এমনই হয়।

ইতোমধ্যে করোনা আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে। সাধারণ মানুষকে প্রশাসনের ভুল সিদ্ধান্তের অনেক দাম দিতে হয়েছে, হচ্ছে। ৩১ মে থেকে সবকিছু খুলে দেয়ার ভুল সিদ্ধান্ত বজায় থাকলে আমাদের এখানে ব্রাজিল বা আমেরিকার মত অবস্থা সৃষ্টি হতে বেশি দিন সময় লাগবে না। এসব অনাচার বন্ধ করা দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী দুই সপ্তাহ আক্রান্ত বাড়বে অনেক বেশি; জুনের শেষ দিক থেকে সংক্রমণ কমে আসতে শুরু করবে। লকডাউন শিথিল করার বিষয়ে তখন ভাবা যাবে। ভুল সংশোধনের সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। আবার লকডাউন কড়া করে ফিরিয়ে আনা দরকার। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন ফিরিয়ে না আনলে জুলাই-আগষ্ট পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। আর তা হলে স্বাস্থ্য, জীবন, অর্থনীতি সবকিছুর ক্ষতি শুধু বেড়েই চলবে। ৩১ মে থেকে সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে লকডাউন কঠোরভাবে ফিরিয়ে আনা দরকার। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে আওয়াজ তুলুন। স্বাস্থ্য ও অর্থের ক্ষতি কমাতে হলে, বাঁচতে হলে লকডাউন ফিরিয়ে আনতে হবে।

লেখক: চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড। 

এমবি//