লর্ড ক্লাইভের মূর্তি অপসারণের দাবি নিজ শহরেই
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:৫১ এএম, ১৩ জুন ২০২০ শনিবার

যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর ব্রিটেন জুড়ে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। লকডাউনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে প্রতি সপ্তাহান্তেই বড় বড় বিক্ষোভ হচ্ছে ছোট বড় সব শহরে। এই আন্দোলনের টার্গেট হয়েছে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিক শাসন আর দাস ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল এমন ব্যক্তিদের মূর্তি। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবার রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি অপসারণের দাবি উঠেছে।
এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটি আবেদনপত্র খোলা হয়েছে চেঞ্জ-ডট-অর্গ ওয়েবসাইটে। প্রতিটি আবেদনপত্রেই রবার্ট ক্লাইভকে একজন বর্ণবাদী, লুটেরা এবং দুর্বৃত্ত বলে বর্ণনা করে বলা হয়েছে, তার মতো মানুষকে মূর্তি বানিয়ে স্মরণ করার কোন কারণ নেই।
এই দাবি জানাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সাধারণ মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন ব্রিটেনের অনেক নামকরা লেখক-ইতিহাসবিদ। এদের একজন উইলিয়াম ডালরিম্পল। তিনি গার্ডিয়ানে লেখা এক কলামে বেশ জোরালো ভাষায় তার যুক্তি তুলে ধরেছেন কেন তিনি রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি অপসারণের পক্ষে।
তিনি লিখেছেন, “ক্লাইভ এমন কোন ব্যক্তি নন, যাকে আমাদের এই যুগে সম্মান জানানো উচিৎ। যখন এডওয়ার্ড কোলস্টোনের (ব্রিস্টলের দাস ব্যবসায়ী) মূর্তি পর্যন্ত উপড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে, তখন সময় এসেছে এই মূর্তিটিও যাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়ার। ব্রিটেনের যে অন্ধকার অতীত ইতিহাস, ভবিষ্যত প্রজন্মকে তা জানাতে কাজে লাগবে এটি।”
‘বর্ণবাদী ক্লাইভের মূর্তি সরিয়ে ফেল’ দাবি জানিয়ে একটি আবেদন করেন ডেভিড প্যাট্রন। তিনি বলছেন, শহর চত্বরের কেন্দ্রে স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ক্লাইভের মূর্তি, কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে ২০০ বছর ধরে অপশাসনের কেন্দ্রে ছিল এই ব্যক্তি, যার কারণে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নির্মম অত্যাচার চলেছে।”
তিনি আরো লিখেছেন, “কাদের প্রতীককে আমরা সন্মান জানাবো, সময় এসেছে নতুন করে ভাববার। আমরা শ্রুসবেরির মানুষ কী নিয়ে গর্ব করবো, সেটা নিয়ে ভাববার। যদি আমরা জোসেফ স্ট্যালিন বা চেঙ্গিস খানের মূর্তি মেনে নিতে না পারি, তাহলে ক্লাইভের মূর্তি কীভাবে মেনে নিচ্ছি?”
ক্লাইভের জন্ম যে শ্রপশায়ার কাউন্টিতে, সেখানে তীব্র বিবাদ চলছে শ্রুসবেরি শহরের চত্ত্বর থেকে মূর্তি সরানোর দাবি নিয়ে। মূর্তি সরানোর দাবিতে দুটি আবেদনের একটিতে আট হাজারের বেশি মানুষ এর মধ্যে সই করেছেন।
মূর্তি সরানোর কোন আবেদনে যখন এক হাজারের বেশি মানুষ সই করেন, তখন সেটি স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষ শ্রপশায়ার কাউন্সিলের কাছে যায়।
কাউন্সিলের নেতা পিটার নাটিং জানিয়েছেন, “কাউন্সিলের সংবিধান অনুযায়ী যে কোন আবেদন, যেটিতে এক হাজারের বেশি মানুষ সই করেছে, সেটি আমাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। এটি নিয়ে কাউন্সিলে বিতর্ক হয়। এরপর ঠিক করা হয় কী করা হবে।”
রবার্ট ক্লাইভকে নিয়ে কেন এত বিতর্ক
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে স্কুল পর্যায়ের ইতিহাসের শিক্ষার্থীরা ভালো করেই জানেন, রবার্ট ক্লাইভকে ছিলেন এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন চালু করার পেছনে তার কী ভূমিকা ছিল।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়েছিল। এরপর কার্যত রবার্ট ক্লাইভ হয়ে উঠেছিলেন ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ১৭৫৮ সালে তাকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর প্রথম গভর্নর নিযুক্ত করা হয়েছিল।
ইংরেজ ইতিহাসবিদ লরেন্স জোন্স তার “দ্য মেকিং এন্ড আনমেকিং অব ব্রিটিশ রাজ’ বইতে লিখেছেন, “সেসময় বাংলা ছিল ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ, উর্বর আর ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। কত লোক তখন সেখানে বাস করতো কেউ জানে না। ক্লাইভ বানিয়ে একটা সংখ্যা বলেছিল, দেড় কোটি, যা আসলে অনেক কম। এই সংখ্যা হয়তো অনেক বেশি ছিল। ১৭৬৯-৭০ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তাতে বাংলার এক পঞ্চমাংশ মানুষ মারা যায় বলে ধারণা করা হয়।”
এই দুর্ভিক্ষ ছিল রবার্ট ক্লাইভ এবং তার উত্তরসুরী বৃটিশ শাসকদের শাসনের প্রত্যক্ষ ফল।
১৭৬০ সালে ৩৪ বছর বয়সে ক্লাইভ ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে। ততদিনে তিনি সেই যুগের ইংল্যান্ডে অন্যতম বিত্তশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি শ্রুসবারি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। পরে শহরের মেয়রও হন। দুই বছর পর তাকে ‘ব্যারন ক্লাইভ অব পলাশী’ উপাধি দেয়া হয়।
ভারতে ক্লাইভের অপশাসন, দুর্নীতি, লুন্ঠন নিয়ে পার্লামেন্টে সেসময় হৈচৈ হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে তদন্তও হয়েছিল। তদন্তে তার সমালোচনা করা হয়েছিল ভারতীয় নেতাদের কাছ থেকে বিরাট অংকের ঘুষ নেয়ার জন্য, যাদের তিনি ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছিলেন।
১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর তাকে নিজের বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। যদিও তার পরিবার একথা অস্বীকার করে। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তার মৃত্যু ঘটে। তাকে কবর দেয়া হয়েছিল নিজের গ্রামে এক অচিহ্ণিত কবরে।
কিন্তু নিজের সময়ে এরকম ঘৃণিত একজন ব্যক্তি পরবর্তীকালে কীভাবে আবার ইংল্যান্ডে পুনর্বাসিত হলেন এবং হোয়াইট হলের মতো জায়গায় তার স্মারক মূর্তি বসানো হলে সেই প্রশ্ন তুলেছেন ঐতিহাসিক উইলিয়ার ডালরিম্পল।
উইলিয়াম ডালরিম্পল মনে করেন, বিদেশ দফতরের বাইরে ক্লাইভের এই মূর্তি ‘নব্য সাম্রাজ্যবাদী স্বপ্ন’ দেখতে উৎসাহ যোগাতে পারে, এমন বিপদ আছে। ব্রিটেনে ইতিহাসের কারিকুলামে কেন সাম্রাজ্য স্থাপনের ইতিহাস কার্যত উপেক্ষিত সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
উইলিয়াম ডালরিম্পল বলেন, “আমাদের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সঙ্গে যে নৃশংসতা আর শোষণের ইতিহাস জড়িয়ে, সেটার ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি অজ্ঞ। বাকী দুনিয়ার সবার কাছে যেটা জানা, সেটা এখন আমাদের নিজেদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেটি হচ্ছে: ইতিহাসের একটা সময় জুড়ে আমরাও ছিলাম প্রচণ্ডভাবে বর্ণবাদী এবং সম্প্রসারণবাদী এক শক্তি, যারা প্রতিটি মহাদেশে অনেক সহিংসতা, অবিচারর এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী।” সূত্র: বিবিসি