ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অটোমান সাম্রাজ্যের পুনর্জাগরণ হচ্ছে কী?

স্বকৃত গালিব

প্রকাশিত : ০৬:৩৭ পিএম, ৬ জুন ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৭:৩৮ পিএম, ৬ জুন ২০২০ শনিবার

অটোমান সাম্রাজ্যের রুপকার উসমান।

অটোমান সাম্রাজ্যের রুপকার উসমান।

অটোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল আধুনিক তুরস্ককে কেন্দ্র করে। এই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপের হাঙ্গেরী, রাশিয়ার ক্রিমিয়া থেকে পূর্বে জর্জিয়া এবং আরবের ইয়েমেন পর্যন্ত। তাহলে বলা যায়, ইউরোপের অস্ট্রিয়ান বর্ডার ও এশিয়ার রাশিয়া ও ইরান বর্ডার পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল অটোমান সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য তুর্কী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান চেষ্টা করেছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এরই ধারাবাহিকতা হিসেবে ধরা হচ্ছে- সর্বশেষ ইয়েমেনের কয়েকজন রাজনৈতিক এবং উপজাতি নেতার সমর্থনে তুরস্ক ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূলে সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৯৫২ সালে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পর থেকেই দেশটির সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামরিক শক্তির দিক থেকে দেশটি মুসলিম বিশ্বে ১ম এবং বিশ্বে ৮ম। তুর্কি সামরিক বাহিনীর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪ লাখ ১০ হাজার। আর রিজার্ভ সদস্য রয়েছে আরও ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭০০ জন। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার। সব মিলিয়ে দেশটির বর্তমান সামরিক জনশক্তি ৭ লাখেরও বেশি।

তুরস্ক দিন দিন যেমন নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে তেমনিভাবে পুরোনো অটোমান সম্রাজ্য ঘিরে তৈরি করেছে তার সামরিক বলয়। আর এই সামরিক বলয় তৈরি করতে দেশটি সিরিয়া, ইরাক, কাতার, সোমালিয়া, নর্থ সাইপ্রাস, আজারবাইজানের মতো ছোট দেশগুলোতে তৈরি করেছে তাদের সামরিক ঘাঁটি। তুর্কিদের বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে সোমালিয়ায়। দেশটি আরব উপদ্বীপের পশ্চিমে লোহিত সাগরের প্রবেশ দ্বার ইডেন সাগরের তীরবর্তী হর্ণ আফ্রিকার একটি দেশ। ৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ক্যাম্পে তুরস্কের ২০০ সেনা অবস্থান করছে। সোমালিয়ার দক্ষিণে সীমান্তবর্তী দেশ জিবুতিতে তৈরি করছে আরেকটি সামরিক ঘাঁটি। আর জিবুতিকে ধরা হয় লোহিত সাগরের প্রবেশ দ্বার। দেশটি এল মান্দেব প্রণালীর তীরে, লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত। গত ডিসেম্বরে তুরস্কে নিযুক্ত জিবুতির রাষ্ট্রদূত আদেন আব্দিলাহি বলেন, ‘তার দেশ তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার সম্ভাব্য উদ্যোগকে তারা স্বাগত জানাবে।’ সেখানে ইতোমধ্যেই তুরস্কের নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করে জলদস্যু দমনের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং জাপানের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

আরব উইকলি’র খবরে বলা  হচ্ছে, তুরস্ক বর্তমানে ইয়েমেনের উপকূলীয় সাবওয়া, সকোত্রা এবং আল মাখা এলাকায় সেনা মোতায়েন করতে যাচ্ছে। আর ইয়েমেনের দক্ষিণের এ উপকূলীয় এলাকাগুলো এডেন উপসাগরের বাব আল-মান্দেব প্রণালী বা লোহিত সাগরের প্রবেশ দ্বারে অবস্থিত। তুর্কিরা শুধুমাত্র লোহিত সাগরের প্রবেশ দ্বারে সেনা ঘাঁটি স্থাপন করে ক্ষান্ত হয়নি, লোহিত সাগরে মধ্যে সুদানের অধিনে থাকা সুয়াকিন দ্বীপ ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে। এ দ্বীপটি ১৯৬০ সালে সুদান স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত  অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল। বিশ্বজোড়া বাণিজ্যের ১৩ শতাংশ পণ্য এবং দিনে ১ কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল তেল এই সাগরের মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়া করে। এই দ্বীপ ইজারা নিয়ে তুরস্ক লোহিত সাগরের পণ্য বাণিজ্য ও তেল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এত গেল তেল বাণিজ্য অপর দিকে তুরস্ক হর্ণ অফ আফ্রিকা ও আফ্রিকা মহাদেশে তার সামরিক বলয় গড়ে তুলেছে। সুয়াকিন দ্বীপ লিজ নেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সুদানের প্রতিবেশী ইরিত্রিয়াতে সেনা পাঠায় মিশর। সুদানের পত্রিকাগুলো লিখেছে, জেনারেল সিসি সরকার জিবুতি ও সোমালিয়াতে ২০ থেকে ৩০ হাজার সৈন্যের ঘাঁটি বানানোর জন্য দেন দরবার করে যাচ্ছে। এটা ইথিওিপিয়ার জন্যও শঙ্কার খবর কারণ নীলনদে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে মিশরের সাথে দেশটির বিরোধ চলছে। আফ্রিকা মহাদেশ সামরিক বলয়ের সঙ্গে সঙ্গে লোহিত সাগরের অপর পাশের দেশ সৌদি আরব, ইসরাইল, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে তাদের সামরিক বলয় বাড়বে।

লোহিত সাগরের পর মুখ ফিরানো যাক। পারস্য উপসাগরের দিকে। পারস্য উপসাগরের একটি ছোট্ট দেশ কুয়েত। সেই কুয়েতে রয়েছে তারিক ইবনে জিয়াদ নামে তাদের সামরিক ঘাঁটি। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা ‘হুরিয়াত’ জানিয়েছে, রাজধানী দোহার দক্ষিণে কাতার-তুর্কি যৌথ কমান্ড সেন্টার হিসেবে পরিচিত তারিক ইবনে জিয়াদ সামরিক ঘাঁটির কাছেই তুরস্ক একটি নতুন ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। আর এই সামরিক ঘাটি থেকেই মধ্যে প্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, ইরাক, ইরানসহ হরমুজ প্রণালীতে বাড়বে সামরিক বলয়। অন্যদিকে তেল বাণিজ্যের এক তৃতীয়াংশই এই প্রণালী ব্যবহার করে পরিবহণ হওয়ায়, এই তেল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ আসবে তুর্কিদের।

অপরদিকে ভূমধ্যসাগরের ছোট্ট দেশ সাইপ্রাস। এই সাইপ্রাসের উত্তর দিকে ছয়টি জেলা নিয়ে ১৯৭৪ সালে উত্তর সাইপ্রাস বা তুর্কি সাইপ্রাস গঠন করে তুরস্ক। সাইপ্রাসে রয়েছে ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। এই সাইপ্রাস থেকে তুর্কিরা সিরিয়া, লেবালন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, মিশর, গ্রিসের মতো দেশগুলোতে সামরিক বলয় তৈরি করেছে। অন্যদিকে ভূমধ্যসাগরের তীরের আরেক দেশ লিবিয়ায় জাতিসংঘের সমর্থিত সরকারের সাথে সামরিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তুরস্ক। ফলশ্রুতিতে লিবিয়াতে সেনা পাঠাই তুর্কিরা এবং সামরিক সাহায্য করছে লিবিয়াকে। এতে করে আফ্রিকার মহাদেশসহ তিউনিসিয়া ও মিশর সামরিক বলয় তৈরি করেছে তুর্কিরা। এর সঙ্গে সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের উপকূলের এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মহাদেশের ২১টি দেশের বাণিজ্যের ওপর তুর্কিদের প্রভাব বাড়বে।

এছাড়াও কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী আজারবাইজানে তুর্কিদের রয়েছে সামরিক ঘাঁটি। আর এই সামরিক ঘাঁটি থেকেই কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী ইরান, রাশিয়া, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও আজারবাইজানে তৈরি করেছে তাদের সামরিক বলয়।

মধ্যপ্রাচ্যে বা অটোমান সাম্রাজ্য ঘিরে থাকা লোহিত সাগর, ভূমধ্যসাগর,পারস্য উপসাগর, কাস্পিয়ান সাগরে সামরিক বয়ল তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে তুরস্ক সিরিয়া, ইরাক মতন দেশগুলোতে তৈরি করেছে সামরিক ঘাঁটি। উত্তর সিরিয়ায় সীমান্তবর্তী শহর রাস আল আইন শহরের ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে সরিয়ে দিয়েছে তুরস্ক। সেই এলাকায় তুরস্কের ভেতরে থাকা ৩০ লাখের বেশি সিরিয় শরণার্থীকে নিয়ে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরি করে দেশটি। এছাড়াও তুরস্কের সিমান্তবর্তী শহর ইদলিবে তুরস্ক সমর্থিত ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’কে (এনএলএফ) সাহায্য করার জন্য তুরস্কের সৈন্য ইদলিবে অবস্থান করছে। কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণ নামে উত্তর ইরাক তুরস্ক তৈরি করেছে আরেকটি সামরিক ঘাঁটি। আর এ সব সামরিক ঘাঁটি থেকেই তুরস্ক ইরাকে সামরিক বলয় তৈরি করেছে।

অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করার আকাঙ্খা নিয়ে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে তুর্কিরা। গত বছর জাতিসংঘে আফ্রিকান বিজনেস ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইজ গ্রেটার দ্যান ফাইভ’। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ স্থায়ী সদস্যকেই বুঝিয়েছেন। সম্প্রতি এরদোয়ান জাতিসংঘে সংস্কার কথা বলছেন বেশ জোরেশোরেই। এক দশক ধরেই তুরস্ক একাধিকবার নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠনের পক্ষে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করেছে। তুরস্ক মনে করে, নিরাপত্তা পরিষদে মুসলিম বিশ্বকে একটি স্থায়ী সদস্যপদ দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে ভারত, ইসরায়েল ও জাপানকে স্থায়ী সদস্য করার প্রসঙ্গ আলোচনায় উঠলে তুরস্ক নিজের প্রার্থিতার বিষয়টিও পরোক্ষে জানিয়ে দেয়।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোনাথন গ্রোভেট বলছেন, তুরস্কের পূর্ববর্তী অটোমান সাম্রাজ্য যখন মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত, তখন তারা বর্তমানের তুর্কিদের মতন বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করত। তারপর সেই এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। ইস্তাম্বুলের সেন্টার ফোর পাবলিক পলিসি ও ডেমোক্রেসি স্টাডিজ’র পরিচালক আয়বার্স গর্গুলি বলেন, ‘বর্তমানের বিশ্ব নতুন। এই পরিবেশে আরও সক্রিয় হয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তুর্কিরা। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞগণ অটোমান সাম্রাজ্যের পুনঃরাবৃত্তির কথা বলে আসলেও, তুরস্ক সরকারিভাবে এতদিন স্বীকার না করে শুধু বলে আসছিল, তারা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে। কিন্তু কিছু দিন থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলতে শুরু করেছে, ‘অটোমান সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমান তুরস্কের উদ্ভব এবং সেখানকার সীমানা ও সরকারের ধরণ পরিবর্তিত হলেও এর প্রকৃতি, আত্মা এমনকি প্রতিষ্ঠানও একই রকম রয়েছে।’ মুসলিম বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে তুরস্ক যে আকাঙক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে করে অটোমান সাম্রাজ্যের পুনর্জাগরণ স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকগণ। আর এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অটোমান সাম্রাজ্যের হারানো জৌলুস ফিরে পাবে তুর্কিরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, শেষ বর্ষ, স্নাতক (সম্মান), আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (কুবিসাস)।

এমএস/এনএস/