ঢাকা, সোমবার   ০৬ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২২ ১৪৩১

তিনটি জীবনের মূল্য সাড়ে তিন লাখ! সমালোচনার ঝড়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৫১ পিএম, ২৩ জুন ২০২০ মঙ্গলবার

আট মাসের তানহা কোলে নিয়ে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর আহাজারী।-ছবি একুশে টেলিভিশন।

আট মাসের তানহা কোলে নিয়ে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর আহাজারী।-ছবি একুশে টেলিভিশন।

সাড়ে তিন লাখ টাকা। তিনটি জীবনের মূল্য। নৌকাডুবিতে নিহত তিনজনের পরিবারকে এই মূল্য পরিশোধ করবেন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। এমনটাই নির্ধারিত হয় সোমবার (২২ জুন) সকালে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষের নিকটআত্মীয় জাকির হোসেন, ম্যানেজার রব্বানী ও ঘাট সুপারভাইজার বাবলু নামে তিন জনের উপস্থিতিতে স্থানীয় তিন প্রভাবশালীর এই মূল্য নির্ধারণে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ স্থানীয়দের মাঝে।

ঢাকা থেকে কালাইয়ার উদ্দ্যেশে ছেড়ে আসা মেসার্স শেখ ব্রাদার্স ওয়াটার ওয়েজ কোম্পানির ঈগল- ৪ নামে ডবলডেকার লঞ্চের ড্রাইবার হানিফ মিয়া, ইন্সপেক্টর আলমগীর হোসেনসহ কর্মচারীদের অসতর্কতায় গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) সকালে পটুয়াখালীর বাউফলের নুরাইনপুর আলগী নদীতে ওই লঞ্চের থাক্কায় নৌকাডুবিতে উদ্ধারের পর মারা যায় আনোয়ার হোসেন (৩২) নামে স্থানীয় এক চায়ের দোকানী যুবক। আর আসলাম-জান্নাত দম্পত্তির লাশ উদ্ধার করা হয় ঘটনায় নিখোঁজের পর দিন শুক্রবার।

জানা গেছে, স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা ওই ঘটনার পরে লঞ্চের ড্রাইভার, ইন্সপেক্টরসহ কর্মচারীদের অসতর্কতার কারণ দেখিয়ে একই ঘাটে ওই দিন লঞ্চটিকে আটক করলে সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়ে স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার হস্তক্ষেপে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। সোমবার সকালে ওই বিষয়ে দুর্ঘটনাস্থল নুরাইনপুর লঞ্চঘাট এলাকার একটি ভবনে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন লঞ্চটির মালিকের শ্যালক জাকির হোসেন, ম্যানেজার রব্বানী ও ঘাটের সুপারবাইজার বাবলু নামে তিন জনকে নিয়ে জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ স্থানীয় এমপি আ. স. ম ফিরোজের ছোট ভাই ব্যাবসায়ী একেএম ফরিদ আহম্মেদ, আ’লীগ নেতা স্থানীয় কেশবপুর ইউপির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন লাভলু ও স্থানীয় আব্দুস সালাম নামে তিন প্রভাশালী। 

বৈঠকে তারা নির্ধারণ করেন- নিহত আসলাম-জান্নাত দম্পত্তির প্রত্যেককে এক লক্ষ টাকা ও আনোয়ার হোসেন নামের অপর যুবকের জীবনের মূল্যে দেঁড় লক্ষ টাকা হিসেবে তাদের পরিবারের লোকজনকে মোট সাড়ে তিন লক্ষ টাকা পৌঁছে দিবেন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ।

নিখোঁজদের স্বজন ও স্থানীয়রা জানায়, আসলাম-জান্নাত দম্পত্তি কেশবপুর ইউপির ভরিপাশা গ্রামে বাড়ি থেকে লকডাউনে ফেলে আসা বকেয়া বেতন তুলতে নারায়নঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জ ইপিজেড এলাকায় জানাতের কর্মস্থল একটি গার্মেন্টের উদ্দেশে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ঈগল-৪ লঞ্চে বাড়ি ফেরার উদ্দ্যেশে ওই লঞ্চে চেপে বসেন। ওই সময় তারা বাড়িতে রেখে যান তাদের আট মাস বয়সী তানহা নামে একমাত্র শিশু সন্তান। আসলাম-জান্নাতের মৃত্যুতে এখন এক অনিশ্চয়তায় পড়েছে তাদের ওই হতভাগ্য শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ। 

এদিকে, আসলামের মা আলোমতি, বাবা আলম শরীফ এবং জান্নাতের বাবা পৌর সদর এলাকার জালাল মোল্লা ও মা সাজেদা বেগম বৈঠকের এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নন। উপরন্তু ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে অপরাধীদের বিচার দাবি করছেন তারা। দুর্ঘটনার সঠিক তদন্ত করে বিচারের দাবি জানিয়েছেন আনোয়ারের আত্মীয়-স্বজনরাও।

আসলাম-জান্নাত দম্পতি ও আনোয়ারের নিহতের ঘটনায় তাদের জীবনের এমন মূল্য নির্ধারণে প্রভাবশালীদের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্থানয়ীরাও। ঘটনার তদন্ত করে বিচারের দাবি জানিয়ে সেলিম, মামুন, শাহজাহান, জালাল চৌকিদার, শাহআলম হাওলাদার, আবুল কালাম, আলমগীর হোসেন, নান্নু নামে স্থানীয় কয়েকজন প্রায় অভিন্ন বলেন, ‘লঞ্চের ড্রাইভার (মাষ্টার) হানিফ মিয়াসহ লঞ্চ স্টাফদের অসতর্কতার মতো কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রভাবশালীরা ইচ্ছে করলে ক্ষতিপূরণে টাকা পয়সা ব্যয় না করলেও পারবেন। আইন আদালত এখন তাদের কথায় চলে। কি ভবিষ্যৎ আছে আসলাম-জান্নাতের অবুঝ শিশু তানহার এখন। প্রভাবশালীরা নিহতের অস্বচ্ছল পরিবারের সহজ-সরল লোকদের মিমাংসার লোভে ফেলে থানায় মামলা দিতেও দেয়নি।’

এ বিষয়ে ঈগল-৪ লঞ্চের মালিক আব্দুল জব্বার মিয়া তার ম্যানেজার রব্বানীর কাছে জানা যাবে উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে আপোষ-মিমাংসা করা হয়েছে।’ তবে ম্যানেজার রব্বানি বলেন, ‘স্থানীয় ফরিদ আহম্মেদ ও চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তে ফয়সালা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনদের ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।’ 

এ ব্যাপারে কেশবপুর ইউপির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘আমি সকালে মিটিং শুরু করে জরুরী প্রয়োজনে ঢাকা চলে এসেছি। আসলাম ও জান্নাতের শিশু মেয়েকে ২ লক্ষ টাকা আর আনোয়ারের পরিবারের লোকজনদের দেঁড় লক্ষা টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

এ ব্যাপারে একেএম ফরিদ আহম্মেদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। লঞ্চ মালিকদের সাথে নিহতের  পরিবার আপোষ মিামংসা করছে।’

এ ব্যাপারে বাউফল থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শুনেছি টাকা-পয়সা নিয়ে আপোষ মিমাংসা করা হয়েছে। নিহতের পরবিারের কোন অভিযোগ না থাকায় মামলা হয়নি।’

এনএস/