ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছোট মুখে ছোট কথা – ১১

প্রতিবেশির মৃত্যু এবং কিছু উপলব্ধি

মারুফ ইবনে মাহবুব

প্রকাশিত : ১১:৪০ পিএম, ৪ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার

পহেলা আগস্ট ২০২০। ঈদ উল আযহা বা কুরবানীর ঈদের দিন। মারা গেলেন আমার প্রতিবেশি বড় ভাই ফয়সাল হাসান পলাশ। বয়স ৪৩/৪৪ বছর। কুরবানির পশু জবাই ও চামড়া ছাড়ানোর কাজ করছিলেন। সকাল দশটা/ সাড়ে দশটার দিকে পাঁচ তলায় বাসাতে গেলেন একটু নাস্তা করার জন্য। সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নেয়া হল। তবে ধারনা করি, স্ট্রেচারে করে নামানোর আগে বাসাতেই তিনি মারা যান। ফোনে ডাক্তারের সাথে কথা বলে বুঝছিলাম যে, হার্ট এটাক।

আমাদের বাসা দক্ষিণ বনশ্রী। আমরা চার তলায়। ফয়সাল ভাইরা পাঁচ তলায়। অসুস্থ হওয়ার পর প্রেশার মাপা, ডায়বেটিস মাপা ইত্যাদি কাজে ছিলাম। স্ট্রেচারে করে তাকে নামানো, এম্বুলেন্সে করে দক্ষিণ বনশ্রী থেকে বনশ্রী ফরাজী হাসপাতালে নেয়া, মৃতদেহ আবার বাসার সামনে আনা, তারপর মিরপুর লালকুঠির পৈতৃক নিবাসে নেয়া, সেখানে জানাযা, দাফন পর্যন্ত থাকারও সুযোগ হয়। এ পুরো সময়ে অনেক কিছু দেখার ফলে আমার কিছু উপলব্ধি হয়।

প্রথম উপলব্ধি- স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান, প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক ধারণা আরও থাকা উচিত আমার। আমাদের সবারই। আধা অজ্ঞান অবস্থায় ডায়বেটিস ও প্রেশার মাপা হল। ডায়বেটিস অনেক বেশি থাকায় সবাই সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছিলাম। কিন্তু তার বুকে ব্যথা হচ্ছিল। ঘাম হচ্ছিল।

এগুলো হার্ট এটাকের লক্ষণ জেনেও এবং ফোনে ডাক্তারের কাছ থেকে শুনেও হাসপাতালে নিতে দেরি করেছি আমি। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছি। সিদ্ধান্তের জন্য নির্ভর করেছি তার স্ত্রীর ওপর। নির্ভর করেছি তার বন্ধু মুন্না ভাই এবং আমার বাবার ওপরও। কিন্তু আসলে আমারই উচিত ছিল তখনই হাসপাতালে নেয়া। যদিও সবার আয়ু নির্ধারিত। নির্দিষ্ট সময়েই সবাইকে চলে যেতে হবে। তবু নিজের কর্তব্যটুকু যথাযথভাবে না করলে অপরাধবোধ যায় না!

দ্বিতীয় উপলব্ধি- ভবনে জরুরি নির্গমনের জন্য, অসুস্থ মানুষ বা মৃত ব্যক্তিকে নামানোর জন্য ভবনের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত জায়গা ছেড়ে দেয়া উচিত। এই ভবনটিতে দশটি ফ্ল্যাট। ফয়সাল ভাই ও আমরা মোটামুটি একই সময়ে উঠেছিলাম। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে। কেউই নির্মানের সময় এ বিষয়ে কোন মতামত দেই নি। ডেভলপাররা যেভাবে বানিয়ে দিয়ে গেছে সেভাবেই মেনে নিয়েছি। নিচের পুরোটাই গ্যারেজ। লিফট আছে। কিন্তু সেই লিফটে একটি লম্বা স্ট্রেচার ঢোকানো যায় না। সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলা থেকে স্ট্রেচারে করে নামাতে গিয়ে বুঝলাম যে বিষয়টা কত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। কারণ স্ট্রেচার নামানোর জন্য, প্রতি বাঁকে ঘোরানোর জন্য যে প্রশস্ততা দরকার তা নেই। আমার জানা ও দেখা মতে, বেশিরভাগ বাড়িতেই এই অবস্থা। অপ্রশস্ত সিঁড়ি ও স্বল্প পরিসর লিফট অধিকাংশ ভবনেই। তার মানে, আমরা কেউই মানুষের বিপদের কথা, দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে বাড়ি বানাই না।

তৃতীয় উপলব্ধি- আমরা যারা নগরে থাকি, বিশেষ করে মহানগরে, তারা এখনও অনেক অমানবিক নিষ্ঠুর নির্বোধ বিবেকহীন অসভ্য ও বর্বর। এই কথাটি পড়ে কেউ আমার ওপর ক্ষুব্ধ হবেন না। কারণ, এই মহানগরের মহানাগরিকদের মধ্যে আমি নিজেও পড়ি। এই বিশেষণগুলো আমার নিজের জন্যও প্রযোজ্য। কেন বলছি? এম্বুলেন্সকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য আমি বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূর হেঁটে গেলাম। দক্ষিণ বনশ্রী কবরস্থানের কাছে। গিয়ে দেখি মূল সড়ক থেকে ভেতরে ঢোকার গেটটি বন্ধ করে রাখা। নিশ্চয়ই প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির সিদ্ধান্তেই কাজটি হয়েছে। করোনা উপলক্ষ্যে গত কয়েক মাস ধরে মূল সড়ক ও আবাসিক এলাকার সংযোগ গেটের অধিকাংশই বন্ধ করে রাখা ছিল। গেট একটা বন্ধ, পরেরটা খোলা, তার পরের টা বন্ধ। এভাবেই রাখা ছিল গত তিন চার মাস। এ হিসেবে কবরস্থানের কাছের গেটটি খোলাই ছিল। কিন্তু কুরবানির দিন সেটা বন্ধ সকাল থেকে। এগিয়ে গেলাম আরেকটু সামনে যেদিক থেকে এম্বুলেন্স আসার কথা। সৌভাগ্য যে সেদিকের গেটটি খোলা ছিল। এম্বুলেন্সে উঠে যখন বাসার দিকে আসছি তখন দেখলাম ভেতরের পুরো রাস্তাটা জুড়ে একের পর এক কুরবানির পশু অসহায় হয়ে শুয়ে আছে। চার পা ওপরে তুলে। আমারও নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। কারণ, এমনভাবে রাস্তা জুড়ে কুরবানি দেয়া হয়েছে যে এম্বুলেন্সের পক্ষে অগ্রসর হওয়া খুব কঠিন। হর্ন দেয়া হল।

আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে জানালার কাঁচ নামিয়ে চিৎকার করতে থাকলাম যেন মানুষগুলো পথ ছেড়ে দেয়। তারা পথ ছাড়লেন। কিন্তু এমন দুলকি চালে ছাড়লেন যে মনে হলে, কুরবানির দিনে এম্বুলেন্স এনে আমরা অপরাধ করে ফেলেছি। কুরবানির কাজে ব্যস্ত এবং রাস্তা নোংরা করা ও রাস্তা আটকে রাখা নাগরিকদের র্নিবিকার চেহারা দেখে মনে হল, ঈদের দিন অসুস্থ হয়ে একজন মানুষ পাপ করে ফেলেছেন। রাস্তা ছাড়ার ব্যাপারে তাদের অনীহা দেখে ব্যথিত হলাম। তবে বিস্মিত হতে গিয়েও হলাম না। মনে পড়ে গেল, সদ্য বিদায়ী করোনাকালের কথা। মানুষ যে প্রকৃতপক্ষে অমানবিক; মানুষ যে এতদিন সভ্যতার মেকি মুখোশ পরে ছিল তা তো করোনা প্রমাণ করেছেই। কাজেই ফয়সাল ভাইকে নিয়ে একই রাস্তা দিয়ে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার সময়ও মানুষগুলোর রাস্তা ছাড়তে ঢিলেমি ভাব দেখে বিস্মিত হলাম না। এক জায়গায় ছোট্ট একটু ব্যরিয়ার ছিল। সেটা না সরিয়ে রিকশা চলতে পারে। কিন্তু এম্বুলেন্স চলতে পারে না। সেই ব্যরিকডেটি আমি নেমে গিয়ে সরালাম। যদিও সেখানে কয়েকজন যুবক ছিলেন যারা চাইলে সেটা সরিয়ে দিতে পারতেন।

আমার ভাবতে ইচ্ছে করে না যে, এই মানুষগুলোই (যারা রাস্তাকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে সেটা দখল করে রাখে, নোংরা করে রাখে এবং মানুষের জরুরি চলাচলে বাধা দেয়) এ জাতির প্রতিনিধি। বরং আমি ধরে নেই, এরা নাগরিক জীবন যাপনকারী বিচ্ছিন্ন মানুষ। মহানগরে মানুষের সংখ্যাধিক্যের কারণেই হোক আর আধুনিক বিলাস সর্বস্ব ভোগমুখি জীবনাচরণের কারণেই হোক, একজন মানুষ আরেকজন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। নেই মমতার বন্ধন। নেই ভালবাসার আঠা। বরং গ্রামে, বোধ করি, এখনও মানুষ মানুষের সাথে হৃদয়ের রশিতে গিঁট মারা। সেই গিঁট যে যথেষ্ট শক্ত তা বোঝা যায় আরেক জনের এরকম বিপদে নিজের সব কিছু ফেলে রেখে এগিয়ে আসার প্রবণতা দেখে।

চতুর্থ উপলব্ধি – আমাদের নেতারা আমাদের মতই অমানবিক। মমতার বন্ধনহীন এই নাগরিকদের মত নেতারাও মায়া দয়াহীন। ফয়সাল ভাইয়ের মৃতদেহ বাসার কাছে আনা হল দুপুর দেড়টা/দুইটার দিকে। যাতে প্রতিবেশি, বন্ধু, স্বজনরা শেষ দেখা দেখতে পারেন। দক্ষিণ বনশ্রী প্লট মালিক সমিতির এক নেতাকেও বলা হল। যার বাসা থেকে হেঁটে আসতে ত্রিশ সেকেন্ড লাগে। কিন্তু মাংস কাটা, বিতরণ ইত্যাদি কাজে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে মৃতদেহকে শেষ সম্মান জানানোর জন্য তিনি এম্বুলেন্সের কাছে আসতে পারলেন না। অথচ সমিতির নির্বাচনের সময় ঠিকই যথেষ্ট সম্মান করতেন তিনি।

পঞ্চম উপলব্ধি – বাইরের মানুষটাকে দেখেই ভেতরের মানুষটাকে বোঝা যায় না। ফয়সাল ভাই প্রচুর ধূমপান করতেন। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সাথে থেকেই হোক আর যে কারণেই হোক যথেষ্ট কঠোর শক্ত পোক্ত মানুষ ছিলেন তিনি। অন্তত সেরকম মানুষ হিসেবেই তাকে চিনতাম। কিন্তু তার যে অত্যন্ত কোমল একটি মন ছিল সেটির খোঁজ আমি তেমন পাই নি। যদিও আমার অনুপস্থিতিতে আমার বাবাকে একবার যথেষ্ট চিকিৎসা সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি এবং আমি সেজন্য তার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। তবু তার যে হৃদয়টা খুব বড় ছিল সেটা এত ভালভাবে জানা ছিল না। বুঝলাম, তার সৎ ছেলের কান্না দেখে। ১২/১৩ বছর বয়সী ছেলেটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বাইরে রাখা মৃতদেহর কাছে গিয়ে মুখটা ধরে কী মমতা নিয়েই না বলছিল, এখন আমি কার সাথে খেলব আব্বু? কার সাথে গল্প করব? ১৮/১৯ বছর বয়সী সৎ মেয়েটি যে পাগলের মত ছোটাছুটি করছিল হাসপাতালে নেয়ার আগে সেটা দেখে বোঝা গেল, ফয়সাল ভাই এই ছেলে মেয়ে দু’টিকে পর্যাপ্ত স্নেহ মমতা দিয়েছিলেন। তার নিজের একটি ছেলে, বয়স দেড়/দুই বছর। তবুও তিনি স্ত্রীর আগের পক্ষের এই সন্তান দু’টিকে পিতৃস্নেহ দিতে পেরেছিলেন। নইলে এরা এমনভাবে কাঁদতে পারত না। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে একবার এম্বুলেন্সের ভেতরই অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। কবরে দাফন করা পর্যন্ত (মারা যান ১১.৩০/১২টার দিকে। আর দাফন করা হয় মিরপুরে মাগরিবের পর। দাফন সম্পন্ন হতে হতে রাত পৌনে আটটা) পুরোটা সময় মৃতদেহের সাথে সাথেই ছিল ছেলেটি।

ষষ্ঠ উপলব্ধি – সেবা দেয়ার প্রবল তাড়না মানুষকে শক্তিমান করে। পাঁচ তলা থেকে স্ট্রেচারে করে যখন ফয়সাল ভাইকে নামাচ্ছিলাম তখন এম্বুলেন্সের স্ট্রেচার বাহক ও আমি সামনের দিক ধরি। পেছনের দিক ধরেন মুন্না ভাই ও তার ছেলে।
ছেলেটি হ্যাংলা পাতলা। নবম শ্রেনীতে পড়ে। উপস্থিত আর কেউ ধরার মত ছিল না বলেই বোধহয় সে কাঁধ দিয়েছিল স্ট্রেচারের নিচে। প্রচণ্ড পরিশ্রম হয় নামাতে। অনেক পরে জানাযার সময়, আমি মুন্না ভাইকে কথাচ্ছলে বলছিলাম, আপনার ছেলে শুকনো হলেও ওর গায়ে যথেষ্ট শক্তি আছে। মুন্না ভাই বললেন, না। আসলে ওর গায়ে শক্তি খুব কম। কিন্তু যেহেতু ফয়সাল ওকে খুব আদর করত সেহেতু ও ফয়সালের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত। এ কারণেই ফয়সালের ওই অবস্থায় সে স্ট্রেচার ধরতে দ্বিধা করে নাই।

শেষ কথা : প্রতিদিন কত মানুষই তো মারা যাচ্ছে। তবু ঈদের দিনের ঘটনা বলেই হয়তো এই মৃত্যুটি অন্য অনেক মৃত্যুর চেয়ে বেশি ব্যথিত করছে। হয়তো মৃত্যুকে উপলক্ষ্য করে অনেক সত্য প্রকাশিত হওয়ার পথ পায়। অনেক উপলব্ধি হৃদয়ে ঢোকার পথ পায়। সেইসব উপলব্ধি আপনজনদের কাছে বলতে পারলে মন হালকা হয়। কিছু করণীয় নিয়ে যূথবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানো সহজ হয়। বোধহয়, সেইরকম কোন আশা আমার অবচেতনে বাসা বেঁধে আছে। তাই প্রতিবেশির মৃত্যুর মত সহজ স্বাভাবিক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতগুলো কথা বলে ফেললাম।

লেখক- সমাজকর্মী 

আরকে