ঢাকা, সোমবার   ০৬ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

তোমার বাড়ী কই গো, নারী?

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০২:৪১ পিএম, ১৫ জুলাই ২০২০ বুধবার

গতরাতে ‘করোনাকালীন সময়ে ঘরোয়া সহিংসতার প্রতিরোধ ও প্রতিকার’ বিষয়ে একটি খুব অর্থবহ আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম। সঞ্চালনা করেছিল আফরিদা জিননুরাইন উর্বী। পুরো আলোচনাটির প্রেক্ষিত শিরোনাম ছিল- ‘বাড়ী তোমার কই গো, নারী?’

খুব সম্ভবত: কোন এক গ্রাম্য-গাথার অংশ চরন দু'টো। 'বাবার বাড়ী এই গাঁয়ে, শ্বশুর বাড়ী ঐ, তোমার বাড়ী কই গো নারী, তোমার বাড়ী কই?' ঐ পংক্তি দুটো কেন জানি নাড়িয়ে দিয়ে গেল আমাকে। মাথার মধ্যে ঘুরতেই থাকল কোন একটা 'বোধ কাজ করার' মতো। হঠাৎ করে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া মা'কে মনে পড়ল, একটা ভাবনা জুড়ে বসল গোটা হৃদয় জুড়ে।

সে ভাবনার তিনটে দিক - এ গাথার অন্য চরনগুলো কি, পুরো গাথাটির অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যাটি কি এবং এর প্রশ্নটির শেষ উত্তরটি কি? এ দিক- সে দিক খুঁজে পেতে, এটা-ওটা ঘেঁটে গাথার বাকী চরন গুলো উদ্ধার করা গেল।

'সারা জীবন ভাত রাঁধলি পরের হাঁড়িতে,
আপন ভেবে বাস করলি পরের বাড়িতে,
যেমন পরের ঘরে বেঁধে বাসা
বাস করে চড়ুই।
তোমার বাড়ী কই গো নারী,
তোমার বাড়ী কই?

শিশুকাল আর কৈশোর কাটে বাবার আশ্রয়ে,
যৌবন কাটে স্বামীর সাথে শ্বশুরালয়ে,
বৃদ্ধকালে আশ্রয় নাই আর
ছেলের কাছে রই।
তোমার বাড়ি কই গো নারী?
তোমার বাড়ি কই?'

পুরো কবিতাটি শেষ করে একটা ধূসর বিষাদে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল তিনটি কারণে। প্রথমেই মনে হলো- নারীর 'কে' স্বত্ত্বা বলে কিছু নেই, তার পরিচয় সে 'কার' - শৈশবে এবং কৈশোরে 'পিতার', যৌবনে 'পতির' এবং বৃদ্ধকালে 'পুত্রের'। সারা জীবনে তার কোন নিজস্ব কোন আত্মপরিচয় নেই। যখন যে পাত্রে রাখা হচ্ছে, সে পাত্রের আকারই সে ধারণ করছে।

তারপরেই মনে হলো- সারা জীবনে নারীর কোন ঠিকানা নেই - সে চির ভাসমান, স্থায়ী যাযাবর। জীবনে চলার পথে শুধু ঠিকানা বদল হয় তার - এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে, এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, এক শহর থেকে অন্য শহরে। তার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে কোন ঠিকানা বলবে একজন নারী? তার কি আসল কোন ঠিকানা আছে? একটি কাঙ্খিত, প্রার্থিত, নিজস্ব ঠিকানা সে কখন খুঁজে পাবে?

ঐ স্বত্ত্বার কথায় আর ঠিকানার কথায় হারিয়ে যাওয়া মা'র কথা মনে পড়ে গেল অকস্মাৎ, কত দিন পরে। আমরা যখন বাড়ী থেকে বেরুতাম, তখন মা দরজা পর্যন্ত আসতেন, তার বেশী নয়। ওখানেই তো গন্ডি বাঁধা ছিল তাঁর - সীতার গন্ডির মতো। মাঝে মাঝে দেখতাম, জানালার পর্দা ঈষৎ সরিয়ে চলমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন পলকহীন দৃষ্টিতে। বাইরের জগত থেমে নেই, জনস্রোত চলছে - তিনি আটকা পড়ে আছেন তাঁর দ্বিতীয় ঠিকানায়। মাসের পর মাস ঘর থেকে বেরোন নি, ঘরের ঐ টুকু জগতের মধ্যেই তাঁর আনাগোনা, ঐ তার পৃথিবী।

শেষ যে কথাটি আমার ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তাহলে নারী কি কোনদিনই নিজের একটি ঠিকানা খুঁজে পাবে না? কখন পাবে, কবে, কোথায়? অনেক ভেবে দেখলাম, শেষতক একটা নিজস্ব ঠিকানা নারী খুঁজে পায় বৈকি - প্রার্থিত নয়, কাঙ্খিতও নয় - কিন্তু একটি নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানা, যখন সে শেষ শয্যা গ্রহণ করে - ভূমিতে কিংবা চিতায়। ঐ বাড়ী থেকে তাকে আর চ্যুত করা যায় না। ঐ ঠিকানা আর তার বদল করতে হয় না, চির শান্তিতে সেখানে সে রয়ে যায় অনন্তকাল। আমার মনে হয়, ওপরের গাথাটির শেষ চরনগুলো হয়তো এ রকম:

'মরণ পরে যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়ি আমি,
সে মাটিই আপন আমার, সারা দিবস-যামি।
বাড়ি আমি খুঁজে নিলাম,
এ বাড়িই সই।
কেউ কখনো বলবেনা আর
তোমার বাড়ী কই?'

এনএস/