ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

‘বাজার রেখে গেলাম ঘরে থাকুন, প্রয়োজনে কল করুন’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:৪৪ পিএম, ৩০ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০২:৪৭ পিএম, ১ জুন ২০২০ সোমবার

ঘরে ঘরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন মির্জা গালিব- ছবি একুশে টেলিভিশন।

ঘরে ঘরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন মির্জা গালিব- ছবি একুশে টেলিভিশন।

পড়ালেখার টাকা জমিয়ে এবং বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের অনুপ্রেরণায় করোনাযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন নড়াইলের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। ‘স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশন’-এর ব্যানারে গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে ১০ বন্ধুকে নিয়ে করোনা মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছেন মির্জা গালিব সতেজ নামের ওই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। 

ইতোমধ্যে ৫ শতাধিক অসহায় মানুষকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, বিনামূল্যের সবজি বাজার, গরিব কৃষকের ধান কর্তন, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, ইফতার ও ঈদে নতুন পোশাক বিতরণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করেছেন তারা। এসব কাজে ‘স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশন’-এর সদস্যরা প্রশংসা কুড়িয়েছেন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই অসহায় কর্মহীন মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন ‘স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশন’-এর সদস্যরা। বিশেষ করে, এই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের ৮ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মির্জা গালিব তার লেখাপড়ার টাকা জমিয়ে ১০ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গত ২৪ মার্চ থেকে করোনা মোকাবেলায় কাজ শুরু করেন। এখন পর্যন্ত করোনামুক্ত থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন তারা। 

প্রথমদিকে নড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় মাস্ক বিতরণ ও জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করলেও পরবর্তীতে অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেন তারা। এরই ধারাবাহিকতায় রোজার আগেরদিন অর্থাৎ গত ২৪ এপ্রিল থেকে নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ এলাকায় চালু করেন বিনামূল্যে ‘মানবতার সবজি বাজার’। এই সবজি বাজারে প্রতি শুক্রবার সকালে আট প্রকারের ৬শ কেজি সবজি প্রায় ৩শ লোকের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। আর এতে দারুণ খুশি হন হতদরিদ্ররা।

এদিকে, বোরো ধানের ভরা মওসুমে গরিব কৃষকের ধান কেটে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মির্জা গালিবসহ তার ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। এছাড়া সুবিধাবঞ্চিত মা ও শিশুদের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পসহ ওষুধ বিতরণ, রোজার সময়ে হাসপাতালের রোগীদের এবং এতিম, পথচারী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করেন তারা। অন্যদিকে, পবিত্র ঈদুল ফিতরে ১০০ জন সুবিধাবঞ্চিত ও এতিম শিশুর মাঝে দেয়া হয় ঈদের নতুন পোশাক। ‘স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশন’-এর সদস্যদের এসব কর্মকাণ্ডে যারপরনাই খুশি উপকারভোগীরা। 

তাদের এসব কর্মসূচিতে বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত ছিলেন-জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন পিপিএম (বার), সিভিল সার্জন ডাক্তার আব্দুল মোমেন, নড়াইল সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার আব্দুস শাকুর, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মশিউর রহমান বাবু, সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কৃষ্ণা রায়, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) জাহিদ হাসান, নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর শরফুল আলম লিটু, নড়াইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীমূল ইসলাম টুলু, নড়াইল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রকিবুজ্জামান পলাশসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। 

এ ব্যাপারে মির্জা গালিব সতেজের বন্ধু আহমেদ শাকিল, এস এম শাহ পরাণ, সামিরা হক শাম্মা, কে এম রাহাত নেওয়াজ, সোহাগ ফরাজি, মিনহাজ, পরাগ ও জাকারিয়া বলেন, লেখাপড়ার টাকা জমিয়ে এবং তার পরিবারের সহযোগিতায় করোনা মোকাবেলায় মাঠে আছে সতেজ। করোনাযুদ্ধে প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয় করেছে সে। তার সব কর্মকাণ্ডেই আমরা সহযোগিতা করে থাকি।

 

স্থানীয় নারীনেত্রী ও সমাজসেবক পলি রহমান বলেন, সতেজের মানবসেবাকে স্যালুট জানাই। ছাত্রজীবনে সে যে কাজ করছে, তা অতুলনীয়। 

নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর শরফুল আলম লিটু বলেন, ‘স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশন’-এর সদস্যরা হতদরিদ্রদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, বিনামূল্যে সবজি বাজার চালুসহ নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ওদের জন্য দোয়া করি, ওরা যেন সুস্থ থেকে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করতে পারে।

‘স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মির্জা গালিব সতেজ জানান, মানবসেবাই তার একমাত্র নেশা। পড়ালেখার পাশাপাশি ২০১৭ সাল থেকে অসহায় মানুষের জন্য কাজ করছেন তিনি। তরুণ এই মির্জা গালিব বলেন, করোনার দুর্যোগকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু থেকেই মাঠে নেমেছি। ভবিষ্যতেও সবার পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ। 

এদিকে, ছেলের মানবসেবায় খুশি মির্জা গালিবের বাবা-মা। তার বাবা বিএম নজরুল ইসলাম বলেন, সতেজ কোনো নেশা বা বিপথে টাকা ব্যয় না করে মানবকল্যাণে কাজ করছে, এটাই বড় গর্বের। এ কাজে আমরা তাকে অর্থ দিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে থাকি।

মা শবনম বেগম বলেন, সতেজের ভাইয়েরা খাট কেনার জন্য তাকে প্রায় ২০ হাজার টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে গত ২৪ মার্চ থেকে করোনা মোকাবেলায় কাজ শুরু করেছে সতেজ। পড়ালেখা ঠিক রেখে সতেজ জনকল্যাণে যেসব কাজ করে যাচ্ছে, মা হিসেবে তাতে আমি অনেক খুশি। তার হাত দিয়ে লোকজন যদি একটু উপকৃত হয়, তাহলেই আমাদের সার্থকতা।  

এদিকে স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশনের সদস্যদের এসব ইতিবাচক কাজ অন্যদেরও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিরা। এই তরুণেরা যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশ ও জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা তাদের। 

এমনকি, যারা মানবিক সহায়তা চাইতে বা নিতে লজ্জাবোধ করেন তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দরজার সামনে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর প্যাকেট রেখে আসেন গোপনে। যাতে লেখা থাকে, ‘আপনাদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার রেখে গেলাম, দয়া করে তারপরেও ঘরে থাকুন এবং নিজের নিরাপত্তা বজায় রাখুন। প্রয়োজন পড়লে আবার কল করবেন।’ 

এ বিষয়ে নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার মশিউর রহমান বাবু বলেন, মহামারি করোনাকালে স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশনের সদস্যরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে যেভাবে কাজ করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এভাবে অন্যরা কাজ করলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা উপকৃত হবে। কোনো সমস্যা থাকবে না। 

সিভিল সার্জন ডাক্তার আব্দুল মোমেন বলেন, করোনার কঠিন মুহূর্তেও তরুণ ছেলেদের এইসব অসাধারণ উদ্যোগ খুব ভালো লেগেছে। 

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন পিপিএম (বার) বলেন, স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গালিব সতেজের কর্মকাণ্ড খুব ভালো লেগেছে। এগুলো মানবিক উদ্যোগ। আমাদের এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজার জেলা ‘মানবিক নড়াইল জেলা’ হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে নড়াইল জেলা দেশের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

এনএস/