ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

৪৯ বছরে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৫৭ পিএম, ১ আগস্ট ২০২০ শনিবার

আজ ১ আগস্ট। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’র ৪৯তম বার্ষিকী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পন্ডিত রবি শংকরের অনুরোধে ষাটের দশকের জননন্দিত বিখ্যাত ব্যান্ড সঙ্গীত দল দ্য বিটল্স এর জর্জ হ্যারিসন আমেরিকার নিউ ইয়র্ক নগরের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্টে আয়োজন করেছিলেন বেনিফিট সঙ্গীত অনুষ্ঠান ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। 

জর্জ হ্যারিসন বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটারিস্ট। তিনি সঙ্গীত পরিচালনা, রেকর্ড প্রযোজনা এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন। দ্য বিটল্স এর চার সদস্যের একজন হিসেবেই তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এই অনুষ্ঠানে বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের এক বিশাল দল অংশ নিয়েছিলেন- যাঁদের মধ্যে বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ব্যাড ফিঙ্গার এবং রিঙ্গো রকস্টার উল্লেখযোগ্য।

সেতারবাদক রবিশঙ্কর ও বিখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আলি আকবর খান যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করেন। তাদের সাথে তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা খান। তারা বাংলা ধুন নামে একটি ধুন পরিবেশন করেন। সাথে তানপুরা বাজান কমলা চক্রবর্তী। বিটল্স ভেঙে যাওয়ার পর এই অনুষ্ঠানই ছিলো হ্যারিসনের সরাসরি অংশগ্রহণ করা প্রথম অনুষ্ঠান। এরিক ক্ল্যাপটনও এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে প্রায় পাঁচ মাস পর কোনও সরাসরি অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং বব ডিলানও ১৯৬৯ সালের পর প্রথমবারের মতো শ্রোতা দর্শকদের সামনে এসেছিলেন।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর রাগসঙ্গীতের এক কিংবদন্তী, বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ ও প্রখ্যাত সেতারবাদক। তিনি তাঁর সেতারবাদনের জন্য ছিলেন বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। বিশ্ব সঙ্গীতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে গানের জগতে পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত যে কোনো সংগীতের চেয়ে কম নয়, তিনি তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। 
রবি শংকর, ১৯৭১ সালে বলেছিলেন- ‘I was in a very sad mood, having read all this news, and I said, ‘George, this is the situation, I know it doesn't concern you, I know you can't possibly identify.’ But while I talked to George he was very deeply moved ... and he said, ‘Yes, I think I'll be able to do something.’

ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও মাতা মদিনা বেগম। পিতার কর্মস্থাল মাইহার (ভারতের মধ্যপ্রদেশের যুবরাজ শাসিত রাজ্য) পিতার কাছেই তার সঙ্গীত শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। তিনি সব ধরনের বাদ্য যন্ত্র ও গায়কীর শিক্ষা নেন। ধীরে ধীরে তিনি সরোদে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন। ওস্তাদ আলী আকবর খান সাহেবের সঙ্গীতে হাতে খড়ি হয় তিন বছর বয়েস থেকে। কন্ঠ সঙ্গীতের শিক্ষা শুরু হয় তার বাবা আচার্য আলাউদ্দিন খান সাহেবের কাছে এবং তবলা শিখতে শুরু করেন তার চাচা ফকির আফতাবউদ্দিনের কাছে। তারঁ বাবা আরো অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখিয়েছেন; তবে তিনি সরোদ এবং কন্ঠ সঙ্গীতেই নিবিষ্ঠ হন। ভারত সরকার তাঁকে দুইবার প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া এওয়ার্ড প্রদান করেছে, এছাড়া পদ্মভূষণ এবং পদ্মবিভূষণ (১৯৮৯) খেতাবে ভূষিত করেছে। ওস্তাদ আল্লারাখা ছিলেন একজন বিখ্যাত তবলা বাদক। এবং বিখ্যাত তবলা বাদক ওস্তাদ জাকির হুসেইন তারই সন্তান।

ওস্তাদ আল্লারাখা ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার রতনগড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তার বাবা ভেবেছিলেন তার ছেলেও তার মতো কৃষিকাজে মনোনিবেশ করবে। কিন্তু বস্তবে তা ঘটেনি। কৃষিকাজে আল্লারাখার কোনো আগ্রহ ছিল না। তার আগ্রহ ছিল সঙ্গীতে।

কমলা চক্রবর্তী ভারতের একসময়ের নৃত্য শিল্পী পরে তানপুরা বাদক। জন্ম মাদ্রাজে। পণ্ডিত রবি শঙ্করের সহযোগী ও প্রাক্তন স্ত্রী। বাংলাদেশ কনসার্টে ধুন পর্বে তানপুরা বাজিয়েছেন। সঙ্গীত চর্চার জন্য শিশু কালেই তিনি উত্তরখণ্ডে উদয় শঙ্কর এর কাছে চলে যান। উত্তরখণ্ডে থাকতেই রবি শঙ্করের সাথে পরিচয় ছিল। পরে বোম্বেতে রবি শঙ্করের সাথে কিছু দিন কাজ করেন। রবি শঙ্কর বিবাহিত থাকা অবস্থায় তাদের মধ্যে প্রনয় গড়ে উঠে তার স্বামী ১৯৫৭ সালে মারা গেলে তিনি বিয়ে করেন নি। ১৯৬৭ সালে রবি শঙ্করের স্ত্রী দেবী মারা গেলে তিনি শঙ্করকে বিয়ে করেন।

নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতি ছিলেন এই কনসার্টে। যুদ্ধকালীন শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা এবং তহবিল সংগ্রহ, পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতা আর নৃশংসতা তুলে ধরাও এই কনসার্টের উদ্দেশ্যে ছিলো। এই কনসার্টের একটি শ্রেষ্ঠ বিক্রিত লাইভ অ্যালবাম, একটি বক্স-থ্রি রেকর্ড সেট এবং অ্যাপল ফিল্মসের কনসার্টের তথ্যচিত্র ১৯৭২ সালের বসন্তে চলচ্চিত্রাকারে প্রকাশ করা হয়। কনসার্ট ও অন্যান্য অনুষঙ্গ হতে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ছিলো প্রায় ২,৪৩,৪১৮.৫১ মার্কিন ডলার, যা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ব্যয় করা হয়।

জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটির প্রথম কয়েক লাইন-
‘এল একদিন বন্ধু আমার/ চোখভরা ধু-ধু হাহাকার/
বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা/ দেশ তার আজ ধুঁকে ধুঁকে মরে/ আমি অনুভব করতে পারিনি সেই বেদনা/ শুধু জেনেছি আমাকে করতে হবে কিছু/ তাই তোমাদের বলতে এসেছি- এস বাঁচাই জীবন ...
এসএ/