ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

কেমন আছেন জজ মিয়া

সাভার সংবাদদাতা

প্রকাশিত : ০৪:৫৩ পিএম, ২১ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার

একুশে আগস্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নৃশংসতম অধ্যায়ের জন্ম দেয় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। মূল হোতাদের বাঁচাতে সাজানো হয় জজ মিয়ার গল্প। সহজ-সরল যুবক মোহাম্মদ জালালকে (জজ মিয়া) ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে নৃশংসতম হামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাজানো মামলায় ফেঁসে গিয়েছিলেন৷ করোনাকালে কেমন আছেন তিনি? প্রথমে গ্রেফতার করা হয় শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে। এর কয়েকদিন পর রাজধানীর মগবাজার এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেছুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এখানে ব্যর্থ হয়ে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় মোহাম্মদ জালালকে। 

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তৎকালীন বিরোধী দলের প্রধান শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়। তবে দলীয় নেতাকর্মীদের মানবঢলে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা সেদিন অল্পের জন্য এই ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বেগম আইভি রহমান ও অপর ২৪ জন এতে নিহত হন। 

এছাড়াও এই হামলায় আরও ৪ শত জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। আগস্টের আরেক নৃশংসতার কথা জেনে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তখনকার বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

এমন দিনে গুলিস্তানের হকার জালাল ঢাকায় ছিলেন না। নোয়াখালীর সেনবাগের গ্রামের বাড়িতে ছিলেন সেদিন। এলাকায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। এতে যোগ দেন যুবলীগকর্মী জালাল৷ এর মাস কয়েক পরে তাকেই করা হয় গ্রেনেড হামলার অন্যতম হোতা। জজ মিয়াকে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটি সাজানো জবানবন্দি আদায় করে সিআইডি। একটা সময় গণমাধ্যম বের করে আনে প্রকৃত তথ্য, ফাঁস হয়ে যায় জজ মিয়ার আষাঢ়ে গল্প। জোট সরকার বদলের পর গ্রেনেড হামলার মামলার তদন্ত আবার হয়। তাতে খালাস পান মোহাম্মদ জালাল।

২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেওয়া ওই কথিত স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।

সেই জজ মিয়া এখন কেমন আছেন? তিনি জানান, টুকটাক ঠিকাদারি করে সংসার চালান। তবে করোনা ভাইরাসের সাধারণ ছুটির সময় ঘরে বসে ছিলেন। তখন ঋণ করে সংসার চালিয়েছেন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় পড়ে বছর পাঁচেক জেলে থাকতে হয়ে জালালকে। কারাবন্দি সেই জীবন ভুলতে পারেন না তিনি৷ এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘এটা তো অবশ্যই মনে পড়বে৷ মনে পড়বে না? আমার জীবন থেকে পাঁচটা বছর হারিয়ে ফেলেছি। এই মামলায় মনে করেন, আমার ফ্যামিলি, আমার মা-ও মারা গেল দৌড়াদৌড়ি কইরা। এডাতো আর ভোলার কথা না৷ এটা মনে করেন, যতদিন দুনিয়াতে বাঁইচা থাকুম ততদিন স্মরণ হইয়া থাকবো।’

কারামুক্ত এই জীবন সম্পর্কে মোহাম্মদ জালাল বলেন, ‘এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আর সত্য কোন দিন চাপা থাকে না। সত্য এক দিন প্রকাশ হইয়া যায়। আল্লাহ একদিন এটা প্রকাশ করছে। যারা এই ঘটনা ঘটাইছে তাদের বিচার হইছে৷ বিচারে একটা রায়ও পাইছি।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের সাত-আট মাস পর আমাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রামের চৌকিদার বাড়িতে এসে বলেন, ‘তোমার নামে থানায় মামলা আছে।’ এরপর সেনবাগ থানার কবির দারোগা এসে আমাকে হ্যান্ডকাফ লাগান। থানায় নেওয়ার পর কবির দারোগা বলেন, ‘তোমার নামে এখানে কোনো মামলা নেই। ঢাকা থেকে সিআইডির এসপি রশিদ সাব আসতেছেন। ঢাকায় তোমার নামে বড় মামলা আছে। সেনবাগ থানায় এসপি রশীদ ক্রসফায়ারে মারার ভয় দেখিয়ে বলেন, যা শিখিয়ে দিব সেগুলো কোর্টে বলতে হবে।’

গণমাধ্যমে জজ মিয়ার নাটকের কথা উঠে আসলে চরম প্রতিবাদ শুরু হয়। এরপর আর তেমন জোট সরকার এ সাজানো মামলাকে এগিয়ে নিতে পারেনি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এই মামলার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অব্যাহতি দেওয়া হয় জোট সরকারের আমলে গ্রেফতার হওয়া জজ মিয়া, পার্থসহ ২০ জনকে। সেই জজ মিয়া এখন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালক। সামান্য আয়ে স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে কোনো রকমে চলে তার সংসার।’

এমএস/এসি