ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ফিরে আসার গল্প

শাহেদ রহমান

প্রকাশিত : ০৫:২৭ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০২০ শনিবার

শাহেদ রহমান

শাহেদ রহমান

হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ায় পর আজ দুই সপ্তাহের অধিক দিন অতিবাহিত হলো। এখনও আমি সম্পূর্ণ সুস্থ নই। লিখতে গেলে হাত কাঁপে, হাটতে গেলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। কথা বেশী বললে গলায় খুসখুস করাসহ কাশি আসে। চীনের উহান থেকে কী এক রোগ আসলো, সারাবিশ্বকে একেবারে তছনছ করে ছাড়লো। আরও কতদিন এই কোভিডের সাথে বসবাস করতে হবে তা আল্লাহ তাআলাই জানেন।

আমি ২৬ জুন অসুস্থতা বোধ করি। যেমন খুসখুস কাশি, সর্দি ও অস্বস্তিবোধ করছি। অবশ্য ২৫ তারিখ আমি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিলাম। সেদিন অফিসে যাইনি। তার আগে নিয়মিত অফিস করি। ২৮ তারিখে আমার মেয়েও আমার মতো সমস্যা দেখা দিলে আমি ঘাবড়ে যাই। সে বলে তার গলা খুসখুস করছে এবং সর্দিও আছে। আমি তাকে তার মামার সাথে পরামর্শ করে ঔষধ খেতে বলি। আমিও তার মামার পরামর্শে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। তার মামা একজন ডাক্তার যিনি দিনাজপুরে কোভিড রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ২৯ তারিখে আমার স্ত্রী ও আমার ভাইয়ের মেয়ে (যে আমার মেয়ের সাথে একই ঘরে থাকে) সেও অসুস্থতা বোধ করে। বাড়িসুদ্ধ লোক অসুস্থ হওয়াতে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ি এবং খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। 

কোভিডের কারণে বাসার কাজের লোক চলে যায়। আমার স্ত্রী রান্নাবান্নাসহ সমস্ত কাজ বলা চলে একাই সামলেছেন। এখন সে অসুস্থ হওয়াতে আমার নানান নেগেটিভ চিন্তা মাথায় আসে। কয়েক রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি। আমি আমার মেয়ে দুটোকে আলাদা ঘরে থাকতে বলি কিন্তু আমার মেয়ে বলে, আমি আপু ছাড়া ঘুমাতে পারবো না। আসলে ছোটবেলা থেকে সে কখনও একা ঘরে ঘুমায়নি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমার সাথে ঘুমাতো।

 এরপর ক্লাস এইটে তার আপু আসলে সে আলাদা হয়। যদিও এর বেশ কিছুদিন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হতো। বৃষ্টিও চায়নি তার আদরের ছোট বোনকে একা একা রাখতে। হায়রে আবেগ, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা!মানুষ যত বাড়ায়, আর এর সুযোগ নিয়ে করোনা বংশ বিস্তার ঘটায়। মানুষ বিনিময় করে কুশল আর করোনা বিনিময় করে কৌশল।

প্রথমদিকে মুখে স্বাদ ছিলো, এবার ৩/৪ দিনের মাথায় আমার মুখের স্বাদ নষ্ট হয়। ঝাল জিনিস, ভাত এসব তিতা লাগে। টকমিষ্টি জিনিসের স্বাদ নষ্ট হয়নি। এ জন্য লেবুর শরবত, মাল্টার জুস খেতে পারতাম। আমার অতিপ্রিয় সিদ্ধ ডিমও দুর্গন্ধ লাগে। আমি মাথা ব্যথার জন্য ঝান্ডু বাম ব্যবহার করি এবং এটার গন্ধ লাগে বিস্কিট এর মতো।

এসব লক্ষণে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হই যে আমাদের বাড়ির সবার করোনা হয়েছে। আরও নিশ্চিত হওয়ায় জন্য পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষার জন্য প্রথমে আমার স্ত্রীর বড় ভাই ডাক্তার আরোজকে বলি ঢাকায় তার বন্ধুরা কেউ হেল্প করতে পারবে কিনা। আমি চাচ্ছিলাম বাসা থেকে স্যাম্পল দিতে। কিন্তু তার বন্ধুরা জানায় যে বাসা থেকে স্যাম্পল কালেকশন করার সুযোগতো নেই এবং হাসপাতালে গেলেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। 

আমি আমার কলিগ নাছের, ডিএফপির ডিজি কিবরিয়া স্যার এবং আমার বন্ধু আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব রফিকুল হাসান রাজুর কাছে পরীক্ষার বিষয়ে হেল্প চাই। তারা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে একই সমস্যার কথা জানায়। একটা বিষয় বলে রাখা ভালো আমার বন্ধু রাজু প্রথম থেকেই আমার অসুখের কথা জানতো এবং সে প্রায় প্রতিদিন ফোন করে আমাকে সাহস যোগায়। আমি বন্ধু মহলে আমার অসুস্থতার কথা রাজুকে বলতে নিষেধ করছিলাম কারণ আমাদের আর এক বন্ধু মাগুরার জেলা জজ কামরুল হাসান লিটু কোভিড আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছিলো। তাকে নিয়ে বন্ধুরা দুশ্চিন্তায় ছিল। 

এ জন্য আমার খবরটা না জানানোর জন্য অনুরোধ করি। তবে আমার বাসার কাছাকাছি কুশল নামে আর এক বন্ধু থাকে রাজু শুধু তাকে আমার অসুস্থতার বিষয়টা জানায়।

যা হোক কোভিড নিশ্চিত হতে পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের চেষ্টা করি কিন্তু সব জায়গায় একই সমস্যা- সময় লাগবে। রাজু ফোন দিয়ে জানায় আমাদের অফিসার্স ক্লাবে পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল নেয় আমি চাইলে সে সাহায্য করতে পারবে। আপেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের জুনিয়র ছিল এবং সেও আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব।

ক্লাবের বিষয়টা আমি জানতাম কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম বাসা থেকে স্যাম্পল দিতে। যাক রাজু কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যে আপেলের ফোন আসলো এবং সে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, আমি তাকে আপনজন মনে করি না, ছোটভাই হিসেবে দেখি না ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ জন্য তাকে আমার অসুখের কথা জানাইনি। যা হোক আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, এসব বিষয় না, আসলে আমি বাসায় থেকে স্যাম্পল দিতে চাচ্ছিলাম। 

কিন্তু যেহেতু এখন সুযোগ নেই তাই ক্লাবে দিতে চাই। সে বাসার সবার ডিটেইলস নিল এবং আধা ঘন্টা পর জানালো ২ জুলাই সবাই স্যাম্পল দিতে পারবো। সে দিন ছিল ৩০ তারিখ মানে আরও দুই দিন অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে কিবরিয়া স্যার ফোন দিয়ে জানায় যে এখন কেউ বাসা থেকে স্যাম্পল নিচ্ছে না। আমি তাকে বলি ক্লাবে করাতে চাই এবং দ্রুত। আপেলের কথা তাকে বলি। কিবরিয়া স্যার বলল, আচ্ছা দেখছি। পরে স্যার জানালো ১ জুলাই হবে, তবে ২ জনের। বাকী ২ জন পরের দিন অর্থ্যাৎ ২ জুলাই দিতে পারবে। সব থেকে যে দুজনের বেশী সমস্যা তারা আগে দাও। আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে আমি ও আমার স্ত্রী আগে দিবো পরের দিন না হয় মেয়ে দুটো দিবে। 

ক্লাব সেক্রেটারি মেজবা স্যার (যিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব) এর কিছুক্ষণ পর ফোন দিয়ে জানায়, তোমাদের ২ জন কাল ১০-১২টার মধ্যে ক্লাবে যেও। সবার এক সাথে করতে পারলে ভালো হতো কিন্তু এখানে প্রতিদিন মাত্র ৩০ জনের স্যাম্পল নেওয়া হয়। কালকে তোমাদের একোমোডেট করছি দুজনকে বাদ দিয়ে। তারা তত সিরিয়াস রোগী না। সেকেন্ড টেস্ট দিবে।

আমি ও আমার স্ত্রী ১ জুলাই স্যাম্পল দিতে ক্লাবে গেলাম সকাল ১০.৩০টায়। সেখানে আগে থেকেই পনের জনের মতো রোগী ছিল। সবাইকে আগে নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। আমরাও করলাম। প্রায় এক সপ্তাহ পর বাসার বাইরে যাওয়াতে সেদিন খুব ভালো লাগছিল। আবহাওয়া বেশ ভাল ছিল। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বেশ উপভোগ করছিলাম। একটু পর খেয়াল করলাম একটা জীপ থেকে মেজবা স্যার নেমে ক্লাবের ম্যানেজার শরীফ সাহেবকে কী জানি নির্দেশনা দিচ্ছেন। আজকে আমাকে টেস্ট

এর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম এবং যথারীতি কুশল বিনিময়ের পর ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের ৪ জনের এক সাথে করতে পারলে ভালো হতো। কালকে একটু কষ্ট করে এসো ভাই। শরীফ সাহেবকে বললেন, আমি যেন পরের দিন রিপোর্টটা পাই। এরপর তিনি ঐ স্থান ত্যাগ করলে শরীফ সাহেব আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য বললেন, স্যার করোনা কোনো রোগই না। তিনি দুই এক জনের নাম বললেন যারা পজিটিভ হওয়ায় পর এক সপ্তাহে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন কিছু টোটকা ট্রিটমেন্ট করে। এই যেমন তুলসি পাতা, চা, গরম মসলা মধুসহ পানি সহকারে সংমিশ্রণ তৈরী করে গরম করে দিনে ৪/৫ বার খেলে সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হওয়া যাবে।

সেদিন স্যাম্পল দিয়ে বাড়িতে আসার পর আমার গলা ব্যথা ও কাশি বেড়ে যায়। আমাদের কলোনিতে তুলসী গাছ আছে। সেটা দিয়ে আমার স্ত্রী শরীফ সাহেবের টোটকা বানিয়ে দেয়। অবশ্য এতে আমি কিছুটা আরামবোধ করি। পরের দিন অর্থ্যাৎ ২ জুলাই ২ মেয়ে স্যাম্পল দেওয়ার কথা কিন্তু আমার ভাইয়ের মেয়ে সেদিন বেশী অসুস্থ হওয়ায় আর যেতে পারেনি। আমিও জোর করিনি কারণ আমার মেয়ে শ্রাবন্তী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে গেছে, তার বোন বৃষ্টি একটু সুস্থ হলে পরেও স্যাম্পল দেয়া যাবে। পরের দিন বৃষ্টিও সুস্থ হয়ে যায় এবং স্যাম্পল দিতে অনিহা প্রকাশ করে।

আমার ইমেইলে ১ জুলাই মধ্য রাত অর্থ্যাৎ ২ জুলাই আমার ও আমার স্ত্রীর রিপোর্ট আসে কোভিড পজিটিভ। আমি একবার ভাবি হাসপাতালে ভর্তি হবো আবার পরক্ষণেই পিছপা হই। কারণ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে হাসপাতালের কোভিড রোগীর চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার নিয়ে নিউজ প্রচার করে যা আমার মনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরী করে। এদিকে খেতে না পারার জন্য ইতোমধ্যে আমার দেহ শীর্ণকার হয়ে যায়। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার স্ত্রীও অসুস্থ অবস্থায় গৃহস্থালি কাজকর্ম করার কারণে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে।

৫ জুলাই ভোরে ৪.৩০টা ফজরের নামাজের জন্য উঠলে আমি শ্বাসকষ্ট অনুভব করি। আমার স্ত্রীও নামাজের জন্য উঠে। নামাজ শেষে আমি তাকে বিষয়টা জানাই। ভোররাত অসময়ে এ খবর শুনে আমার স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সে আমার কলিগ নাছের, বন্ধু রাজু, তার বড় ভাই ডাক্তার আরোজসহ পরিচিত অনেককে ফোন করে সাহায্য প্রার্থনা করে। আরোজ ভাই এ খবর শুনে বিচলিত হয়ে পড়ে এবং ঢাকায় তার ডাক্তার বন্ধুদের কাছে সাহায্যের জন্য ফোন করে। এত ভোররাতে কেউ ফোন ধরেনি কিন্তু একজন বন্ধু এক রিংয়েই তার ফোন ধরে কি বিষয় জানতে চায়। তাকে বিষয়টি বললে তিনি আমাকে সরাসরি কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠাতে বলেন। তিনি আরোজ ভাইকে অভয় দেন যে এ নিয়ে তাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। তিনি নিজেই এর তত্ত্বাবধান করবেন। আরোজ ভাইয়ের সহপাঠী এই ডাক্তার বন্ধুটি কুর্মিটোলা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল। জামিল অতিশয় ভদ্র, পেশাগতভাবে অত্যন্ত দক্ষ এবং চিকিৎসা সেবায় একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ।

আমার স্ত্রী আমাকে হাসপাতাল যাওয়ার জন্য তৈরী হতে বলে। কিন্তু হাসপাতালে যেতে তখনও আমি ইতস্তত করি প্রথমত মিডিয়ায় সংবাদ এবং দ্বিতীয়ত মেয়ে দুটো বাসায় একা একা কিভাবে থাকবে সে চিন্তায়। আমি তাকে বলি, আর একটু দেখি, যদি ভালো বোধ করি না গেলেও চলবে। আমার স্ত্রী নাছোরবান্দা, সে আমাকে হাসপাতালে নেবেই। কেননা সে সর্বক্ষণ আমার অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করছিল এবং তার ভাইকে রিপোর্ট করছিলো। এক সময় সম্ভবত আমার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮০’র কাছাকাছি চলে আসে। আমার স্ত্রী এটা তার ভাইকে জানালে তিনি সমূহ বিপদের আশংকা থেকে আমার সাথে নিজেই ফোনে কথা বলেন। 

আমাকে বলেন যে, তোমাকে তারা আউটডোরে চিকিৎসা দেবে, মোটামুটি সুস্থ হলে আজকে ছেড়ে দেবে। এবার আমি রাজি হলাম এ জন্য যে বিকেলের মধ্যে তাহলে বাসায় আসতে পারবো। কিন্তু আমার অবস্থা এতটা সংকটাপন্ন এবং এটা একদিনে যে উন্নতি হবে না সেটা আরোজ ভাই ডাক্তার হিসেবে বেশ বুঝতে পারছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আমাকে হাসপাতালে একবার নিতে পারলে পরে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখবেন। 

এদিকে ক্লাব সেক্রেটারি মেজবা স্যার সরকারি কর্মচারি হাসপাতালে আমার ভর্তির ব্যবস্থা করেন। কিবরিয়া স্যার বলেন, সেখানে যেতে কেননা সেটা আমার সার্কিট হাউজ বাসা থেকে কাছে। আমার স্ত্রীও তাদের কথায় সায় দেয় এবং আমাকে বলে, আমরা বরং কর্মচারি হাসপাতালে যাই, এটা বাসার কাছে হবে। কিন্তু আমি তাকে বলি, গেলে কুর্মিটোলা হাসপাতালেই যাব। আর যাই হোক আর্মিদের ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত ভালো হয়। তাছাড়াও তো একজন পরিচিত জনের মাধ্যমে ভর্তি হবো। আমার কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল সেটা পরে বুঝতে পারি। ঐ দিনই অর্থাৎ ৫ জুলাই আমি কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হই এবং ৩০ নং কেবিনে চলে যাই। ব্রি. জামিল ভাই আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সেদিন থেকেই অক্সিজেন সাপোর্টে শ্বাস প্রশ্বাস নেই। 

৬ জুলাই সম্ভবত সকালে আমি বাথরুমে পড়ে যাই। ব্রিগে. জামিল এটা জানার পর সেদিন থেকে হুকুম হলো বাথরুমে গেলেও যেন অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যাই। কিন্তু এটা তার পরের দিনও ঘটে যদিও এইদিন আমি বাথরুমে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ যাই। অথচ পড়ে যাওয়ার বিষয় আমার কিছুই মনে নেই। প্রথম দিন ডাক্তাররা ভেবেছিলেন, বাথরুমে অক্সিজেন না নিয়ে যাওয়ার কারণে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম কিন্তু পরের দিন এর পুনরাবৃত্তি হওয়ায় তারা দুশ্চিন্তায় পড়েন। পরে এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, আমার ব্লাড প্রেসার ৪০ এর নিচে, সুগার লেবেল ৩.৫ এবং এটা অনুসন্ধান করেছিলেন ব্রিগে. জেনারেল ডা. জামিল। 

এ রকম অবস্থায় মানুষের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপা ও সবার দোয়ায় আমি বেঁচে যাই। কেননা বাথরুমের দরজা খোলা ছিল এবং সেখানে আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিল। দুই দিনেই সে একেবারে ফ্লোরে পড়ে যাওয়ার আগে ধরে ফেলে এবং আমার নিস্তেজ দেহটাকে কোনো রকমে বাথরুম থেকে বের করে আনে। প্রথমেই সে পড়ে যাওয়া অক্সিজেন মাস্কটি আমার মুখে লাগিয়ে দেয়।

সে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ও ভয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। পাশের কেবিনের একটি মেয়ে সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের কেবিন অতিক্রম করছিল। আমার স্ত্রী তাকে ডাক্তার বা নার্স যে কেউ একজনকে ডেকে দেওয়ার অনুরোধ করে। নার্স আসলে আমাকে বেডে নেয়া হয়। আমার স্ত্রীর অবস্থা দেখে সেদিন নার্সটি বলেছিল আপা আপনাকে যদি জড়িয়ে ধরে মাথায় একটু হাত বোলাতে পারতাম। কিন্তু আমার স্ত্রীও কোভিড রোগী ছিল। একটু পরেই ডাক্তার আসে এবং এ দিন থেকে আমাকে স্যালাইন দেয়া হয়, যেহেতু মুখে খেতে পারছিলাম না। 

এছাড়া ব্লাড প্রেসার ও সুগার লেবেল বৃদ্ধির জন্য ব্রিগে. জামিল ভাই সে দিন বিকেলে আমার জন্য চকলেট, কোক, গ্লুকোজ ও জুস পাঠিয়ে দেন এবং কষ্ট হলেও এগুলো খেতে বলেন। জামিল ভাই বলেন, তার হাসপাতালে এ পর্যন্ত যত মৃত্যু হয়েছে তার অধিকাংশই বাথরুমে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। তিনি আমার স্ত্রীর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করেন এবং ধন্যবাদ জানান এ জন্য যে, সে আমাকে ফ্লোরে পড়ে আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা করেছে এবং যথা সময়ে ডাক্তার  নার্সকে খবর দিয়েছে, এটা না হলে হয়ত ঐ দিনই সবকিছু শেষ হয়ে যেত।

আমি ২৩ দিন হাসপাতালে ছিলাম। আমাকে প্রতিদিন সকালে নাভিতে একটা ইনজেকশন এবং ২৩ দিনে ৩০টি ইনজেকশন দেয়। শেষের ৭ দিন সকাল ও রাতে দুই বেলা নাভিতে ইনজেকশন দিত। আরও ২/৩টি ঔষধ ইনজেটবল ফরমে দিত। নার্সরা এত দক্ষ যে ইনজেকশন দেওয়ার সময় আমি টেরই পেতাম না। আর বড়ি বা ক্যাপসুল খেতে হতো দিনে ১৫/১৬টি। ডাক্তার ও নার্সদের ব্যবহার ছিলো অমায়িক। তারা এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করতো আমি কেমন বোধ করছি। আমি যদি বলি ভালো তারা খুব খুশী হতেন। আমার বেশ অবাক লাগে, আমি ৫/১০ মিনিট ফ্যান অফ করে থাকতে পারতাম না কিন্তু তারা সুস্থ সবল মানুষ এই গরমে পিপিই পরে কীভাবে হাসিমুখে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।

২০ জুলাই হাসপাতালের ১৬ তম দিনে আমি আমার শরীরের ওজন করলে পাই ৫৯ কেজি যেটা অসুস্থতার আগে ছিলে ৭০ কেজি। অবশ্য এদিন থেকে আমি অল্প স্বল্প খাওয়া দাওয়া করতে পারি। হাসপাতালে যথেষ্ট ভালো খাওয়া দিতো। জনপ্রতি সকালে-অর্ধেক পাউরুটি, জেলি, দুটা সেদ্ধ ডিম, ২৫০ লিটার দুধ; দুপুরে-ভাত, মাছ বা মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল এবং একটি ম্যাংগো জুস; বিকেলে- ২টি কলা, বিস্কিট ১ প্যাকেট, ২টি আপেল ও মসলাযুক্ত চা আর রাতে-ভাত, মাছ বা মুরগির মাংস, ডাল, সবজি। 

একজন করোনা রোগীর সুস্থতার জন্য পুষ্টিকর যে খাবার প্রয়োজন তাই সরবরাহ করা হতো। যদিও দুধ, জুস ও আপেল ছাড়া হাসপাতালের আর কোনো খাবার খেতে পারতাম না। বাসা থেকে আমার মেয়ে ও ভাইস্তি আমার পছন্দের খাবার পাঠাতো। এরপর থেকে আমার ওজন বাড়তে থাকে। ২৩ তারিখ বাসায় এসে ওজন করি ৬৪ কেজি। যেটা এখন ৬৫ কেজি। ওজন বাড়ার একটি কারণ আছে তাহলো-আমি যখন খেতে পারছিলাম না তখন একটি খাবার খুব খেতে ইচ্ছে করছিলো, সেটা হলো-পান্তা ভাত। প্রথমে আমার স্ত্রী সেটা দিতে চাননি পরে যখন শুনলো আমার বন্ধু লিটুও সেটা খাচ্ছে তখন সে দেয়। এবং পান্তা ভাত আমি বেশ মজা করে খেতাম ও যেটা আমার মুখের স্বাদ নষ্ট করেনি এবং এখনও খাচ্ছি।

আমাকে বাসায় ফেরানোর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার স্ত্রীর। এই ২৩ দিনের মধ্যে ২২ দিন সে রাতে নির্ঘুম কাটিয়েছে যাতে কোন সময় আমার অক্সিজেন ডিসপ্লেসড না হয়। অক্সিজেন শেষ হলে নিজে সিলিন্ডার টেনে এনে আবার আমার মুখে লাগিয়ে দিয়েছে। অথচ নিজেও করোনা রোগী। ২৩ দিনে প্রায় ১০০ বা তার বেশী সিলিন্ডার আমি ব্যবহার করেছি। ৫/৬ টা বাদে প্রায় সবগুলো সে বহন করেছে। সিলিন্ডার টানতে গিয়ে তার বুকে ব্যথা হয়। এরপরও সে থেমে থাকেনি। শেষের দিকে হাসপাতালের একটা বয় তাকে মাঝে মাঝে হেল্প করতো। মানুষের মনোবল কতোটা দৃঢ় ও শক্ত হলে রোগী হয়েও এভাবে সেবা করতে পারে। নির্ঘুম ও শরীরের ওপর অতিরিক্ত টর্চারের কারণে তার রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়। রক্ত শূন্যতার জন্য ডাক্তার তাকে ব্লাড-স্যালাইন দেয় পরপর ২টি। কিন্তু সে একটি নেওয়ার পর আর নেয়নি। কেননা একটি স্যালাইন নেওয়ার পর রাত হয়ে গিয়েছিলো এবং সে যদি আবার স্যালাইন নেয় তাহলে আমাকে দেখবে কে। আমি নাকি ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলতাম। তাই সে ঝুঁকি নেয়নি। বলা বাহুল্য হাসপাতালে প্রথম ১৪/১৫ দিন আমি অর্ধচেতন বা ঘুমিয়ে ছিলাম। ফোন রিসিভ করাসহ সব কিছু আমার স্ত্রী করতো।

আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। আমি হাসপাতালে জানতে পারি আমার বন্ধু মাগুরার জেলা জজ লিটু একই হাসপাতালে ভর্তি। বিকেলেই সে তার স্ত্রীকে পাঠায় আমার খবর নেওয়ার জন্য। এর আগে সে আমার মোবাইলে ফোন করে। আমার স্ত্রী ফোন রিসিভ করে এবং আমাদের কেবিন নম্বর তাকে জানিয়ে দেয়। যা হোক ভাবী এসে জানায় তার বাড়ির সবাই করোনায় আক্রান্ত, ৪১ নম্বর কেবিনে একত্রে আছে যেটা একই ফ্লোরে। লিটু ছাড়া মোটামুটি সবাই সুস্থ। ভাবী আমার স্ত্রীকে কিছু বিষয় শিখিয়ে দেয় যেমন অক্সিজেন শেষ হলে কোথা থেকে আনতে হবে, মুখে কিভাবে লাগাতে হবে, অক্সিজেন ফ্লো কিভাবে বাড়াতে কমাতে হবে। 

ভাবী আরও বলেন, কোনো কিছু প্রয়োজন হলে যেন কোন রকম ইতস্তত না করে তাকে জানানো হয়। এরপর প্রতিদিন ভাবী ৩/৪ বেলা আমাদের খবর নিতেন এবং আমি খেতে পারতাম না বলে একটা স্যুপ বানিয়ে নিজেই সেটা দিয়ে যেতেন। বলা বাহুল্য এই স্যুপটা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আমার দুর্বল শরীরে কিছুটা শক্তি যোগায়। লিটু আমার সপ্তাহ খানেক আগে হাসপাতাল ভর্তি হয় এবং স্বাভাবিকভাবে আগেই রিলিজ হয়। কিন্তু যাওয়ার আগে আমার বন্ধু আমার সাথে দেখা করে। ভাবী আমার স্ত্রীকে স্যুপ রান্না শিখিয়ে দেন এবং কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে যান। ভাবীর মতো এমন পরোপকারী ও মহানুভব ব্যক্তিত্ব আজকাল সত্যিই বিরল। তিনি নিজেই অসুস্থ এরপরও আমাদের নানান প্রয়োজনে সহায়তা করেছেন।

কৃতজ্ঞতা জানাই যারা এই দুঃসময়ে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন- অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সিনিয়র জুনিয়র অনেক সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-সজন, ব্যাচমেট, সাংবাদিক বন্ধু, শুভাকাঙ্খী প্রায় প্রতিদিন আমাদের খোজ নিয়েছেন ও সাহস যুগিয়েছেন। সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

আমাদের করোনা নেগেটিভ রেজাল্ট ৮ জুলাই চলে আসে কিন্তু না খেতে পারার কারণে আমার অন্যান্য আরো অনেক সমস্যা দেখা দেয়। ব্লাড প্রেসার ও সুগার লেবেল নিচে নেমে যাওয়াসহ গলা ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডাক্তার আমাকে আরও কিছুদিন হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু কোরবানির ঈদের কারণে আমাদের রিলিজ দেয়া হয়। হাসপাতালেই প্রেসার ও সুগারের সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। অন্যান্য সমস্যার জন্য আরও ২ মাস ঔষধ খেতে হবে। এছাড়া দুই সপ্তাহের মধ্যে গলার সমস্যা ও অক্সিজেন স্যাচুরেশন ঠিক না হলে সিটি স্ক্যান করে একজন ফুসফুস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলা হয়।

(১২ আগস্ট ২০২০ খ্রি.)

এমবি//