ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করোনায় বাড়ছে মোটরসাইকেলের চাহিদা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:১১ পিএম, ৪ জুন ২০২০ বৃহস্পতিবার

বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আঘাত হেনেছে এই প্রাণঘাতি ভাইরাস। এশিয়া মহাদেশেও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কম নয়। তবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল  ইউরোপের চেয়ে তুলনামূলক এশিয়ায় কম। এদিক থেকে এশিয়ার হটস্পট পাশ্ববর্তী দেশ ভারত। দেশটিতে হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ইতিমধ্যে ইউরোপের অনেক দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে। 

এদিকে বাংলাদেশের অবস্থাও খুব বেশি ভাল নয়। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা। দীর্ঘ দুইমাসেরও বেশি লকডাউন থাকলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য খারাপ পরিস্থিতিতেও সরকারকে বাধ্য হয়ে তুলে দিতে হয়েছে লকডাউন। এমনই এক পরিস্থিতিতে করোনায় বিপর্যস্ত দেশের মানুষ। 

লকডাউন তুলে নেয়ায় খুলেছে অফিস-আদালত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে চলছে গণপরিবহণ। যাত্রী কম নেয়ার শর্তে বাড়ানো হয়েছে ৬০ শতাংশ বাসভাড়া। কিন্তু রাস্তায় দেখা যায় সেইভাবে কেউই মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। বাসে যাতায়াত করা অনেক মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। কারণ অদৃশ্য শত্রু করোনার ভয়। কার মাঝে লুকিয়ে আছে এই ভাইরাস তা বলা কঠিন। এমনই এক আতঙ্কের সময়ে মোটরসাইকেলের উপর আস্থা রাখছেন সচেতন অনেক মানুষ। ফলে মোটরসাইকেলের দোকানে দেখা মিলছে ক্রেতাদের ভিড়। বাড়ছে মোটরসাইকেলের চাহিদা। করোনার সংক্রমণ এড়াতে প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মোটরসাইকেল। 

অঘোষিত লকডাউনের পর বাইসাইকেলের মতো চাহিদা বেড়েছে মোটরসাইকেলের। দু বছর আগে সরকার মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়। পাশাপাশি দেশেও উৎপাদন বেড়েছে। দামও কমেছে আগের চেয়ে। লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দেয়া হচ্ছে মূল্যছাড়সহ নানা সুবিধা। ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরেও বেড়েছে মোটরসাইকেলের বিক্রি।

ব্যবসায়ীরা জানান, দুমাস বন্ধ থাকার পর দোকান খোলায় বিক্রি বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। বাইসাইকেল বিক্রি বেড়েছে দুই থেকে তিন গুণ। ক্রেতাদের সুবিধায় নগদ মূল্যছাড়সহ কিস্তি সুবিধাও দিচ্ছে মোটরসাইকেল বিক্রেতারা।

ব্যবসায়ীরা জানায়, বর্তমানে দেশে সাইকেলের বাজার ছাড়িয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। নিজস্ব পরিবহনে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকায় ক্রেতারা ভিড় করছেন বেশি। আগে দোকানে গড়ে ৮/১০টি মোটরসাইকেল বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে ১৫ থেকে ২০টি হয়েছে। দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে মোটরসাইকেল। 

ব্যক্তিগত ব্যবহারের পাশাপাশি রাইড শেয়ারিং, পার্সেল সার্ভিস, ই-কমার্স ডেলিভারিসহ নানা ব্যাবসায়িক কাজেও বাড়ছে দুই চাকার এই বাহনের চাহিদা। ফলে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই বাজারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। 

সারাবিশ্বেই এখন প্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। মানুষের চলাচল সীমিত। এই লকডাউন পরিস্থিতি মানুষের চলাচলে বড় গণপরিবহনগুলো বন্ধ রয়েছে। প্রায় ২ মাস যাবৎ মোটরসাইকেল এর বিক্রি বন্ধ। মানুষ যেকোনো কিছু কেনার ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্তিতে পড়ছে। তবে মানুষের চলাচল প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু গণপরিবহনে যাতায়াত করলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা আছে তাই মানুষ মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছে।  

গণপরিবহন সীমিত আকারে খুললেও মানুষ আগের মতো আর গণপরিবহন ব্যবহার করতে চাইবে না। তারা গণপরিবহন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে। কারণ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বা ঝুঁকি অনেকদিন পর্যন্ত থাকবে। ফলে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে মোটরসাইকেল সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। তাই আগামীতে মোটরসাইকেলের বাজারও আরও বাড়বে। 

এছাড়া মোটরসাইকেলের চাহিদা বাড়ার আরও বেশ কিছু কারণ আছে। যেমন বর্তমান পরিস্থিতিতে বিবেচনায় বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকবে সবাই। ছোট ব্যবসা, ক্ষুদ্র কারখানা, কৃষিভিত্তিক ব্যবসা বা উদ্যোগ অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। অর্থ্যাৎ উদ্যোক্তা তৈরি হবে দেশব্যাপী। এসব উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ বা চলাচল সুবিধার জন্য মোটরসাইকেল সবচেয়ে বেশি কার্যকর বাহন। ফলে বিপুল পরিমাণ মোটরসাইকেলের চাহিদা থাকবে।

সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল বিক্রি বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলো এখন বিনা সুদে অথবা স্বল্প সুদে মাসিক কিস্তিতে মোটরসাইকেল কেনার সুযোগ। এমনকি কোনো ধরনের ডাউনপেমেন্ট ছাড়াই ক্রেডিট কার্ড দিয়ে সমান মাসিক কিস্তি সুবিধায় কেনা যাচ্ছে বাইক। আর সে কারণে তরুণরা খুব সহজেই মোটরসাইকেল কিনতে পারছেন। এ ছাড়া রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলোর কারণেও মোটরসাইকেলগুলো বিক্রির পরিমাণ বেড়ে গেছে অনেকখানি। 

পাশাপাশি ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা ই-কমার্স এবং এফ-কমার্সে (ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা) ডেলিভারিতে বড় ভূমিকা রাখছে মোটরসাইকেল। পাঠাও, মুভ, স্যাম, উবার-মটো, ইজিয়ার, ওভাইয়ের মতো রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলোতে দিন দিন বাড়ছে নিবন্ধিত বাইকচালকের সংখ্যা। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ কিস্তিতে মোটরসাইকেল ক্রয় করে রাইড শেয়ারের মাধ্যমে আয় করেই পরিশোধ করছে মাসিক কিস্তির টাকা।

দেশে মোটরসাইকেলের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাজাজ, টিভিএস, ইয়ামাহা, হিরো, হোন্ডা, সুজুকি ও মাহিন্দ্রা। ক্রমেই বাজারে অবস্থান শক্ত হচ্ছে দেশি ব্র্যান্ড রানার, যমুনা ও রোড মাস্টারের। প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব ব্র্যান্ডই দেশে কারখানা স্থাপন করেছে। এ ছাড়া কিছু চীনা প্রতিষ্ঠানের ডায়াং, জংশেন, হিরো পাওয়ার মোটরসাইকেল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। আছে কোরিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশের আমদানি করা মোটরসাইকেল।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে মোটরসাইকেল বিক্রি দুই লাখের নিচে ছিল। বাংলাদেশের বাজারে থাকা দেশি-বিদেশি প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে প্রায় পৌনে চার লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি করে, যা ছিল ২০১৬ সালের থেকে প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালে তা বেড়ে সাড়ে পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে বেশি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ সিসির মোটরসাইকেল। সংখ্যার দিক দিয়ে মোট বিক্রির ৪১ শতাংশের মতো ছিল কম সিসির মোটরসাইকেলের দখলে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ১৫০ সিসি বা তার বেশি ক্ষমতার মোটরসাইকেল।

সংখ্যার দিক দিয়ে মোট বাজারের ৩২ শতাংশ বিক্রি হয়েছে উচ্চক্ষমতার মোটরসাইকেল। মাঝারি ১২৫ সিসি ক্ষমতার মোটরসাইকেলের বাজার ছিল মোট বিক্রির ২৭ শতাংশ। ১৫০ বা তার চেয়ে বেশি সিসির মোটরসাইকেলে বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ। তবে চলতি বছর শেষে মোটরসাইকেলের প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখিতা কিছুটা কমবে।

উত্পাদনকারীরা জানান, আগে দেশের বাইরে থেকে সম্পূর্ণ ফিটিং করা মোটরসাইকেল আমদানি করা হতো। এতে আমদানি শুল্ক গুনতে হতো প্রায় ১৮১ শতাংশ। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে ইঞ্জিন ও যন্ত্রপাতি আমদানি করে দেশেই সেগুলো সংযোজন শুরু করেছে। এর ফলে সেসব মোটরসাইকেলে আমদানি শুল্ক দিতে হচ্ছে ৮৯ শতাংশ।

তবে দেশে মোটরসাইকেল বিক্রিতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০১৬ সাল থেকে। উত্পাদনের শর্ত যুক্ত করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়। ফলে কোম্পানিগুলো দেশে কারখানা স্থাপন করে বাজারে মোটরসাইকেলের দাম কমানোর সুযোগ পায়। পরের তিন বছর এই বাজারে উল্লম্ফন ঘটে।

এমবি//