ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘যত দূরে যাই, ফের দেখা হবে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১৪ পিএম, ৪ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার

না, তাঁর সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিল না- হবার কথাও নয়। বয়সের তেমন তারতম্য একটা অবশ্য ছিল না। বছর পাঁচেকের বড় তিনি। দু’জনেই ছাত্র ছিলাম বরিশাল বি.এম. কলেজের। দু’জনেই ঢাকায় সলিমুল্লাহ হলে থাকতাম। বেশ কিছু বন্ধু ছিল তাঁর, যাঁদের সাথে সখ্যতা ছিল আমারও। এতসব জিনিষ অভিন্ন হলে সখ্যতার একটা সম্ভাবনা থেকে যায় বই কি। কিন্তু তা হয় নি আমাদের দু’জনের মধ্যে, কারণ দূরত্ব ছিল মূল জায়গায়- তাঁর আর আমার জগত আলাদা। তবু সখ্যতা না থাকলেও একটা হৃদ্যতা ছিল কবি আবুল হাসান আর আমার মধ্যে।

আজ ৪ঠা আগষ্ট হাসান ভাইয়ের জন্মদিন। জন্মেছিলেন ১৯৪৭ সালে। বেঁচে থাকলে তিনি সত্তুর পেরিয়ে যেতেন। ভাবা যায়? আমার মনে তাঁর তরুণ অবয়বটিই স্থির হয়ে আছে। আমরা সময়ের রেখা ধরে বয়সী হয়েছি, কিন্তু হাসান ভাই সেই ২৯ বছরের যুবকই রয়ে গেলেন।

কত ছোট খাটো কথা মনে হয়। সলিমুল্লাহ হলে তাঁর কক্ষ থেকে স্নান করার জন্যে দীর্ঘ বারান্দা ধরে হেঁটে আমার ৩৩ নম্বর কক্ষের সামনে দিয়ে স্নানাগারে যেতে হত। প্রায়শ:ই হাসান ভাই তোয়ালে নিতে ভুলে যেতেন। আমার ঘর থেকে তোয়ালে নিয়ে স্নান সেরে তাঁর কোঁকড়া চুল মুছতে মুছতে আমার ঘরে আসতেন। হাত বাড়িয়ে বলতেন ‘দিন’। বিনা বাক্যব্যয়ে তুলে দিতাম তাঁর হাতে। না, তেমন কোন মহার্ঘ বস্তু নয় - সেরেফ ক’টি নিউজ প্রিন্টের পাতা। ধোবীখানা থেকে আমাদের জামা-প্যান্ট ধুয়ে এসে তার ভাঁজে ভাঁজে দস্তরখানের মতো নিউজপ্রিন্ট্রের পরত পুরে দে’য়া হত। সেগুলোতে ডট্ কলম দিয়ে কবিতা লিখতে বেশ মজা পেতেন হাসান ভাই। হয়তো তাঁর অনেক নামী-দামী কবিতা আমার কাগজের নামাবলী পরেই জন্মলাভ করেছে- কে জানে?

তাঁর সঙ্গে বেশীর ভাগ সময়েই দেখা হত আমাদের তীর্থস্থানে- শরীফ মিয়ার ক্যন্টিনে। আমাদের হৃদ্যতার ঘনীভবনও সেখানেই। একদিন খাঁ খাঁ গরমের মধ্যে সেথায় গেছি। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। এক গেলাশ জল চাইলাম রমজান ভাইয়ের কাছে। দেখি এক টেবিলে হাসান ভাই শরীফ মিয়ার সেই বিখ্যাত এক টাকা দামের পুরো-প্লেট বিরিয়ানী খাচ্ছেন। কোনার এক টেবিলে শাহনূর খান, সাজ্জাদ কাদির, রফিক নওশাদ এবং আরো ক’জ্ন মিলে জোর আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে দেখে হাসান ভাই বললেন, ‘কি, খাবেন না?’ ঠোঁট উল্টে বললাম , ‘পয়সা নেই’। আমাদের কথাবার্তা শরীফ মিয়ার কানে গেছে। ‘আমনে খামাখাই খালি প্যাঁচাল পারেন।পয়সার কতা ক্যাডা জিগাইছে আমনেরে?’ 

ধমকে উঠলেন শরীফ ভাই। ‘বিরতর্ক ( শরীফ মিয়া বিতর্ক বলতে পারতেন না) কইরা কইরা প্যাঁচাল পারেনের অইভ্যাস হইছে আমনের’- ভারী বিরক্ত তিনি আমার ওপর।’এই রমজাইন্না, একডা ফুল পেলেট বিরিয়ানী লামাইয়া দে ছলিম সা’বের ছামনে’- আমার নামটাও শরীফ ভাই ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। তাকিয়ে দেখি, হাতে জলের গেলাশ তুলতে তুলতে মুচকি মুচকি হাসছেন তিনি। ভাবখানা -‘বেশ হয়েছে’। এতো বছর বাদেও গোঁফের ফাঁকে হাসান ভাইয়ের সে দুষ্টু হাসিটি এখনো দেখতে পাই।

সেই সঙ্গে এখনো শুনতে পাই ঐ কথা ক’টি - ভালো লাগছে একটু এখন?, বহুদূর থেকে কথা ক'টি যেন ভেসে এসেছিলো। আস্তে করে চোখ মেলতে যেন কুয়াশার ভেতর থেকে আবছা একটা মুখ দেখতে পেয়েছিলাম। ঐ এক মুহূর্তে তিনটে জিনিষ ঠাহর করতে পেরেছিলাম - জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, একটা ঘোরের মধ্যে আছি এবং ঐ মুখটি হাসান ভাইয়ের। কত কাল আগের কথা - প্রায় ৫০ বছর, তবু এখনও মনে আছে স্বচ্ছ।

খুব সম্ভবত: ১৯৭০ সালের কথা- কোন এক ঈদে মা-বাবার কাছে যাচ্ছি বরিশালে। সকাল থেকেই গায়ে গায়ে জ্বর ছিল- কিন্তু মনে হল কিছু হবে না, সেরে যাবে। বিকেলে সদরঘাটে গিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হল, ঐ অবস্থায় সুস্থ লোকেরও জ্বর চলে আসবে। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ, ঠেলাঠেলি, হাতাহাতি- লঞ্চ, স্টিমারে ওঠার জন্যে মরণপণ লড়াই। তার মধ্যেই দেখি হাসান ভাই - আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বহুদিন পরে বরিশাল যাচ্ছেন- ছোট বোনটিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, লাজুক চোখে জানালেন তিনি। হাসান ভাইয়ের লাজুক চোখ ও রাগী মুখ - দুটোর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল আমার। ততক্ষনে আমার জ্বর চড়চড় করে বেড়ে যাচ্ছে। এবং এক পর্যায়ে আমি সংজ্ঞা হারালাম।


আবুল হাসান। ছবি কৃতজ্ঞতা-মাসুক হেলাল

তারপরই প্রথম যে কথাটি শুনতে পেলাম, তা হচ্ছে ‘ভালো লাগছে একটু এখন?’ পাতলা-দুবলা হৃদরোগী হাসান ভাই কেমন করে সেই উন্মত্ত জনতার ব্যূহ পেরিয়ে আমাকে স্টিমারে তুলেছিলেন, কেমন করে প্রথম শ্রেণির খাবার ঘরের একটি বেঞ্চিতে শুইয়ে দিয়েছিলে, কেমন করে সারারাত জেগে থেকে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছিলেন- তা এখনও আমার কাছে এক রহস্য। শুধু চেতনার কোন কোনা থেকে নিরন্তর শুনতে পাই ‘ভালো লাগছে একটু এখন?’ ‘যে তুমি হরণ করো’র কবি আবুল হাসান সে রাতে আমার হৃদয় জয় করেছিলেন, কোন কিছুই তাঁকে হরণ করতে হয়নি।

তাঁর সঙ্গে শেষ দেখার কথাও মনে আছে আমার। অসুস্থ তিনি তখন। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝির একটু পরের কথা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। উচ্চশিক্ষার্থে আমার তখন ক্যানাডা আসার কথাবার্তা হচ্ছে। কথা-বার্তার কোন এক ফাঁকে হাসান ভাই খুব উদাস চোখে বাইকে তাকালেন জানালার শার্সি গলিয়ে। তারপর খুব নরম গলায় বললেন, ‘ওখানকার তুষার কি পূর্ব জার্মানির মতো?’ আমি একটু হেসে বললাম, ‘আমি তো বলতে পারবো না। আমি তো বরফ পড়া দেখিনি’। অনেকক্ষন চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপর প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘শুভ্র তুষার বড় সুন্দর, বড় পবিত্র’।

তারপর কতবার তুষারপাত দেখেছি পৃথিবীর কত জয়গায়। কত ভোরে উঠে বাইরে চেয়ে দেখেছি, বরফে বরফে ছেয়ে গেছে চারিদিক। শ্বেতশুভ্র সে বরফ দেখে আমি সেই বরফের মধ্যে হাঁটতে বেরিয়েছি। পায়ের বুটের নীচে বরফ ভাঙ্গার মচমচ শব্দ - কনকনে ঠান্ডা এড়াতে গরম কোটের কলারটা আমি তুলে দিয়েছি, গলার মাফলারটা আরো ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়েছি, মাথার টুপিটা নামিয়েছি বেশ কিছুটা। তখনই আমার ঘাড়ের কাছে যেন ফিসফিসানি স্বরে শুনতে পেয়েছি , ‘শুভ্র তুষার বড় সুন্দর, বড় পবিত্র’

মাঝে মাঝেই হাসান ভাইয়ের কবিতার লাইন মনে পডে যায়। ‘ঝিনুক নীরবে সহো ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’ কিংবা ‘আমি আমার আলো হবার স্বীকৃতি চাই, অন্ধকারের স্বীকৃতি চাই’। কিন্তু সবচেয়ে বেশী মনে হয়, ‘যতদূরে যাই, ফের দেখা হবে, কেন না মানুষ মূলত: বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক’।

এমবি//