ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

করোনায় বদলে যাওয়া বাংলাদেশ

মো সাগর হোসেন

প্রকাশিত : ০৮:১২ পিএম, ২৩ জুন ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৮:১৭ পিএম, ২৩ জুন ২০২০ মঙ্গলবার

বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে৷ যার ফলে বাংলাদেশের সকল কর্মকান্ড স্থবির হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। লকডাউনে বন্দী হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। করোনা পূর্বের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য৷ এ যেন এক না চাওয়া পরিবর্তিত বাংলাদেশ। করোনায় বাংলাদেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এক নেতিবাচক পরির্তন সাধিত হয়েছে। যা দেশ ও জাতির জন্য হুমকী স্বরুপ।

বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় করোনায় সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। রপ্তানি ও প্রবাসী ক্ষেত্রে আয় কমেছে ব্যাপকভাবে। গত বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে এই বছরের এপ্রিল মাসের অর্থবছরে রাপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৮৩%। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা যায় চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাসে দেশের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ সময় আয় হয় মাত্র ৫২ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে এই আয় ৮২ দশমিক ৮৫ কোটি ডলার কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৮৫.৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের এই সময় আয় ছিল ৩০৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। আবার এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮% নেমে দুই কিংবা তিন শতাংশ হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সকল ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকছে। ফলে তারা আশানুরূপ আয় করতে পারছে না। বড় বড় শিল্প কারখানা বন্ধ থাকার কারণে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালিক তার থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আবার করোনার কারণে অনেক পেশীজীবি মানুষ তাদের চাকুরী হারাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে করোনায় রাজনীতির চিত্র অনেক বদলে গিয়েছে ৷ বর্তমানে রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ডই পরিচালিত হচ্ছে ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে। নেতারা তাদের কর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন স্কাইপি, গুগল মিট বা জুম এ্যাপ এর মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়,স্কুল, কলেজের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এর বাহিরে নয়। সবাই যার যার অবস্থানে নিরাপদ থেকে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। সরকার দলের এবং বিরোধী দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা মাঝে মাঝে সংবাদ সম্মেলন করলেও সেটা বিশেষ ব্যবস্থা রেখে করছে। এখন আর কোন রাজনৈতিক মিছিল,সমাবেশ ইত্যাদি হয় না। আগের মত রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নেই কোন আমেজ। বিভিন্ন এলাকার জনপ্র‍্যুতিনীতিরাও তাদের মূল্যবান বক্তব্য সবার মাঝে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে। এ যেন এক অন্যরকম রাজনীতি।

শিক্ষা ক্ষেত্রেও এসেছে এক নেতিবাচক পরির্তন। বছরের শুরুতেই শিক্ষা মন্ত্রনলায়,শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীরা তদের এক বছরের একটি পরিকল্পনা করে নেয় যে কিভাবে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হবে৷ ঠিক এমনিই ভাবেই এই বছরের শুরুতেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে রেখে ছিলো শিক্ষা অঙ্গনের সকলেই। কিন্তু করোনা সকলের লক্ষ্যকে স্থবির করে দিলো। করোনার প্রাদুর্ভাব এর কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় মার্চ এর শুরুতে। স্থগিত হয়ে যায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ২০২০৷ শিক্ষার্থীরা একটা ঘোরের মুখে পড়ে গিয়েছে কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির সময়সীমা বেড়েই চলেছে। যার ফলে পরীক্ষা এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার সঠিক সময়ে এস এস সি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও করোনার কারণে ফলাফল প্রকাশিত হয় ১ মাস পরে৷ আবার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরেও এখনো শুরু হয়নি উচ্চমাধ্যমিক ১বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাসে এর ব্যবস্থা থাকলেও প্রযুক্তির স্বল্পতার কারণে কোন শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ গ্রহণ করতে পারে। যার ফলে একাংশ শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ছে। বি বি সি বাংলার এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষকরা জানায় যে, "করোনায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের উপর"। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বাসার থেকে স্কুলে শিখে বেশী। আর তাদের সবথেকে আন্দদের জায়গা হচ্ছে স্কুল। সকালে নিয়ম করে স্কুলে যাওয়া,বাড়ি ফেরা,পড়তে বসা ইত্যাদি সব এখন অনিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলসূশ শিশুরা তাদের শিক্ষা ভুলতে শুরু করেছে। সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তদের সময়ের বড় অংশ ব্যয় করছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

মানুষের কাজ-বিনোদন-ভ্রমণ দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, নেতিবাচক পরির্তনের সাথে সাথে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এর প্রভাব পড়েছে এগুলাতে। মানুষ এখন সভ্য জাতির মতই একজনের থেকে আরেকজন নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে লাইনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দ্রব্য ক্র‍য় করছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাহিরে যাচ্ছে না। করোনার আগেও বিভিন্ন উৎসবে বিনোদন বলতে ছিলো নাচানাচি,জোরে গান বাজানো, বাজি ফোটানো ইত্যাদি। কিন্তু করোনার পরে মানুষের মধ্যে একটা পরিবর্তন চলে এসেছে। এখন কোন উৎসবে আর এগুলা না বরং সামাজিক দূরত্ব ও সকলের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই সবকিছু পালিত করছে। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে লকডাউন উঠে গেলে তখন আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায় কিনা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন লকডাউন থাকুক বা উঠে যাক আমরা যেভাবে চলাফেরা করি, কেনাকাটা করি,বেড়াতে যাই,কাজ করি, পড়াশুনা করি এই সমস্ত কিছুই আমূল বদলে দিতে যাচ্ছে করোনা ভাইরাস।

করোনায় সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প। বাংলাদেশের প্রায় সকল পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে কোরোনার জন্য। দীর্ঘ তিন মাস ধরে প্রায় শূন্য হয়ে রয়েছে বাংলাদেশের পর্যটন কেদ্রগুলো। কোরনার কারনে আজ সুনশান নিরবতা বিরাজ করছে দর্শনীয় স্থান গুলোতে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর তথ্য মতে , করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে ‘মৃত প্রায়’ পর্যটন শিল্পে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ খাত সংশ্লিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী এখন বেকার।


না চাইতেই চলে এসেছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনগুলো। ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক পরিবর্তনই বেশী। এই নেতিবাচক পরিবর্তনের উপেক্ষা করে উঠতে অনেক কাঠকড়ি পুড়াতে হবে। যা বাংলাদেশ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব হবে না৷ সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে এগিয়ে আসতে হবে করোনা পরবর্তিতে৷ তবেই আমরা ফিরে পাবো পুরাতন বাংলাদেশকে কিছু নতুন ইতিবাচক পরিবর্তন এর সাথে।

আরকে//