ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করোনা নিয়ে ড. বিজন কুমার শীলের আরও অজানা তথ্য

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:১৪ পিএম, ২ জুন ২০২০ মঙ্গলবার

করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ এর তাণ্ডবে অচল হয়ে পড়েছে পুরো পৃথিবী। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে সংক্রমণের হার সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। অজানা এই ভাইরাসের প্রকৃতি সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত না থাকায় সংক্রমণ ঠেকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুরো পৃথিবীকে। প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ায় এখনো শতভাগ নিরামক ঔষধ আসেনি আমাদের সামনে, তবে একজন ব্যক্তি আক্রান্ত হলে পুরো কমিউনিটি আক্রান্ত হতে পারে এমন প্রজ্ঞাপন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক অর্গানাইজেশন। 

তাদের বক্তব্য মতে,  আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত করে অন্যদের থেকে আলাদা করে চিকিৎসা দেওয়ায় হতে পারে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। তবে, যেহেতু এই ভাইরাস সম্পর্কে আগে থেকে তেমন কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না, তাই এই ভাইরাস শনাক্তকরণ পদ্ধতিও খুব সহজলভ্য নয়। এরপরেও পৃথিবীব্যাপী এই মহামারীকালীন সময়ে এসে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে মাত্র ৫ মিনিটে করোনা শনাক্তকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করে বেশ আলোচনায় রয়েছে দেশের চিকিৎসাখাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। 

তাদের ভাষ্যমতে, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিট “জি র‍্যাপিড ডট ব্লট” দিয়ে মাত্র ৫ মিনিটে রোগীর দেহে করোনা ভাইরাস আছে কিনা তা নির্ণয় করা সম্ভব। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই উদ্ভাবন নিয়ে উদ্ভাবক টিমের প্রধান ড. বিজন কুমার শীলের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতা মো. রোকনুজ্জামান।   

একুশে টেলিভিশন: করোনা ভাইরাস নিয়ে গবেষণার শুরুর গল্পটা জানতে চাই।

ড. বিজন কুমার শীল: আমরা জানুয়ারির ২৩ তারিখে কাজ শুরু করেছি। ২০০৩ সালে যেহেতু এটা ডিল করেছি, আমি জানি এ ভাইরাসের চরিত্র। এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ স্যারকে অবগত করলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে তুমি যেহেতু টেকনিক জানো, তাহলে কাজ শুরু করো। যখন ডিসেম্বরে চীনে শুরু হলো, ঐ সময় ছিল নিউ ইয়ার। এটা খুবই মারাত্মক ছিল। কারণ, নিউ ইয়ারে ২০০-২৫০ মিলিয়ন মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মুভ করে। 

আমার আশঙ্কা ছিল, রোগটা ছড়াবে। কারণ, চীনারা সারা পৃথিবীতেই থাকে। নিউ ইয়ারে অংশগ্রহণ করতে যারা যাবে, তারা ফিরে আসার সময় ভাইরাস নিয়ে আসবে। ঠিক এটাই ঘটেছে। যখন বিমানে যেখানে গেছে, রোগ নিয়ে গেছে। এভাবে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমরা মেডিকেল সাইন্সের মানুষ। আমরা জানি, যদি কোনও নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব হয়, তাহলে এর কোনও প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। এরা সর্বগ্রাসী হয় এবং এদের জিনগত মিউটেশন (রুপান্তর) ঘটে।

একুশে টেলিভিশন: বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকৃতি সম্পর্কে আপনার ব্যাখা জানতে চাই।

ড. বিজন কুমার শীল:  আপনারা খেয়াল করবেন চীন এবং ইতালিতে যে ইনফেকশন হয়েছে সেটা কিন্তু ভিন্ন। ইতালিয়ান ভাইরাসটাই পরে বাংলাদেশে আসছে। আমার ধারণা ছিল বলেই তখন আমরা কাজ শুরু করেছিলাম।

একুশে টেলিভিশন: আপনাদের কিটের বিশেষ সুবিধা কী?

ড. বিজন কুমার শীল: কিছু মানুষ উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই টেস্টের জন্য আসে। আবার কিছু মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কাজ না হলে তখন আসে। অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি দুটো টেস্ট করলে রোগী যখনই আসুক, কারো মিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ জন্য আমরা সকলকে দুটো পরীক্ষা করার জন্যই উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, একজন রোগীর শনাক্তকরণ যদি মিস হয়, তাহলে সে আশেপাশের মানুষকে সংক্রমিত করবে। আমরা এ সুযোগটা দিতে চাচ্ছি না।

একুশে টেলিভিশন: সম্প্রতি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রয়োজন পড়লে সর্বোচ্চ দুইশো টাকায় ডেঙ্গুর কিট দেয়ার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাই।

ড. বিজন কুমার শীল: ডেঙ্গুর কিট আমার অলরেডি তৈরি করা আছে। ওটা একদম প্রমাণিত। ৪ বছর আগে আমি ভারতে এটা তৈরি করেছিলাম, যেটা ঐ দেশের সরকারের অনুমোদন আছে ডেঙ্গুর ঐ টেকনোলজি আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসতেছি। আশা করছি, এক মাসের মধ্যেই এটা চলে আসবে। তখন আমরা এখানেই কিট তৈরি করবো। 

সামনেই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হবে। সমস্যা হচ্ছে, সব বড় বড় দেশগুলো রপ্তানি বন্ধ করে দিচ্ছে। ভারত থেকেও কোনও ধরণের র‌্যাপিড টেস্ট কিট বাইরে আসতে দিচ্ছে না। আমার মূল জিনিসটা ভারতেই ছিল। আমি তাঁদের সাথে যোগাযোগ করেছি। আমরা ২৫ হাজার কিটের অর্ডার দিয়েছি। হয়তোবা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।

একুশে টেলিভিশন:  ২০০৩ সালে সারাবিশ্বে সার্সভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, আপনি সার্স ভাইরাস নিয়েও কাজ করেছেন, এমনকি সার্স প্রতিরোধে উদ্ভাবনকৃত এই পদ্ধতি আপনার নামে পেটেন্ট করা। সেই গল্পটা শুনতে চাই।

 ড. বিজন কুমার শীল: এই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা কার্যে আমরা যে পরীক্ষাগার ব্যবহার করতাম, তা সরকার অনুমোদিত ছিল। আমরা নিজেরা একটা টেস্ট ডেভেলপ করি, যেটার নাম দিই এলাইজা ডট ব্লট র‌্যাপিড টেস্ট। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর আমি সার্সের কিট তৈরি করতে সক্ষম হই। এটা দিয়ে ঐ সময় সার্স ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। 

এটা ছিল রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের মতো এক  ধরনের পদ্ধতি। পরে এটি চীন সরকার কিনে নেয়। এক্ষেত্রে প্রথম দিকে সময় লাগতো দেড় ঘণ্টা। পরে আমরা সেটাকে সফলতার সাথে ১৫ মিনিটে নামিয়ে আনি। বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এটা আমরা আরও আপডেট করেছি। এখন সর্বোচ্চ ৫ মিনিটেই করোনা শনাক্ত করা যাবে। 

একুশে টেলিভিশন:  পিপিআর ভাইরাসে (গোট প্লেগ) আক্রান্ত ছাগলের মড়ক ঠেকাতে আপনি উদ্ভাবন করেছিলেন পিপিআর ভ্যাকসিন। সে সম্পর্কে জানতে চাই।

ড. বিজন কুমার শীল: সাল ১৯৯৯। একাডেমিক শিক্ষাজীবন শেষ করে তখন সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) কর্মরত। ঐ বছর হঠাৎই সারাদেশে গবাদিপশু বিশেষ করে ছাগলের মড়ক শুরু হয়। রোগটির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমি দ্রুতই কাজ শুরু করি। উদ্ভাবনকৃত ভ্যাকসিনটির নাম দিই ‘শহীদ টিটো স্ট্রেইন’। ঐ ভ্যাকসিনের ফলে সে সময় লাখ লাখ ছাগলের প্রাণ বাঁচে।

একুশে টেলিভিশন: আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের যে নেশা তার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল? 

ড.বিজন কুমার শীল: (মুচকি হেসে) এটা আমার ছোটবেলা থেকেই। বাড়িতে অনেক কিছু দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করতাম। আমার চিরকালই অভ্যাস ছিল, কোনোকিছু দেখে সেটাকে মোডিফাই করে নতুন কিছু তৈরি করা। কোনও একটা টেকনিক দেখলে হুবহু তৈরি না করে আমি চেষ্টা করতাম সেটাকে কিভাবে আরও উন্নত করা যায়। ঐ টেকনিকে কোথায় ভুল আছে সেটা বের করে আপডেট করার এই প্রবণতা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল।

একুশে টেলিভিশন: গবেষণায় মূলত প্রতিবন্ধকতাটা কোথায়?

ড বিজন কুমার শীল: আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। যখন কোনো কিছু আবিষ্কার করি, তখন সাধারণত অনুমোদন দিতে চাই না। উনারা মনে করেন, এতে অনেক গ্যাপ আছে। এ জন্য কিছুটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া অন্যান্য কিছু সমস্যা তো থাকেই, কিন্তু সেগুলো আমি তেমন আমলে নিই না।

একুশে টেলিভিশন : আপনার এই গবেষণায় যারা সাহায্য করেছেন তাদেরকে নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

ড. বিজন কুমার শীল: পুরো টিমকে আন্তরিক ধন্যবাদ। সমস্ত টিমই আমার সাথে কাজ করেছে। জাফরুল্লাহ স্যার সর্বদা যোগাযোগ করেছে। এমনকি রাত দুইটার সময়ও কাজের বিষয়ে ফোনে খোঁজ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। এটা অনেক সাংবাদিকরা জানেন না। কিন্তু আমি জানি কতটুকু সহায়তা পেয়েছি।

একুশে টেলিভিশন: তরুণ গবেষকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

ড বিজন কুমার শীল: বিজ্ঞানের জগতে সামনে চলতে হলে বাধা থাকবেই। কিন্তু বাধাকে শিক্ষার বস্তু মনে করতে হবে। তাতে কাজটা সহজ হয়ে যায়। ভালো কোনো কাজ করতে গেলে সেটার সমালোচনা, বিরোধিতা হবে এটাই স্বাভাবিক। সবকিছু মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। তাহলেই সামনে এগোতে পারবেন, নইলে পিছিয়ে পড়বেন। বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েই বলেই আজকে আমি এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।

এমবি//