ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মায়ের ভালোবাসা

সমর ইসলাম

প্রকাশিত : ১০:৩৯ এএম, ৩০ আগস্ট ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৪:১৩ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২০ রবিবার

‘ভাইয়া, অফিসে নিয়মিতই আসছি। লেখা দিয়েন।’-নাজমুস শাহাদাতের ছোট্ট এসএমএস। শাহাদাত প্রথম বাবা হবেন। তার স্ত্রী হবেন প্রথম মা। চোখজুড়ে কত স্বপ্ন। কত প্রস্তুতি তাদের। অনাগত অতিথিকে বরণ করবেন। তার জন্য অধীর অপেক্ষা। প্রতিটি বাবা-মা যেমনটা করেন।

ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দুঃসংবাদটা পাই। শাহাদাতের স্ত্রী সন্তান প্রসব করেছেন ঠিকই। কিন্তু পৃথিবীর সকল মায়া কাটিয়ে নিজে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দশ মাস যে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন মা, সেই মা আদর করে একটিবার কোলে নিতে পারেননি সন্তানকে। শাহাদাত বুকের তলে জগদ্দল পাথর চাপা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, তার সন্তান ভালো আছে।

শাহাদাতের স্ত্রী বিয়োগের কথা শুনে আমি স্বজন হারানোর ব্যথা অনুভব করেছি। বিমর্ষতা কাটাতে সময় লাগছিল। কিছুতেই লেখায় মন দিতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে শাহাদাতের অফিসে নিয়মিত হওয়া এবং লেখা দেওয়ার তাগাদা আমার সম্বিত ফিরিয়ে দেয়। ভাবি, জীবন প্রবহমান। কারও জন্য কোন কিছু থেমে থাকে না। কারও চাওয়ার পরোয়া করে না জীবননদী। বইছে অবিরাম। কখনও কোলাহলমুখর, কখনও বা সন্তর্পণে।

পৃথিবীতে যত রকমের সম্পর্ক আছে তার মধ্যে মা এবং সন্তানের সম্পর্ক ভিন্নতর। এ এক অপার্থিব সম্পর্ক। মা আর সন্তানের সম্পর্ক নাড়ীর সম্পর্ক, প্রাণের সম্পর্ক। শাহাদাতের শিশু সন্তান জন্মের পরই মাকে হারিয়েছে। মায়ের ছবিটা হয়তো বড় হয়ে দেখবে। কিন্তু মায়ের স্পর্শ পাবে না, মাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মায়ের শাসন সোহাগ, আদরমাখা বকুনি কোনোটাই সে পাবে না। নিশ্চয়ই একদিন সে বড় হবে। দোয়া করি, শুধু দেহে নয়; চিন্তায়ও বড় হোক শাহাদাতের মা-হারা এই সন্তান। পৃথিবীর অনেক বড় বড় মনীষীই ছোটকালে মা, বাবা অথবা উভয়কেই হারিয়েছেন।

সন্তানের প্রতি স্নেহময়ী এক মায়ের ভালোবাসার বিরল ঘটনা মনে পড়ছে। ঝিনাইদহের ঘটনা। একুশে টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি, সাংবাদিক এম রায়হান সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। মমতাময়ী এই মায়ের নাম সুখিরন নেছা ওরফে ভেজিরন নেছা। বাড়ি ঝিনাইদহের মধুহাটী ইউনিয়নের বাজার গোপালপুর গ্রামে। স্বামী আবুল খায়ের মারা যান কয়েক বছর আগে।

১৯৭৫ সাল। খায়ের-সুখিরন দম্পতির বড় ছেলে শহিদুল ইসলাম। বয়স তখন এগার বছর। হঠাৎ একদিন শহিদুল হারিয়ে যায়। মায়ের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। কেঁদে বুক ভাসান তিনি। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। কোথাও ছেলেকে পাওয়া গেলো না। মায়ের ইচ্ছায় আশপাশের অন্তত তের-চৗদ্দটি মসজিদ ও দরগায় ভোজের আয়োজন করা হয়। কারণ, তখন দেশে খুব অভাব ছিল। 

খাবারের খোঁজে যদি ছেলে শহিদুল মসজিদ বা দরগায় আসে। তাছাড়া গরীব মানুষেরা খাবে। দোয়া করবে আল্লাহর কাছে। সেই দোয়ার বরকতে ফিরে আসবে ছেলে। কিন্তু ছেলে তার ফিরে আসে না। ছেলেকে হারিয়ে কোথাও শান্তি পান না মা। অনেক দিন সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে ব্যাকুল মা পাগলের মতো হয়ে যান।

দেড় মাস পরের কথা। রোজার মাস এসেছে। ততদিনে পাড়া-প্রতিবেশীরাও শহিদুলকে খোঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। রোজা রেখে একদিন সন্ধ্যার আগে গ্রামের কাজীপাড়া জামে মসজিদের কাছে ছেলেকে খুঁজতে যান মা সুখিরন। হঠাৎ তার মনে এক খেয়াল আসে। মনে মনে আল্লাহর সাথে সন্ধি করেন তিনি। যদি তার ছেলে ফিরে আসে তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যতদিন বেঁচে থাকবেন রোজা রাখবেন তিনি। গ্রামের মসজিদ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেন মা সুখিরন নেছা। তারপর আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করেন; দোয়া করেন। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসেন সুখিরন। দেখেন উঠানে তার ছেলে শহিদুল দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকছে।

মায়ের কষ্টের কান্না এবার আনন্দের অশ্র হয়ে ঝরছে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে হাত তুলেন মা। শোকর আদায় করেন আল্লাহর। বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বলেন, হে আল্লাহ! তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছো। আমিও আমার ওয়াদা রক্ষা করবো। যতদিন বেঁচে থাকবো তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি রোজা রাখবো।

শুরু করেন রোজা রাখা। এরপর চুয়াল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন সুখিরন। ছেলের জন্য একদিনও রোজা ভাঙ্গেননি তিনি। কোনো অসুখ-বিসুখও তাকে রোজা রাখা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। হ্যাঁ, বছরে পাঁচ দিন রোজা রাখতেন না তিনি। সেটা ধর্মীয় বিধানের কারণে। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন, কোরবানীর ঈদের দিন এবং কোরবানীর ঈদের পরবর্তী তিন দিন। এই পাঁচ দিন বাদে সারা বছর তিনি রোজা রাখতেন। কারণ আলেমদের কাছে জেনেছেন, এই পাঁচদিন রোজা রাখা নিষেধ। 

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বৃদ্ধা সুখিরন নেছার বারো মাস রোজা পালনের কথা চিন্তা করে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন। পাড়া-প্রতিবেশীসহ আশপাশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গাটি দখল করেন সুখিরন নেছা। সন্তানের প্রতি ভালোবাসার এমন নজির সত্যি বিরল।

৩১ মে ২০১৯। সুখিরন নেছাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠান ঝিনাইদহের সাংবাদিক এম রায়হান। তার এক মাস আট দিন পর অর্থাৎ ৮ জুলাই তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। সন্তানের জন্য এমন ভালোবাসার নজির যিনি রেখে গেছেন তাঁকে আল্লাহ শান্তিতে রাখুন। রাব্বির হামহুমা কা’মা রাব্বায়ানিস সাগীরা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, একুশে টেলিভিশন।
এআই/ এসএ/