ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘লেখা যখন হয় না’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১০:৪০ এএম, ৭ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ১০:৪৩ এএম, ৭ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার

দূরপাল্লার রেলগাড়ীতে যাচ্ছিলাম। সামনে টেবিলের ওপরে খোলা বই। শঙ্খ ঘোষের ‘লেখা যখন হয় না’। বছর খানেক আগে বেরিয়েছে কোলকাতায়। পাওয়া গেছে ‘পরবাসের’ স্বত্ত্বাধিকারী পরম স্নেহভাজন সমীর ভট্টাচার্য্যির কল্যানে। রেলগাড়ী চলার শব্দ ‘যাচ্ছি ..যাবো .. যাচ্ছি .. যাবো’ শুনতে শুনতে আর মাঝে মাঝেই বাইরে দু’চোখ মেলে দিয়ে পড়ে যাচ্ছি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা।

শঙ্খ ঘোষ আমার খুব প্রিয় কবি ও লেখক। তাঁর কবিতার কিছু কিছু লাইন সেই কবে থেকে মনে গেঁথে আছে। সেই যে ‘পাগল’ কবিতার শেষ চার লাইন,

‘হাওড়া ব্রিজের চূড়োয় উঠুন,
উর্ধ্বে চান, নীচে তাকান।
দু’টোই কেবল সম্প্রদায়,
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’

চল্লিশ বছর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি দীর্ঘ-বাদন ঘনশ্রুতি রেকর্ড কিনেছিলাম মন্ট্রিয়ালে - ‘একটি রক্তিম মরীচিকা’। প্রচ্ছদে উর্ধ্ববাহু এক নারীর ছবি ছিল - রবীন্দ্রনাথেরই আঁকা। সেখানেই শঙ্খ ঘোষের পাঠ আর আবৃত্তি শুনেছিলাম প্রথম। পড়ার লালিত্য ছাড়িয়ে তাঁর কণ্ঠের বিশেষত্বই আমাকে মুগ্ধ করেছিল বেশী - অনেকটা অর্ঘ্য সেনের গায়কী কণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের মতোই।

তারপর এ দীর্ঘ সময়ে শঙ্খ ঘোষের কত বই যে পড়েছি। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ পড়ার পরে দৈনিক সংবাদে এক দীর্ঘ লেখা লিখেছিলাম ‘ওকাম্পোর উত্তরাধিকার’ নামে - ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর ওপরে (যাঁকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’)। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’ পড়ার পর থেকে ওঁর ছোট ছোট বইগুলোই আমাকে টানত বেশী - ‘এ আমার আমির আবরন’, ‘আয়ওয়ার ডায়েরী’ ‘বেরিয়ে পড়ার পথ’। ভালো কথা, শঙ্খ ঘোষের আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ।

‘লেখা যখন হয় না’ বইটির শুরুতেই শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন যে, লেখকের লেখা যখন আসে না, তখনও প্রকাশক লেখকের লেখা ও পাওয়া চিঠিপত্র কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটা বই বের করে ফেলেন। ‘লেখা যখন হয় না’ও তাই পত্রভিত্তিক স্মৃতিচারনার বই। অন্যান্যদের মধ্যে সে স্মৃতিচারনার কেন্দ্রে আছেন অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, জয় গোস্বামী, সত্যজিত চৌধুরী, জয়দেব এবং বিশাল অংশ জুড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

অমিয় চক্রবর্তীর ক’টা লাইন মনে থাকে সর্বদা। এই যেমন, ‘মেলাবেন, তিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো দরজাটা’ কিংবা ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’। শঙ্খ ঘোষ মনে করিয়ে দিলেন, ‘তাঁতে এনে বসালেম বুক থেকে রোদ্দুরের সুতো’ কিংবা ‘কিছুই হয় না এই জল স্হিতির আকাশে।’ মনে করিয়ে দিলেন ১৯৬১ সনে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর উক্তি থেকে বিতর্কের ঝড়। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘The age that produced Rabindranath is over’।সংবাদপত্রের মাধ্যমে তা হয়ে গেল, ‘The age of Rabindranath is over’।

সমর সেনের ওপরে শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, তিনি কবিতার জগৎ থেকে নি:শব্দে সরে এসেছেন। এ কথা পড়তে গিয়ে মনে পড়ল অকালপ্রয়াত অসামান্য উর্দু কবি সারওয়াত হুসেনের দু’টো লাইন, ‘কবিতা যে কোন জায়গা থেকেই ছেড়ে যেতে পারে তোমাকে, বাবার হাতের মতো’।

অবাক লাগে জেনে যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৪০ বছরের ব্যবধানে দু’টো চিঠি পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ - একটি ১৯৬৫ তে, অন্যটি ২০০৫এ। চিঠি দু’টোর প্রতিলিপি আছে ‘লেখা যখন হয় না’ তে। শঙ্খ ঘোষের কল্যানে জানা গেল যে, জয় গোস্বামী সকালে খবরের কাগজ পড়েন না - কবিতা পড়েন। কারন গায়ককে যেমন প্রভাতে রেওয়াজ করতে হয়, কবিরও তেমন করা দরকার।

অসামান্য একগুচ্ছ লেখা আছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে -কিছু ব্যক্তিগত, কিছু তাঁর কবিতা নিয়ে। ‘পদাতিক’ নিয়ে আলোচনা আছে, ‘আজ আছি, কাল নেই’ এর বিশ্লেষন আছে, পারিবারিক বন্ধুত্বের ওপরে মায়াভরা স্মৃতিচারন আছে। কিন্তু আপ্লুত হয়েছি স্ত্রী গীতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রয়ানের পরে শেষ বয়সে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়,

‘লাঠি হাতে উঠে
এ ঘর ও ঘর করি খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
কখনও সাক্ষাতে
বলি নি লজ্জার মাথা খেয়ে মুখ ফুটে
তবু খুব জানতে ইচ্ছে করে -

কখনও না কেঁদে
সমস্ত বর্ষার জল কেন তুমি হাসিমুখে
তুলে নাও দু-চোখের কোলে -

একদিন বাঁধ ভেঙে দিয়ে
আমাকে ভাসিয়ে দেবে বলে?’

কেমন যেন করে ওঠে মনটা। বইটা শেষ করে আস্তে আস্তে মুড়ে রাখি। মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের ‘ছুটি’ কবিতার ক’টা লাইন,

‘কী নাম?
আমার কোনো নাম তো নেই,
নৌকো বাঁধা আছে দু’টি,
দুরে সবাই জাল ফেলছে সমুদ্রে -
ছুটি, প্রভু, ছুটি’।

রেলগাড়ী ছুটে চলছিল সবকিছু ছাড়িয়ে। গন্তব্যে পৌঁছুতে এখনও অনেক দেরী।

এমবি//