ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ফিরে দেখা ১৯৯৮ এর বন্যা

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ০১:৩৮ পিএম, ২৩ জুলাই ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৫:১২ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার

১৯৯৮-র প্রলয়ংকরী বন্যায় সাভার সেনানিবাস থেকে একটি ছোট দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে টাঙ্গাইল সদরে অবস্থান নেই। সময়টা ছিল সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগ। তখন বন্যার পানি কমে গেছে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গেছে। আমাদের প্রাথমিক ত্রাণ তৎপরতা যা ছিল বন্যাদুর্গত মানুষকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর এবং তৈরি খাদ্য বিতরণ, তা আর দরকার নেই। মানুষ ফিরে যাচ্ছে তার বিধ্বস্ত ঘরবাড়িতে। টাঙ্গাইল শহরের স্থানে স্থানে স্যালাইন বিতরণের স্পটগুলোতে তেমন ভিড় নেই। টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে বসে অলস কাটছে দিন।

হঠাৎ মনে হলো এভাবে সার্কিট হাউজে বসে টিভি দেখে আমি অন্যায় করছি। শহরের বাইরের চিত্রটি কেমন, তা জানা দরকার। আমার সহযোদ্ধা ডাক্তার ক্যাপ্টেন ফয়েজকে পাঠালাম শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে খোঁজ নিতে। ফিরে এসে সে জানালো টাঙ্গাইলের চর কাকুয়া ইউনিয়নে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশ। 

বন্যার পর পানি নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানির উৎসগুলো: পুকুর, নলকূপ, পাঁতকুয়াগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ডায়রিয়ার প্রকোপে প্রচুর লোক আক্রান্ত। মৃত্যুর খবরও আছে বেশ। সিভিল সার্জনকে জানালে তিনি প্রথমেই ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন। আমাদের চাপাচাপিতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন চিকিৎসককে আমাদের সাথে চর কাকুয়াতে মেডিক্যাল মিশনে যেতে নির্দেশ দিলেন।

আমি শহরে বড় হওয়া মানুষ বলে দুর্গম চরাঞ্চলে ডায়রিয়া অথবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র আমার কাছে অনেকটাই অচেনা ছিল। সত্য বলতে কি, আমি টাঙ্গাইল শহরের বাইরে যেতে চেয়েছিলাম। আমার কাছে রক্ষিত দুটো স্পিডবোট, বোনাল্ড ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্সগুলো জনগণের কাজে সর্বোত্তম ব্যবহৃত হোক- এই প্রত্যাশায়।

পরদিন সকালে সার্কিট হাউস থেকে যাত্রা শুরু করলাম চর কাকুয়া ইউনিয়নের উদ্দেশ্যে। যমুনা ব্রিজের কাছে এসে অ্যাম্বুলেন্স এবং ট্রাক রেখে দুটো স্পিডবোটে দু’জন ডাক্তার এবং কয়েকজন মেডিক্যাল সহকারী সৈনিকসহ যমুনার প্রবল স্রোতে গা ভাসালাম। কিছুক্ষণ চলার পরে দেখা মিললো গ্রামটির। বন্যায় ফেলে যাওয়া পলির নীচে অধিকাংশ বাড়িঘর অর্ধসমাহিত। আমাদের দেখে তীর ধরে এগিয়ে আসছে বন্যার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে যাওয়া প্রায় কঙ্কালসার অনেক মানুষ। আমাদের সাথে দেবার মতো তখন আছে কিছু বিস্কুট, কিছু হাতে বানানো স্যালাইন এবং নানাবিধ ওষুধ। গ্রামের লোকজন হাত বাড়িয়ে হাতে বানানো স্যালাইনগুলো নিলো অনেকটা মহার্ঘ বস্তু হিসাবে। অনেক শালীনতা সহকারে, দু’হাত একসাথে জড় করে। একটা জায়গায় এসে স্পীডবোট থামিয়ে নদী তীরবর্তী কয়েকটা ঘরে উঁকি দিলাম। দেখলাম, বালুতে অর্ধ সমাধিপ্রাপ্ত ঘরের দাওয়ায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুণছে। ক্রমাগত পায়খানা করার ফলে পানিশূন্য দেহের চামড়া কুঁচকে গেছে, চোখ কোঠরাগত। পায়খানা করে বলে পরিবারের লোকজন রোগীকে কোন ধরনের পানীয় তাদেরকে দেয়নি। আমার সাথে দু’জন ডাক্তার এবং চিকিৎসা সহকারী দ্রুত হাতে আমাদের কাছে রক্ষিত স্যালাইন পুশ করলো।

এবার নিকটবর্তী স্কুলে এসে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে খবর দিলাম। ততক্ষণে আমাদের চারপাশে অনেক গ্রামবাসী জড় হয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশাকে বর্ণনা করতে লাগলো। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রতি ৫ বছরে একবারই আসেন ভোটের সময়। তারপর আর তাদের দেখা মেলে না। সেই পুরনো গল্প। চেয়ারম্যানের দেখা মিললো। তার সামনে কপট রাগ দেখালাম, জনগণের এই অবস্থায় তার নিষ্ক্রিয়তার জন্য। এখন সমস্যা হলো আমরা যাদের শিরায় স্যালাইন পুশ করেছিলাম, তাদের প্রথম ডোজ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডোজ স্যালাইন দিতে হলে আমাদের কয়েকজন চিকিৎসা সহকারীকে রাতের জন্য রেখে দিতে হবে। অতএব, তাদের রাত্রি যাপন এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সে প্রস্তুতি ছিল না। 

চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিলেন তদের দেখাশুনা করার জন্য। কিন্তু আক্রান্তদের মধ্যে ১৯ জন ছিলেন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ডাক্তার বললো, এদের অতিদ্রুত সম্ভব সদর হাসপাতালে নিতে হবে নিবিড় পরিচর্যার জন্য। নতুবা এদের বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আমাদের স্পীডবোটের যে ধারণ ক্ষমতা তা রোগী বহন করার জন্য যথেষ্ট নয়। অতএব, প্রয়োজন দেখা দিল ইঞ্জিনচালিত নৌকার। চেয়ারম্যান ব্যবস্থা করলেন নৌকার। ওটাতেই উঠানো হলো ১৯ জন মুমূর্ষ রোগীকে, সাথে তাদের দেখাশুনা করার জন্য রোগীদের কয়েকজন স্বজনকে। আমাদের তাড়া ছিল সন্ধ্যার আগেই প্রমত্ত যমুনার উল্টো স্রোত ঠেলে যমুনা সেতুর গোড়ায় আমাদের পার্ক করা অ্যাম্বুলেন্স এবং ট্রাকে পৌঁছানোর। ভালোয় ভালোয় পাড় হয়ে এলাম যমুনা। রোগীদের তোলা হলো অ্যাম্বুলেন্স এবং ট্রাকে, পিকআপে। টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে পৌঁছালে দেখা দিল আরেক সংকট। রোগীদের দেওয়ার মতো স্যালাইন এবং ওষুধ নেই। কর্মরত নার্স এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের আত্মীয় স্বজনদের বললো বাইরের দোকান থেকে কিনে আনতে। আমাদের কাছেও তখন পর্যাপ্ত ইনট্রা ভেইন স্যালাইন নেই। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক ছুটে এলেন। সিভিল সার্জনের দেখা মিললো। জেলা প্রশাসক ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অব্যবস্থা দেখে। উনি বললেন, কিছুদিন আগেই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য ওনার ফান্ড থেকে প্রচুর ওষুধ-চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কিনে দিয়েছেন। সেসব কোথায় গেল? উনি তাৎক্ষণিকভাবে যেখান থেকেই হোক ওষুধের ব্যবস্থা করার জন্য সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দিলেন। সদর হাসপাতালের ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রী বাইরে পাচার হয়ে যায়। গরীব মানুষ একটা সাধারণ ব্যান্ডেজ পর্যন্ত এখান থেকে পায় না। তিনি অনেক দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।

এবার আরেকটি সমস্যা দেখা দিলো, রোগীদের সাথে আসা স্বজনদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ওরা আমাদের কাছেই অনুযোগ করলো, তারা গরীব মানুষ হাতে পয়সা নেই। আমি যখন অতি উৎসাহে এদের সাথে করে নিয়ে এসেছি, এবার দায়টা যেন আমারই হলো। যাই হোক সৈনিকদের বরাদ্দকৃত রেশন থেকে এদের কয়েকজনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে খাবারের ব্যবস্থা করে দিলাম।

পরদিন সকালে যেয়ে দেখি, সাথে করে আনা রোগীগুলো ২/৩টা স্যালাইন পুশ করার পরেই বেশ সহেজ হয়ে উঠেছে। অথচ গতকালই এদের অনেকের কথা বলার, নড়াচড়া করার মতো অবস্থা ছিল না, নাড়ীর অবস্থানই খুঁজে পাচ্ছিলো না নার্সরা। আর আজ দিব্যি কি সচল!

দ্বিতীয় দিনের অভিযানে এবার আমাদের সাথে শরীক হলেন স্বয়ং জেলা প্রশাসক এবং সিভিল সার্জন। স্থানীয় সংবাদপত্রে ততক্ষণে হেডলাইন ‘টাঙ্গাইলের চর এলাকায় ঘরে ঘরে ডায়রিয়া-সেনাবাহিনীর ত্রাণতৎপরতা।’ স্কুল প্রাঙ্গণে স্থাপিত অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প ঘিরে ততক্ষণে অনেক চিকিৎসাপ্রার্থী গ্রামবাসীর সমাগম হয়েছে। জেলা প্রশাসক এবং আমাদের দেখে এন্তার অভিযোগ করতে লাগলো। কিন্তু সিভিল সার্জন অনেকটাই ‘ডেনায়েল মোডে’। উনি এটাকে ‘কলেরা’ হিসাবে মানতে না রাজ এবং কেউ ডায়রিয়ায় বা কলেরায় মরেছে, এটাও তিনি মানতে নারাজ। কয়েকজন রোগীকে উনি খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে গেলেন, এক রোগী ওই স্যালাইন পেটে রাখতে না পেরে তার গায়ের উপরই বমি করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ডায়রিয়া বা কলেরায় মৃত্যু হয়েছে গ্রামবাসীর এমন অভিযোগ উনি অস্বীকার করলেন না। 

জেলা প্রশাসককে নিয়ে আমরা গ্রামের একটু ভেতরে ঘুরে এলাম। টের পেলাম ডায়রিয়া ছড়ানোর মাত্রাটা কত ব্যাপক হয়েছে। জেলা প্রশাসকের সহায়তায় এবং সেনাবাহিনীর তদারকিতে স্কুল প্রাঙ্গনেই একটা অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপিত হলো। তৃতীয় দিনে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে হাজির হলো Medecins Sans Frontieres (MSF) সীমান্তবিহীন চিকিৎসকের একটি দল। তারা আমাদের কর্মকাণ্ড দেখলো এবং অনেক প্রশংসা করলো। তারা আমাদের চিকিৎসা সেবায় কিভাবে সহায়তা করতে পারে সে বিষয়ে আলোচনার জন্য টাঙ্গাইল শহরে তাদের অফিসে নিমন্ত্রণ করলো। 'MSF' এর লজিস্টিক সাপোর্টে আমাদের কর্মকাণ্ড আরো জোরদার হলো। বিশেষ করে ওদের ডাক্তার এবং স্থানীয় এনজিও কর্মীদের সম্পৃক্ততায়। এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম ছিল ৫ বছরের শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো!

টাঙ্গাইলের দুর্গম এই চরে ভ্যাপসা গরমের মধ্যে কর্মব্যস্ত কয়েকটি দিন ছিল আমার জীবনের সেরা কয়েকটি দিন। সার্কিট হাউজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে শুয়ে-বসে যে অপরাধবোধ তৈরি হয়েছিল তা দূর হলো। সেবার দেখেছি একটা সাধারণ খাবার স্যালাইন বা এক গ্লাস সুপেয় জল কিভাবে জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। ছোট ছোট শিশুদের ক্যাপসুল খাওয়ানোর স্মৃতি এক অসাধারণ অনুভূতি।

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

একে//