ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

শ্মশান ঘাট দখল নয়

অর্নিতা দাস

প্রকাশিত : ০২:৪৭ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০২:৫০ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২০ বৃহস্পতিবার

মঠ বা সমাধি শব্দটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কারণ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অন্তিম গন্তব্য শ্মশান বা কবরস্থান। মৃত ব্যক্তিকে যেখানে সমাহিত করা হয় এবং মৃত ব্যক্তির প্রতিকৃতি হিসেবে স্তম্ভ তৈরি করা হয় সাধারণত তাকেই আমরা মঠ বলি।

তবে মঠ বা স্মৃতি স্তম্ভ নিয়ে আজ এখানে কিছু বলবো। বলা যায় এক্ষেত্রে আমার কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং দ্বিমত আছে। যেমন, মৃত ব্যক্তিকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করা হবে বা মঠ কেন করা হয় এসব নিয়ে আজকের কথামালা। সাধারণত মৃত ব্যক্তির পৈতৃক নিবাসেই তার শেষকৃত্য করা হয়। তবে স্থানসংকুলানের জন্য সরকারি শ্মশানেও সমাহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখানেও কিছু বৈষম্য দেখা যায়। যেমন, যার আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে, সে তার পিতা-মাতার সমাধি তৈরি করার জন্য সরকারি অনেকটা জায়গা জুড়ে স্তম্ভ করে থাকেন। বলা যায়, অহেতুক অর্থ অপচয় করেন। আবার একই স্থানে দেখা যায় অনেকে আর্থিক সংকটের কারণে সংকীর্ণ জায়গায় ছোট করে বাবা মায়ের সমাধি তৈরি করেন। এখানে অবশ্য সাধ এবং সাধ্যের পরিহাস ঘটে। 

অর্নিতা দাস

সমাধি প্রতিস্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হলো, মৃত ব্যক্তির প্রতিকৃতি স্তম্ভ দেখে তাকে স্মরণ করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নিজের সক্ষমতা জাহির স্বরূপ অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে বাবা মায়ের সমাধিসৌধ তৈরি করা হয়, তবে এর বাস্তবিক প্রয়োগ বা প্রয়োজন কতটুকু?

হয়ত বছরে দুই একদিন সমাধিস্থল পরিস্কার করে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানো হয় অথচ সারা বছর সেই জায়গাটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যেই পড়ে থাকে। বরং যার আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই সে নিজের বাবা-মা বা পরিজনের বিস্তৃত সমাধিসৌধ তৈরি করতে অসামর্থ্য বলে মনকষ্টে ভোগে। সুতরাং পক্ষান্তরে দেখা যায় বিত্তবানদের আধিপত্য প্রকাশই সাধারণ নিম্নবিত্তদের কষ্টের কারণ। সমাধি বা স্তম্ভ করে মৃত মা-বাবার প্রতি স্মরণ বা সম্মান করার একমাত্র মাধ্যম নয়। মৃত মা-বাবার সম্মান দেখাতে সরকারি জায়গা দখল করে মঠ বানিয়ে সারা বছর খবর না রাখা দায়িত্ববোধের নমুনা হতে পারে না।

পিতা-মাতার সমাধি অবশ্যই বড় করে অনেক জায়গা নিয়ে করা যায় তবে সেটা নিজস্ব জায়গায় কোনোভাবেই সরকারি জায়গায় নয়। কারণ সরকারি শ্মশানের জায়গা সীমিত। সময়ের পরিক্রমায় মানুষজন ওখানে সমাহিত হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতে হবে। আপনি নিজে যদি অনেকটা জায়গা দখল করে রাখেন তাহলে ভবিষ্যতে স্থান সংকটে ভুগবে। এমন কি আপনি এবং আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মও। যেটা আমাদের কারোই কাম্য নয়।

প্রবাদ আছে, ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’। তাই, জীবনে উৎকৃষ্ট কর্মই হোক মানব জীবনের মাইলফলক। মৃত্যুর পর সমাধি নয়, কর্মের মাধ্যমেই মানুষের মনে আজীবন স্মৃতি রেখে যান। সরকারি শ্মশানে যদি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দিষ্ট স্থান ধার্য করা হয় যেখানে কেউ নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে জায়গা অধিকার করতে পারবেন না তাহলেই এক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন সম্ভব।

হিন্দু ধর্মে ‘আত্মন’ ও ‘পরমাত্নন’ বলতে বোঝায় ব্যক্তি আত্মা ও পরমাত্মাকে। ভগবান স্বয়ং নেমে আসেন, ব্যক্তি সত্তার মধ্যে রূপ ধারণ করেন। তারপর ব্যক্তি সত্তা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পৌঁছয় পরম আত্মায়। সেই জন্যে ভারতবর্ষে আমরা বলি ‘আত্মানং বিদ্ধি’- অর্থাৎ আত্মাকে জান। তুমি যদি নিজেকে চিনতে পার তো তাকেও চিনবে- কারণ মূলত: তুমি আর তিনি এক। আত্মচেতনাই ঈশ্বর চেতনা। একইভাবে সকল নিগূঢ় তত্ত্ব যা ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে এবং করেছে যে সত্যকার জ্ঞান অন্তরেই উপলব্ধ হয়। সুতরাং সমাধি নয়, ঈশ্বর সন্তুষ্ট করতে প্রয়োজন ভালো কাজ।

স্রষ্টা প্রেমের অমিয়ধারা প্রবাহিত হোক আমাদের অন্তরে, আমাদের শিরায় শিরায়। তাহলেই আমরা সকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবো প্রশান্ত প্রত্যয়ে। [ঋগ্‌বেদ: ৮.৩২.১২]

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একে//