ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রেনেসাঁ’র দেশে (পঞ্চম পর্ব)

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ০৭:৩৫ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৭:৪৫ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০২০ শনিবার

ভেনিস শহরটি পুরোটাই সমুদ্রের পেটের মধ্যে। সমুদ্রের নীল সবুজ পানির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই ছোট শহরটি। দেখে মনে হবে বাতাসে ঢেউয়ের দোলায় দুলছে শহরটি। এটি ইউরোপের এমন একটি শহর যেখানে সবাইকে পায়ে হেঁটে বা নৌকায় চড়ে বেড়াতে হয়। মোটরচালিত কোনো যানবাহন না থাকায় সেখানে পরিবেশ দূষণ একেবারেই নেই। শহরটিকে ভাসমান শহরও বলা হয়। ভ্রমণপিপাসু যে কোনো ব্যক্তিরই মনের সুপ্ত বাসনা থাকে একবার হলেও ভেনিস ঘুরে দেখার। ১১৮টা ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে ভেনিস শহর গঠিত। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিলো বিখ্যাত ম্যুরানো, ভ্যুরানো ও লিডো দ্বীপ ঘুরে দেখার।

দুপুরে মামার বাসায় খাবার শেষ করে আমরা গাড়িতে করে গ্র‍্যান্ড ক্যানেলের পাশে একটা স্টেশনে এসে নেমে সবাই পায়ে হেঁটে কিছুটা পথ এগিয়ে একটা ওয়াটার ট্যাক্সি ভাড়া করে সানমার্কো স্কয়ারে যাবার পথে ভেনিসের বিখ্যাত 'রিয়ালতো' ব্রিজ হয়ে সেখানে পৌঁছালাম। ট্যাক্সিতে বসেই দেখতে পেলাম "সান্তা মারিয়া ডেলা স্যালুট চার্চ", যেটা বানাতে প্রতিটি চার মিটার উচ্চতার মোট ১১ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭টি কাঠের খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে। আরও দেখেছি- বিশাল একটি প্রমোদতরী।

মোটরযান-এর শেষ গন্তব্য 

বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্কোপোলো-এর নামানুসারে এই এলাকার নাম সানমার্কো করা হয়েছে। এখানে অবস্থিত বিখ্যাত চার্চ "ব্যাসিলিকা ডি সানমার্কো"। এই চার্চে অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। আমরা তেমনই একটি বিয়ের ফটোসেশন দেখতে পেয়েছিলাম। একটা মিউজিয়ামও আছে। এই সানমার্কো স্কয়ারে পৌঁছাতেই একঝাঁক কবুতর এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো যে, মনে হলো- আমাদের অভ্যার্থনা জানানোর জন্যই এরা দাঁড়িয়ে আছে। টুরিস্টদের গায়ে হাতে মাথায় সর্বত্রই কবুতর খেলা করে। পাঁচ ইউরো দিয়ে কিছু খাবার কিনে কবুতরগুলোকে খেতে দিলাম। মনে হলো যেন আমাদের দেশের জালালি কবুতর।

কবুতরের অভ্যর্থনা

সানমার্কোর সাথেই বিশাল গন্ডোলা স্ট্যান্ড। জোয়ারের পানিতে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় সানমার্কোর সামনের বিশাল মাঠ তলিয়ে যায়। পূর্ণিমার জোয়ারে অনেক বেশি পানি হয় সেজন্য আশেপাশের দোকানগুলো তেমন ব্যবস্থা নিয়েই স্থাপন করা হয়েছে। চারপাশে অনেকগুলো খাবার, শোপিস, লেদারের ব্যাগ, আর মুখোশের দোকানে কিছু শপিং করলাম।

একটা গন্ডোলার সাথে আরেকটা গন্ডোলার ধাক্কা লাগে না আর পুরোনো ভাংগা বাড়িতে ফুলগাছ।

এবার হেঁটে হেঁটে গন্ডোলাতে চড়ার জন্য নির্ধারিত অন্য একটি ঘাটে এসে ১৫০ ইউরো দিয়ে এক ঘণ্টার জন্য একটি গন্ডোলা ভাড়া নিয়ে আমরা ছয়জন গ্র‍্যান্ড ক্যানেলের দিকে যাত্রা করলাম। জামাই, দেবর ও আরও আত্মীয় যারা সাথে ছিলো, তারা পারেই বসে রইলো। যেতে যেতে যে দৃশ্য চোখে পড়েছে তা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

চারিদিকে অথৈ জল, মাঝে বড় ছোট অনেক বিল্ডিং আছে যেগুলো হোটেল হিসেবে ভাড়া দেয়া হয় এবং কখনো শূন্য থাকে না। বাড়িগুলোর পলেস্তরা খসে গেছে কিন্তু সৌন্দর্যপিপাসু ভেনিজিয়ান মানুষ ফুল দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে রেখেছে যা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। একটা জিনিস খেয়াল করে দেখতে পেলাম যে গন্ডোলাগুলো এতো সরুপথে যাতায়াত করে তবুও একটার গায়ে আরেকটা ধাক্কা লাগে না।

মুখোশ-এর দোকান

গন্ডোলার চালককে গন্ডোলিয়ার বলে। গন্ডোলিয়ার অনেক সম্মানীত একটি পেশা। অনেক শিক্ষিত ছেলেরাও এই পেশায় ন্যস্ত। সারাদিন টুরিস্ট নিয়ে গ্র‍্যান্ড ক্যানেলে ঘোরা আর ভেনিস সম্পর্কে টুরিস্টদেরকে কিছু তথ্য প্রদান এই মোটামুটি কাজ। চেহারা দেখেই বোঝা যায় বেশিরভাগ আদি ইতালিয়ানরাই এই পেশায় কাজ করে। আমার এক কাজিনের বাসায় বিকেলের নাস্তা করে আমরা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে সানমার্কো স্কয়ারেই ১৮ ইঞ্চির বিশাল সাইজের কয়েকটি টুনা পিজ্জা দিয়ে সবাই মিলে ডিনার করে হোটেলে ফিরে যাবার সময় পূর্ণিমার আলোতে পথ চলেছি। কারণ রাত সাড়ে ৭টায় ভেনিসের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য যেটা আমার ভ্রমণ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পরদিন সকালে হোটেলে নাস্তা করে আমরা সবাই মিলে ম্যুরানো দ্বীপ, ভ্যুরানো দ্বীপ ও লিডো দ্বীপ দেখতে আবারও সী ট্যাক্সিতে রওনা হলাম, সারাদিনের জন্য জনপ্রতি ২০ ইউরো দিয়ে টিকেট কেটে। একটি ব্যাপার না বললেই নয় যে, ওখানে সাগরে ট্রাফিক সিস্টেম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মেনে চলে সবাই। আমাদের ট্যাক্সি নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই চলে এসেছিলো তাই সে জেটি থেকে কিছুটা দূরে পাঁচ মিনিট স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।

গন্ডোলার স্ট্যান্ড। এখান থেকেই গ্র‍্যান্ড ক্যানেলের দিকে যেতে হয়

ম্যুরানো দ্বীপের কাঁচের তৈরী নানান রকম শোপিস আর গহনা পৃথিবী বিখ্যাত। আমরা সেই কাঁচের শোপিস বানানো স্বচক্ষে দেখতে একটি কারখানায় জনপ্রতি ৫ ইউরো দিয়ে গ্যালারিতে বসে ওদের চমৎকার নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিছু কাঁচের চীপস আগুনে গলিয়ে পেপারওয়েট, ঘোড়া, ফুলদানি, গোলাপ ফুল, ছোট বড় গহনা বানিয়ে ফেললো মুহূর্তের মধ্যেই, যা দেখে সবাই মুগ্ধ!

ভ্যুরানো দ্বীপ ও একই রকম। লিডো দ্বীপে নেমে সবার চক্ষু ছানাবড়া! ওখানে সবাই স্বল্পবসনা যেটা উন্নত বিশ্বের সামারের দৃশ্য। আর আমরা সবাই তো আপাদমস্তক আবৃত। তার উপর সাঁতার কাটার মতো কোনো পোশাকও নিয়ে যাইনি। কিছুক্ষণ সেখানে সমুদ্রের তীরে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে, সানগ্লাস চোখে দিয়ে সাগরের নীলজলে আখি শান্ত করে আবারও সেই সী ট্যাক্সিতে করে ফিরে গেলাম ভেনিসের হোটেলে। রাতে বের হয়ে সমুদ্র পারে পাস্তা দিয়ে ডিনার করে ফিরে গেলাম। পরদিন মিলান যাবো তার প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

চলবে...

লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

এনএস/