ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কবিকণ্ঠে কবিতা এবং আলোচনা’ অনুষ্ঠিত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৫৬ এএম, ১০ আগস্ট ২০২০ সোমবার

নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে চতুর্থ আন্তর্জাতিক ওয়েবনিয়ার ‘কবিকণ্ঠে কবিতা এবং আলোচনা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

রোববার (৯ আগস্ট) এ আলোচনা সভা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে ছিলেন উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন। সঞ্চালনা করেন বাংলা বিভাগের প্রধান ও বহুমাত্রিক লেখক ড. রকিবুল হাসান।

সম্মানিত প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট কবি ফারুক আহমেদ। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশুতোষ গল্প লিখে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তার কাব্যগ্রন্থ ‘কয়েকজন দীর্ঘশ্বাস’ অবজ্ঞাফল আবেগ সকল বিবিধ, মন এই ভাবে স্থির করা আছে, প্রিয়মুখ। উপন্যাস: ঘূর্ণির ভেতর জীবন, আদর্শ, গল্পগ্রন্থ অঅজিজুল একটি গোপন নামতা, বৈভব, শিশুতোষ গল্প মেঘেদের মাঠে গহীন ও আলোঘর। তিনি বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক।

সম্মানিত বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি মিলু শামস। সাংবাদিক ও দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক। তার প্রকাশিত গ্রন্থ: নিরুপায় বৃত্ত এবং দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো। মিলু শামস কবি হিসেবে সমাদৃত হলেও তার গদ্য চমৎকার। বিষয়বস্ততে রয়েছে স্বতন্ত্রভাবনা ও নিজস্বদর্শন শৈলী। ছোট ছোট বাক্যে তৈরি তার গদ্য অভিনবত্বময়। এ সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। এবং একজন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে প্রশংসিত তিনি। 

সম্মানিত অতিথি ছিলেন কবি সুতনু হালদার। পশ্চিমবঙ্গে তিনি কবি-কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও নদীয়ার সাহিত্য অঙ্গনের অত্যন্ত প্রিয় কবি ও প্রিয় মুখ তিনি।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি-কথা সাহিত্যিক-গবেষক ও নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাফিক আফতাব।

অনুষ্ঠানের শুরুতে উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, বাঙালির শোকের মাস আগস্টের আজকের এই ওয়েবিনারের শুরুতেই শ্রদ্ধাবনত বিনম্রচিত্তে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ মাস বাঙালির মহাবেদনার মাস, শোকের মাস, কষ্টের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় পথভ্রষ্ট সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই সন্তানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তাকে হত্যার ভেতর দিয়ে তারা মূলত বাংলাদেশকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। কারণ ঐ খুনিরা জানতো মুজিব মানেই বাংলাদেশ। ভাগ্যগুণে বেঁচে যান তার দুকন্যা শেখা হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের নতুন প্রাণ হয়ে ওঠেন, পিতৃস্বপ্নের বাস্তবায়ন করে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আমরা এই ওয়েবিনারে বিনম্রশ্রদ্ধাবনত ও শোকাহত চিত্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও তার সাথে নিহত সকলকে স্মরণ করছি এবং সবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু সুস্থ জীবন প্রার্থনা করছি।

বক্তারা কবিতার নানা দিক তুলে ধরে বলেন, চর্যাপদ থেকে বর্তমান এই সময়কাল পর্যন্ত কবিতায় বহুভাবে বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। বিষয়বস্তু থেকে ছন্দমাত্রা আলঙ্কারিক বহুমাত্রিক বৈচিত্রতায় কবিতা বহমান নদীর মতো স্রোতময়। প্রার্থনা-আরাধনা আর প্রেম প্রণয়ে কবিতা বন্দি নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজবিপ্লব-বিদ্রোহ-মনস্তাত্ত্বিকতা-বহু বিষয় এখন কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ। প্রাচীনকাল আর মধ্যযুগের ধর্ম আরাধনার বৃত্ত ভেঙে আধুনিকতায় মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব দরবারে। এর পর ত্রিশের কবিগোষ্ঠি-, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ওমর আলী, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ সহ খ্যাতিমান আরো বহু কবি কবিতাকে আরো বহু রৈখিকভাবে এগিয়ে নিয়েছেন। বর্তমান এ সময়কালেও কবিতায় নতুন প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে।  

বক্তারা কবিতার বহমাত্রিক বিশ্লেষণ করে আরো বলেন, কাব্য কী? কাব্য কাকে বলে? কীসে কীসে কাব্য হয়? বাক্য যখন তার শাব্দিক অর্থ পরিত্যাগ করে- সেটাই কাব্য বা কবিতা। অন্যকথায় ‘অনিবার্য শব্দের বাণীবিন্যাসকে কবিতা বলে’। এখানে অনিবার্য শব্দের সঙ্গে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কিংবা ঐশ্বরিক বা নৈসর্গিক বিষয়ের আভাস ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ শব্দগুলো প্রকৃতিগতভাবে যার পরে যেটি বসে ব্যঞ্জিত অর্থ আপনাতেই প্রকাশ পায় সেটি কাব্য বা কবিতা। কবির জগত প্রকৃতির সেই অবাধ সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র। কবির যে নির্মাণ সে নির্মাণ রহস্যলোকের মায়াজাল। সেই মায়াজালকে কাঠামো দেয়াই কবির কাজ। মানুষের দেহ যেমন চোখ, মুখ, নাক, কান, চুল ইত্যাদি দিয়ে নির্মিত একটি কাঠামো। কিন্তু আত্মাটি তার ভেতরের জিনিস। একজন লোক জীবন্ত থাকতে যেমন তার চোখ, নাক, মুখ ইত্যাদি পরিদৃষ্ট হয়। মুত্যুর পরবর্তী সময়েও আমরা লোকটির সেই অঙ্গগুলো দেখতে পাই। প্রাণহীন লোকটিকে হয়তো দুচারদিন বাঁচানো যায় কিন্ত তারপর আত্মাহীন লোকটির চোখ, নাক, কান, মুখ ধীরে ধীরে পচে যায়। প্রসঙ্গত শব্দ দিয়ে যে বাক্য গড়ে ওঠে সেটাতে আমরা হয়তো কোনো বস্তুর ধারণা পাই কিন্তু ধারণার অতিরিক্ত কিছু পাই না। ধারণার অতিরিক্ত কিছু ব্যঞ্জিত হওয়াই কাব্য।

ফুটন্ত ফুলের ঘ্রাণ যেমন মানব মনকে বিমোহিত করে, অন্তরলোকে অনুভবে, রমণে ও সৌন্দর্যের একঝলক আনন্দানুভূতি দেয়, কবিতা সেই আনন্দানুভুতি স্ফূরণ।  বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদকে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সাধন সঙ্গীত বলা হলেও আমরা সমাজ ও শিল্পকে প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলা সাহিত্যের পুরো মধ্যযুগে কাহিনিকাব্যই প্রত্যক্ষ করি। যদিও বৈষ্ণব পদাবলিতে আমরা কবিদের ব্যক্তিগত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ রাধা-কৃষ্ণের আদলে পাই। অন্য মহাকবিদের মহাকাব্য যা-ই হোক, মাইকেল মধুসুদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য’র বিষয় পৌরাণিক হলেও তার মধ্যে রূপকের অন্তরালে ব্রিটিশ সরকারের শোষণপীড়নের চিত্র পাই। অপরদিকে প্রাসাদগুণসম্পন্ন কাব্যভাষার শিল্পনিরীক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত এই মহাকাব্য। 

যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরগুপ্তের কবিতায় ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে কটাক্ষ এবং ভোরের পাখি বিহারীলালের কবিতায় প্রেমানুভূতি ও সৌন্দর্য চিত্রিত হতে দেখা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে কবিতা বিষয় বৈচিত্র্যে যেমন তেমনি শিল্প হিসেবে পেয়েছে ভিন্ন মর্যাদা। যুগপ্লাবী কবি কাজী নজরুল কবিতায় এনেছেন দ্রোহের বীজ তেমনি প্রেমের প্রোজ্জ্বলতা। ত্রিশোত্তর কবিদের কবিতায় বিষয়গত ভাবনার চেয়ে শিল্পপ্রকরণ ও জীবনবোধের বিষয়টি পায় ভিন্নমাত্রা। শতাব্দী বা যুগ-দশক উৎরে কবিতা আজ জীবনের বহুমাত্রিক অনুভূতি এককথায় মানুষের যাপিত জীবনের সকল দিগন্ত উন্মোচন করে নান্দনিক জীবনের দিকে অগ্রযাত্রায় ধাবমান। কবিতা আজ শুধু বলবার বিষয় নয়, সমান্তরালে জীবনযাপনে অপরিহার্য অনবদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে। কবিতা শুধু মনন গঠনে সহায়তা করে না, কবিতা আজ জীবনযাপন পদ্ধতির সৌন্দর্যসূত্র। কবিতা ব্যক্তিজীবনকে যেমন পাল্টায় তেমনি জাতীয় জীবনকে দ্রোহে ও ঐতিহ্যচেতনায় জারিত করে। মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, ঐতিহ্য, গ্রামীণ জীবন, পূর্বপুরুষের জীবনধারা ইত্যকার বহুবিধ বিষয় কবিতা চারণক্ষেত্র। মানুষের ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা, আনন্দবেদনা, দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-কাম প্রভৃতি কবিতা ক্যানভাসে মূর্ত হয়, মানুষের ব্যক্তিত্ব, জীবনোলব্ধি, নান্দনিকতা এবং কবির মনোজগতটির স্বরূপ কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়। কবির এই মনোজগতটি জগতের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ দ্বারা মোড়ানো। কবিতা এখন আর তাই ধর্ম, কাহিনি-বর্ণনা, প্রকৃতি প্রেম, সরল জীবনের বিবৃতি নয়। কবিতার শক্তি শিল্পের সকল শিল্প মাধ্যমের চেয়ে ঢের বেশি। কবিতার একটিমাত্র চরণ একটি জাতির ভবিষ্যতকে পাল্টে দিতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেই কবিতারই চেতনার প্রবালপ্রবাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এই একটি চরণেই পুরো জাতিকে রণক্ষেত্রে ধাবিত করেছিল।

কবিতা লেখা হয় ভাষায়, কিন্তু সেটি যখন কবিকণ্ঠে ধ্বনি হয়, তখন সেটি আর শুধু ভাষা থাকে না, হয়ে ওঠে শক্তি ও সৌন্দর্য। এই শক্তি মানুষের বাঁচার প্রেরণা জোগায় আর সৌন্দর্য আনন্দ জোগায়। একটি হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন অন্যটি বেঁচে থাকার কৌশল। কবি ও কবিতার বিরুদ্ধে অনুযোগ অভিযোগ যা-ই থাকুক, কবির কবিতার চরণ দিয়েই শুরু হয় মানুষের জীবন। শিশু ভুমিষ্ঠের সময় তার ক্রন্দনধ্বনি তা কি প্রসুতির অন্তরে কবিতার ব্যঞ্জনা জাগায় না? কিংবা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুক্ষণটি কি হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়ে যায় না। জন্ম-মৃত্যুর কথা না হয় বাদ-ই দিলাম, বঙ্গদেশে এমন কোনো লোক পাওয়া ভার হবে যে, সে কোনদিন গুনগুণ করেনি। যৌবনের উর্বর দিনগুলিতে কবিতা চরণ কিংবা গানের কলি প্রেম প্রকাশের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে আমরা দেখেছি। এমনকি বাসররাত্রিগুলিতে নবদম্পতির হৃদয়ের উচ্ছ্বাসটুকু কবিতা হিসেবে কি সংজ্ঞায়িত করা যায় না। বিবাহ পুর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বিবাহ-অনুষ্ঠানাদিতে গান বাজানার যে আয়োজন করা হয় তা-ও কবিতাই দান।

কবিকণ্ঠে কবিতা একদিকে যেমন জাতীয়স্বরের দ্যোতনা, তেমনি জীবনযাপনপ্রণালীর মৌলিক অধিকারের ন্যায় অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কবিতা আজ নান্দনিক শিল্পের শীর্ষে অবস্থান করছে। জগত কবিতাময়- সেটি আনন্দ ও ক্ষুধায় যেমনই হোক। কবিরাই স্বপ্ন দেখায়, কবিরাই বিপন্ন মানবতাকে তুলে ধরে। কবিতা আজ তাই বইয়ের পাতা ঘিরে থাকে না, কবিতা থাকে মানুষের মননে, চেতনায়, কবিতা জীবনের থোকা থোকা ঘাসফুলে শিশির বিন্দু হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত কবিতাই সত্য, কবিতাই শক্তি। এই সত্য ও শক্তি কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে জগত হয় সুন্দর। সেই সুন্দরের অপর নাম জীবন। মূলত জীবনই একটি অনবদ্য কবিতার নাম।

এসি