ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ঝড়ের পরে

তোতো হাসান

প্রকাশিত : ০৮:১৭ পিএম, ১৩ জুন ২০২০ শনিবার

সাতাশ বছর বয়সি বশির গাজি তার দোচালা খড়ের ঘরটা নিজ হাতেই বানিয়ে ছিল, এই ফাল্গুনে। ছোট বারান্দার সাথে লাগোয়া এক চিলতে উঠান আর নারকেল সুপারির চারায় ঘেরা ঘরটা, আস্তে আস্তে একটা বাড়ি হয়ে উঠছিল যেন। ফসলের মাঠ পেরিয়ে উত্তর পাড়ায় ঢোকার একটু আগে পায়ে চলা পথটার পাশে, ছিমছাম দাঁড়িয়ে ছিল সেটা। ঘর বানানোর পর থেকেই বশির গাজির চোখের কোনায় সব সময় একটা প্রশান্তির হাসি আর মুখে লেগে থাকতো একটা গান "কেমন বাঁধনে বাঁধিয়াছ ঘর কারিগর, ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় ঘর নড়বড় করে"। 

বশির গাজি একাই বাস করত সেই ঘরে, আর দিন গুণত এই জ্যৈষ্ঠ মাসের। মাস খানেক আগে হঠাৎ একদিন কোথা থেকে তার সঙ্গী এসে জুটল। তা-ও আবার দুই দুইজন। এক জোড়া চড়ুই পাখি, তার সেই নতুন সঙ্গী। খড়খুটো টেনে এনে তার ঘরের চালে তাদের বাসা বাঁধতে দেখে খুব খুশিই লেগেছিলো বশির গাজির। রাতে শুয়ে শুয়ে মনের ফুর্তি নিয়ে চড়ুই পাখি দুটোর সাথে গল্প করত -- " পাকা কতা হয়ে গেছ, বুজলি তুরা? নিজির এক্কান ঘর কক্তি পাচ্চিলাম না, তাই এতো দিন পারুলির আব্বা রাজি হচ্ছিল না। একন সব ঠিক আছ। এই মাসেই বিয়ে। পারুলির আব্বা জানতি চাচ্ছে আমি কি নেব? আমি কইছি, কিচ্ছু না। মনে মনে কলাম, পারুল রে পালি-ই হবান"। 

আরো কত কত সব কথা, বলত আর লাজুক লাজুক হাসত। চড়ুই দুটো হঠাৎ হঠাৎ একটু কিচ কিচ চিড়িৎ চিড়িৎ শব্দে উত্তরও দিত বোধ হয়। শুনে আরো উৎসাহ নিয়ে বশির গাজি বলত -- "পারুল আসলি তোগের দু’জনরে খুব ভালো বাসপেন। ওর খুব মায়া আছ বোলো। আর আমি তোগের জন্নি দুডো নাম ঠিক করিছি। তুরা তো চড়াই পাখি, তোগের তো দালান কুটাই বাসা হয় শুনিছি। তাই তোগের নাম রাখিছি, সাহেব আর মেম। পছন্দ হয়েছ"? 

সাহেব আর মেম উঠানে, ঘরের চালে, নারকেল সুপারির পাতায় পাতায় কি যে ব্যস্তভাবে ছুটাছুটি করে বেড়াত তা আর বলার নয়। বশির গাজি সকাল বিকাল কিছু ধান চাল ছিটিয়ে দিত উঠানে। সাহেব বিবি কিচ কিছ চিড়িৎ চিড়িৎ করে উঠত আর বশির গাজি বলত --" আর ধন্যবাদ দিতি হবি না তোগের। থির হয়ে খাদিন আগে। দাঁড়া, আর কডা দিন, তোগের মতো আমাগেরও নতুন সুংসার হচ্ছে"। সাহেব আর মেমের একটু ভয় ভাব ছিলো বটে কিন্তু সংকোচ ছিল না মোটেও। হয়তো ভাবত নিজের বাসায় আবার সংকোচ কিসের! 


গত রাতে ভীষণ এক ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেছে। চারপাশ লণ্ডভণ্ড, ভেঙ্গে সব চুরমার। এই সকাল বেলা সাহেব আর মেম ছোট নারকেল গাছটার পাতায় বসে গুড়িয়ে পড়ে থাকা ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে অসহায় অস্থির চোখে। আর বশির গাজি পাথরের মত বসে আছে উঠানে শূন্য বুকে, শূন্য দৃষ্টি নিয়ে। সে কিছুই ভাবতে পারছে না, শুধু এক বোবা হাহাকার। তার কেবলই বুক ফেটে কান্না আসছে কিন্তু কাঁদতে পারছে না।
 
এইভাবে কতটা সময় পার হল জানি না। হঠাৎ সাহেব আর মেম ডেকে ওঠায় বশির গাজি তাদের দিকে তাকালো। দেখল উড়ে কোথায় জানি চলে গেল সাহেব আর মেম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বশির গাজি। পরক্ষণেই দেখল সাহেব আর মেম ফিরে এসে সেইখানেই বসে ডাকছে --" চিড়িৎ চিড়িৎ কিচ কিছ"। দুজনের ঠোঁটে দুটো খড়খুটো। বশির গাজি চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপর উঠে পড়লো। ভাঙ্গা ঘরে খোঁজাখুঁজি করে একটা কোদাল বের করে হাতে নিল।

এনএস/