ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু আছেন এবং থাকবেনও

আমিনুল হক বাদশা

প্রকাশিত : ০২:৩২ পিএম, ২১ জুলাই ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:৫০ পিএম, ২৭ জুলাই ২০২০ সোমবার

১৭ মার্চ। বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি বিশেষ স্মরণীয় দিন। ১৯২০ সালের এই দিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ১০০ বছর। কিন্তু ঘাতকরা তাকে বাঁচতে দেয়নি। সপরিবারে তারা তাকে হত্যা করেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আদালতের দেয়া তার ঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হলো না। এ লজ্জা জাতি রাখবে কোথায়? 

সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি তার অসীম ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাহস, প্রজ্ঞা, বলিষ্ঠ এবং আপোসহীন নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতিকে অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে এক সংগ্রামী জাতিতে পরিণত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একই আদর্শে বিশ্বাসী তাঁর একান্ত রাজনৈতিক সহচর তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ। আর ছিল বাঙালি শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রশিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের জনগণ।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন লেখক, কবি, সাহিত্যিক অনেক মন্তব্য করেছেন। আমি এখানে তাদের কয়েকজনের উদ্ধৃতি দেব। বঙ্গবন্ধুকে একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আখ্যায়িত করেছেন ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলে। সত্যিই তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত যেমন সাধারণ মানুষের ভাষায় কবিতা লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু সেই ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন।

তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গের ঐতিহাসিক ভাষণের সঙ্গে অনেকেই তার তুলনা করেছেন। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক সিডনি সেনবার্গ (বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু) মন্তব্য করেছেন যে, মুজিব বাঙালি জাতির একটি পবিত্র সম্পদ। এ পবিত্র সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব বাঙালি জাতির। ৭ মার্চের ভাষণে আমেরিকার সিভিল লিবার্টি আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর ‘মাই ড্রিম’ ভাষণের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও অধিনায়ক। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘ক্রাই দ্য বিলাভড কান্ট্রি’- ‘কাঁদো প্রিয় দেশ কাঁদো’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, এ ক্রন্দন অন্তুরের স্বতঃস্ফূর্ত ক্রন্দন। সত্যিই আজও বাঙালি জাতি কাঁদছে শেখ মুজিবের জন্য। এ ক্রন্দনের শেষ নেই। এ আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কেএম সোবহান বলেছেন, শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দীন হোসেন বলেছেন, সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, মৃতুঞ্জয় মুজিব। স্বনামধন্য কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন, শেখ মুজিব দেশকে দুবার স্বাধীন করেছেন। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবের আপোসহীন সাহসী নেতৃত্বের জন্যই পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালিরা জয়ী হয়েছে।’

মিশরের প্রখ্যাত সাংবাদিক হেইকেল মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরের জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে তুলনা করে শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘শেখ মুজিব ইজ এ গ্রেট লিডার।’ সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, জয় বাংলার মহানায়ক শেখ মুজিব। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব শন ম্যাকব্রাইট শেখ মুজিবকে ‘বাংলাদেশের আত্মা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া ফরাসি বিপ্লবের নায়ক চার্লস দ্য গলের মতো তাঁর নেতৃত্ব ছিল বলে আঁদ্রে মালরোঁ মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে আঁদ্রে মালরোঁ জীবনের মূল্যবান সময়ে কারাবরণকারী মানবপ্রেমের যোদ্ধা অসহযোগের বীর মুজিবকে তাঁর অন্তরে কিংবদন্তির নায়কের স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন।

নাৎসিবিরোধী প্রতিরোধে ফরাসি বীর মালরোঁ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে একজন দূরস্থির সৈনিক ছিলেন। কী আশ্চর্য, ফরাসি আর বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার সেতুবন্ধন বেঁধে দিয়েছেন মালরোঁ! আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মালরোঁ গুরুত্ব সহকারে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি একজন কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক সৈনিক। তিনি তার বর্ণাঢ্য জীবনের সব পর্বে বিশ্বাসের সত্যতা খুঁজেছেন কর্মে, বাস্তবের প্রয়োগে। তিনি লেখনী ছেড়ে অস্ত্র ধরেছিলেন স্পেনের প্রজাতন্ত্রের পক্ষে তিরিশের দশকে। আবার সত্তর দশকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চাইলেন। কথায় নয়, একটি ট্যাঙ্ক বহরের পরিচালক হিসেবে। তখন বয়স তার ৭০ বছর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের পরামর্শও দিয়েছেন। 
 
এই তথ্য আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। তাঁর জীবনের মতো শেখ মুজিবও অনেকবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন। বাংলাদেশে কোনো কোনো ক্ষমতালোভী ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করলেও বিশ্ব-ইতিহাসে যেসব জাতীয় মুক্তিনায়কের নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামও আসন করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে। এ ইতিহাস মনগড়া ইতিহাস নয়। এ ইতিহাসকে ম্লান করা যাবে না। যারা ইতিহাসের সত্য থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে, কালের ইতিহাসে তারাই হারিয়ে যাবে।
 
৬ দফার ম্যান্ডেট নিয়ে কার নেতৃত্বে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, কার বকণ্ঠের ডাকে আপামর জনতা মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, বাঙালি জাতির চেতনাকে সমুন্নত রাখা ও বিকাশের জন্য কার নির্ভীক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেশবাসীকে অসহযোগ আন্দোলনে চালিত করেছে, বাঙালির স্বাধীনতার জন্য ক্ষমতাকে পদদলিত করে, জনতার দাবির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পথে বেছে না নিয়ে কে আপোসহীন সংগ্রাম করেছেন? এসব প্রশ্নের জবাবে একটিমাত্র নামই উচ্চারিত হবে ইতিহাসে— তিনি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।
 
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা বাঙালি জাতির অপমৃত্যুর শামিল হবে। বঙ্গবন্ধুর অভাব আজ আমরা তিলে তিলে অনুভব করছি। মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আজ যারা নানা কথা বলছে তাদের জন্য কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়-
 
রথ ভাবে আমি দেব
পথ ভাবে আমি, 
সূর্য ভাবে আমি দেব
হাসে অন্তর্যামী। 

তাই সবশেষে আবারও বলছি- বাঙালির প্রাণে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আছেন, আর থাকবেনও।

এনএস/