ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন যারা

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন

প্রকাশিত : ১১:৩৬ পিএম, ১১ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:১০ এএম, ১২ আগস্ট ২০২০ বুধবার

বঙ্গবন্ধুর সাথে শহীদ মৌলভী সৈয়দ উপরে বাম থেকে তৃতীয়

বঙ্গবন্ধুর সাথে শহীদ মৌলভী সৈয়দ উপরে বাম থেকে তৃতীয়

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেক মানুষই প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে একটি অপপ্রচার খুব করে চালানো হয় যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে কোন প্রতিবাদ হয়নি। দেশের মানুষ খুশীতে মিছিল করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। অলিখিত বিধি-নিষেধ দেশের মানুষের মধ্যে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছিল। সারাদেশে কারফিউ জারি করে রেখেছে সামরিক জান্তা, খুনিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও প্রতিবাদ করেছেন অনেকেই।

কাদের সিদ্দিকীর যুদ্ধ ঘোষণা আর হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি মিছিল এর কথা অনেকেই জানেন। আপোষে রাজি না হয়ে খুনিদের দেয়া মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে জেলখানায় জাতীয় চার নেতার খুন হবার কথাও কারো অজানা নয়। 

এমন অনেক উদাহরণ আছে; বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই যে ক’জন দলীয় নেতাকর্মী সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিল শহীদ মৌলভী সৈয়দ, এস এম ইউসুফ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম।

মৌলভী সৈয়দ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম নগর গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। অনলবর্ষী এই বক্তা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বর্তমান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দীন আহমেদকে। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক কিংবদন্তী নেতা সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সম্পাদক এর দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাতকানিয়া থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি মরহুম জননেতা এম সিদ্দিক আহমদ। যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে আরো যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা হলেন মরহুম জননেতা আতাউর রহমান খান কায়সার, সাতকানিয়ার কৃতি সন্তান এম আবু সালেহ, মরহুম এ.কে.এম আব্দুল মান্নান ও নাজিম উদ্দীন।

মূলত প্রয়াত জননেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর কাছে রাজনৈতিক দীক্ষায় অনুপ্রানিত হয়ে ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করেন তারা। ৭১ এর বীর রনাঙ্গনের সাহসী এই দুই যুদ্ধা গেরিলা যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে জাতির জনকের স্ব-পরিবারের নিহত হওয়ার ঘটনাকে তাই স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিতে পারেননি তারা। তাই মৌলভী সৈয়দ, এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীরা সশস্ত্র বিপ্লবের ঘোষনা দিয়ে শুরু করেছিলেন গোপন মিশন। সফল ভাবে কয়েকটি সফল অপারেশনও পরিচালনা করেছিলেন।

ঘাতকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন তিনি। ৭৫ এর ৩ নভেম্বর খালেদা মোশারফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন জিয়াউর রহমান গ্রেফতার হন তখন খালেদ মোশারফের পক্ষে ঢাকার সমাবেশের অন্যতম উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন মৌলভী সৈয়দ। 

৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে যখন খালেদ মোশারফ নিহত হন তখন মৌলভী সৈয়দ, এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী সহ পুরো দলটি ভারতে আশ্রয় নেন। এসময় ভারত থাকাকালীন সময়ে ইতিপূর্বে ৭৩ এর নির্বাচনের দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে তিনি প্রবাসী সরকার গঠনের তৎপরতা চালাতে থাকেন। যদিও এই কাজে তিনি ব্যার্থ হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে আসা যাওয়ার মধ্যেই বিভিন্ন সরকারী স্থাপনার মধ্যে গেরিলা হামলা চালাতে থাকেন।

১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জিয়ার সামরিক সরকার মৌলভী সৈয়দ কে ১নং ও এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীকে ২নং আসামী করে মোট ১৬ জন বিপ্লবী নেতা কর্মীকে মামলা-১, মামলা-২, মামলা-৩ নামে পরিচিত ৩টি মামলা দায়ের করা হয়।

পরবর্তীতে ভারতে জাতীয় নির্বাচনে ইন্ধারী গান্ধির দল পরাজিত হলে মৌলভী সৈয়দ ও সহকর্মীদের ভারতীয় পুলিশ বাহিনী আটক করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশব্যাক করে। বাংলাদেশের সীমানার প্রবেশের সাথে সাথে সেদিন মৌলভী সৈয়দ সহ তার অনেক সহকর্মী বাংলাদেশের পুলিশের কাছে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে তাদের ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের জায়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়।

১৯৭৭ সালের ১১ আগস্ট স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিনা বিচারে তাকে হত্যা করেছিল। মেজর জিয়া সেদিন বিচারের নামে প্রহসন করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিল। কর্ণেল তাহেরসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছিল। 

পরবর্তীতে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তার লাশ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করে দীর্ঘ ১ মাস পুলিশ দিয়ে কবর পাহাড়া দেয় সামরিক সরকার। যাতে করে জনগন এই হত্যার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারে।

পূর্ন্যভূমি চট্টলার বীর পুরুষ, অসামান্য দেশপ্রেমের অধিকারী এই বীর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশ সেবায়। অবিবাহিত অবস্থায় চির নিদ্রায় শায়িত শহীদ মৌলভী সৈয়দকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়। 

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা।

এসি