ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

যে বাঁশি ভেঙে গেছে...

সঙ্গীতা ইয়াসমিন

প্রকাশিত : ১১:৫৬ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২০ রবিবার | আপডেট: ১২:০০ এএম, ৩১ আগস্ট ২০২০ সোমবার

সঙ্গীতা ইয়াসমিন

সঙ্গীতা ইয়াসমিন

বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক বসে রইল নিরু। ভাবলেশহীন, নিরুত্তাপ এই গরম পানির শাওয়ার নিতে নিতে শরীর-মন দুইয়ের সাথেই বোঝাপড়া চলছিল তাঁর। কথায় কথায় কান্না পাবার দিন বহু আগেই চলে গেছে, অনুভূতির ভেতরের সূক্ষ্ম বোধগুলো যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। এখন আর সহজে আহত হওয়া, কান্না পাওয়া, নিঃস্ব অনুভব করার মতো আবেগগুলো মাথাচাড়া দেয় না। 

তবে, একটা বোধ এখনো আগের মতোই ধারালো, রক্ত গরম হয়ে ওঠে দ্রুতই; সবকিছু ওলোট পালট করে ফেলতে ইচ্ছে করে নিমেষেই। কেউ অসম্মান করে কথা বললে কিছুতেই সহ্য হয় না, তৎক্ষণাৎ তার যথার্থ জবাবটা না দিতে পারলে নিজেকে কষে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে এখনো। কিন্তু বাস্তবতা তথৈবচ! নিজেকে ঠায় দাঁড়িয়ে রেখে চারপাশের সবকিছু কি বদলানো সহজ? বরং নিজেকে বদলানোটাই সহজ! দীর্ঘ আঠারো বছরে বদলেছে সে অনেক বদলেছে। রুচি, মনন, মেজাজ, বদলেছে ভাবনাও, বদলেছে সয়ে নেবার ক্ষমতাও। কোনোকিছু পাবার আশায় নয়, স্বস্তির আশায়।

ভালোবাসাশূন্য জীবন হয়, জীবনে শান্তিও শূন্যের কোঠায় হলে খুব মন্দ কিছু ঘটে না তাতে। অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য না হলেও জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে। তবে স্বস্তি দরকার জীবনে। প্রতিদিনের, প্রতিমুহূর্তের অস্বস্তি নিয়ে জীবন কাটানো কেবল অসহ্যই নয়, দূর্বিসহ-যন্ত্রণাময়। সুতরাং মনে না নিয়েও মেনে নেওয়ার ভান তো করাই যায়! সংসারে আবদ্ধ অধিকাংশ নর-নারীই যখন দু’আনা ‘সার’ এর ভেতর খুঁজে পান না নিজেদের অস্তিত্ব, তখন বাকী চৌদ্দ আনার ‘সং’ এ-ই তা নিহিত রাখতে হয় বৈ কি!

সংসারে একা মানুষদের কাঁদবার জন্য বাথরুমের থেকে উত্তম জায়গা আর নেই। সে হিসেবে নিরুর এই গরম পানির শাওয়ার নিভৃত্যে নিজের সাথে বোঝাপড়াই নয় কেবল, থেরাপিও বটে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে খানিক বেশি গরম পানি মাংশপেশির সঙ্কোচন-সম্প্রসারণকে সহজতর করে, যা মস্তিষ্কের ওপর বাড়তি চাপকে শিথিল করে। সুতরাং নিজেকে নিজেতে ফেরাতে এই গরম পানির থেরাপি খুবই কার্যকরী পরীক্ষিত পদ্ধতি।

প্রতিটি ঘটনার সাথে সাথেই ফ্ল্যাশ ব্যাক হয় অনেক নিন্দা-মন্দের ডালিভরা জীবনের উপাখ্যান। ফেলে আসা দিনের নানা ঘটনার আলোকচিত্র ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। যে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার কথা ছিল তার বহু আগেই, ছাড় দিয়ে, নিজেকে ছোটো করে, মেনে নিয়েও তার ফলাফল শূন্যই রয়ে গেল। 

জীবনের এতোটা বছর পেরিয়ে এসেও তুহিনের কাছে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হলো না। মানুষ হিসেবে আলাদা সত্ত্বা, নিরুর শিক্ষা-রুচি, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুস্থতা-অসুস্থতার কোনো গুরুত্বই নেই তুহিনের কাছে। 

তুহিনের কাছে স্ত্রী মানে গৃহলক্ষ্মী! ঘরদোর গুছিয়ে ঝাটপাট দিয়ে পরিপাটি করে রাখবে, রান্নাবান্না করে রাখবে, সন্তান সামলাবে, ব্যাস। এখানে আলাদা স্বত্তা,ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, সম্মান, শ্রদ্ধা- এসব কথা আসবে কেনো? স্ত্রীর সাথে এসব হিসেব আসবে কেনো? নিরু যেনো দম দেওয়া কলের পুতুল, হেসেখেলে কলকল করেই সব কাজ সুনিপুণভাবে করে যাবে। দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-হতাশা ভাগ করে নেবার দরকার নেই। 

কথায় কথায় ‘অত ইমোশোনাল হলে জীবন চলে?’ বলে ধমক ধামক দেওয়া ছিল তুহিনের প্রধানতম অস্ত্র। প্রচুর রিহার্সেলের পরে যথেষ্ট দক্ষতার সাথে নিরু যেনো এক মঞ্চ নাটকের স্ক্রিপ্টে নির্ধারিত চরিত্রের ডায়গল বলে যাচ্ছে তুহিনের নির্দেশিত মঞ্চে। সেখানে ভুল করার অবকাশ নেই। মাঝপথে কাট বলতে হলেই সব ভেঙে খান খান। কী অদ্ভুত এই জীবন! কী ভয়ঙ্কর এই বেঁচে থাকা!

নিজে পছন্দ করে যে জীবন বেছে নিয়েছিলো একদিন, সেই জীবনই তাঁকে আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করেছিল, একসময় নিরুর আত্মহত্যার ইচ্ছে হতো খুব বেশি। দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্নের ঘোরে কেঁদে উঠতো, বুকে ভীষণ ব্যথা হত, ইচ্ছে করতো কারো শীতল স্পর্শ, বুকের ওম নিয়ে বাকীটা রাত পার করতে। ইচ্ছে করতো কেউ শক্ত করে বুকের সাথে লেপ্টে ধরে বলুক ‘আমি আছি’ ভয় কী নিরু, সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু না, দীর্ঘ জীবনে দুঃস্বপ্নেও তেমনটি ঘটেনি। উপরন্তু, অতীত ফিরে এসেই হানা দিয়েছে বার বার, তুহিনের অবহেলা-অবজ্ঞা নিরুর বিবর্ণ অতীতকে কফিন থেকে জীবন্ত করে তুলেছে বার বার। আর নিরুকে করেছে দগ্ধিভূত। তুহিনের নিজের প্রয়োজন ছাড়া নিঃসঙ্গ শয্যাই ছিল নিরুর রাতের সঙ্গী।

বাইরে থেকে দেখে কারও অসুখী দম্পতি মনে করার জো নেই ওদের। উপরন্তু তুহিনের গোবেচারা টাইপ ভালোমানুষী চেহারার কাছে নিরুই একরোখা, বদরাগী! বেশি কিছু না জেনেও প্রথম দর্শনে যে কেউই তুহিনকে অতি ভালো মানুষ ভেবে নেবে। এদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হলে- তা নেহায়েতই নিরুর দোষ! এমনই ধারণা করবে শতকরা নব্বই ভাগ। 

দোষটা আসলে নিরুরই। ছাত্রজীবনে ভালোবেসেছিল এক ভণ্ড মুখোশধারী ছাত্রনেতাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির মাঠ সরগরম রাখা তুখোড় ছাত্রনেতা; যার মুখে সমাজ সংস্কারের বিপ্লবী বাণী! দু’চোখে স্বপ্ন আর বুকে বিশ্বাস নিয়ে একজন চে’র আদর্শে দেশ-জাতি গঠনের ভূমিকায় অতন্দ্র প্রহরী। ভবিষ্যত জাতিগঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকায় ছাত্রদের নিজেদেরকে তৈরি করাই যার মূখ্য কর্মসূচী ছিল। যিনি জাত-ধর্মের, শ্রেণি-পেশার ঊর্ধ্বে গিয়ে কেবল মানুষের মর্যদায়ই মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। নারীকে নারী নয়, মানুষ হিসেবেই গুরুত্ব দিতেন, তেমন মানুষের প্রেমে পড়াও নিরুরই অপরাধ ছিল। 

সেই টগবগে, দূরন্ত যৌবনে নিরুর এ ভিন্ন অন্য গত্যন্তর ছিল না। নিরু কোনো আবেগের বশে নয়, জেনে বুঝেই রেহানের প্রেমে পড়েছিল। দীর্ঘ দশ বছর পরে রেহান নিরুকে সমুদ্রের অথৈ অতলে ফেলে দিয়ে চলে গেল। পেছনে পড়ে রইল নিরুর ভালোবাসা, পতিত জমিন হয়ে। নিরুর নিস্ফলা, অনুর্বর মস্তিষ্ক তখন কেবল নিজেকেই দোষারোপ করে, কী অপরাধ ছিল আমার? কোনো সদুত্তর সে খুঁজে পায়নি আজও।

সময়ের ঘড়িতে কত পথ বদলে যায়, নিরুরও বদলানো পথে দেখা হয়েছিল তুহিনের সাথে। তুহিনকে তাঁর সাধাসিধে ভদ্দরলোকই মনে হয়েছিল। রেহান চলে যাওয়ার পরে নিরুর জীবন থেকে কেবল ভালোবাসার মানুষটিই চলে যায়নি, নিরু হারিয়েছিল আস্থা-বিশ্বাস- মানুষের প্রতি, পুরুষের প্রতি।

দুই পরিবারের সকলের অমতের পরেও অবশেষে সামাজিকভাবেই বিয়েটা হয়েছিল নিরু-তুহিনের। বিয়ের পরপর নিজেদের প্রেম-উপাখ্যানকে আরও নিবিড় করে সাজানোর চেয়ে দুই পরিবারের আশা-আকাঙ্খার লড়াইয়ে অংশ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে কতবার যে বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিরু তার ইয়ত্তা নেই। ভালোবেসে তুহিনকে বিয়ে করার সময়ে নিরুর আক্ষরিক অর্থেই তুহিনের কাছে চাওয়া ছিল শুধুই ‘ভালোবাসা’! অর্থ-বিত্ত, সামাজিক-পেশাগত অবস্থান, মর্যদা -এর কিচ্ছুই চায়নি নিরু। আধুনিক মননে গড়া নিরুর মন কেবল ভালোবাসাহীন খাঁ খাঁ বিরান ভূমি; যা চায় একটু শীতল পরশ, একটু বৃষ্টি পেলেই পেলব জমিতে ফলবে ভালোবাসার সোনার ফসল।

সমাজের প্রচলিত নিয়মে মেয়ের চেয়ে উচ্চ ডিগ্রিধারী, বড় চাকুরে কিংবা ব্যবসায়ী কাউকেই মেয়ের পরিবার উপযুক্ত পাত্র হিসেবে পছন্দ করে, সেটাই স্বাভাবিক। অপরপক্ষে- ছেলের জন্য শিক্ষিতা-চাকরিজীবী মেয়ে এই বাজারে কাম্য হলেও যে সাপ ফোঁস ফাঁস করে না, ঢুশ ঢাশ মারে না তেমন বিষদাঁত বিহীন হলেই কন্যা সুপাত্রী! ছেলের চেয়ে পাত্রীর ডিগ্রি, রোজগার বেশি হলেই পরিবার বেঁকে বসবে, ভাতের চেয়ে ডাল উঁচু হয় কি কখনও? তাহলে তো সেই সাপের বিষদাঁত ভাঙা একটু কঠিনই হয়ে দাঁড়ায়! এখানেই ছিল দুই পরিবারের একাট্টা এবং জোরালো দ্বিমত।

বিয়ের দিন রাতে তুহিনের বত্রিশ নম্বর অব্দি প্রত্যাশিত ‘ডাজ অ্যান্ড ডোন্টস’ তালিকার প্রেক্ষিতে নিরু শুধু বলেছিল, “তুমি শুধু আমার পাশে থেকো, আমাকে সহযোগিতা করো, আমি খুব একা, আমার একজন বন্ধু চাই।” নিরুর এই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি এই জীবনে। এই জীবনে কোনো বিষয়েই তুহিনকে পাশে পায়নি। গভীর মনোযন্ত্রণায় মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে চিকিৎসক নিরুর স্বামীর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন, নিরু এসে অনুরোধ করলে সেই অনুরোধও ঘৃণাভরে উপেক্ষা করেছিল তুহিন। নিরু ‘পাগল’! সুতরাং পাগলের প্রলাপে তুহিনের কোনো ভূমিকা নেই। নিরু নানাবিধ নাটক করে চিকিৎসককে দিয়ে তুহিনকে অপমান করাতে পারে বলেই ধারনা ছিল তুহিনের, বিধায় সে কোনোদিন দেখা করতে যায়নি।

দীর্ঘ আঠারো বছরে তুহিনের দেশে-বিদেশে শিক্ষা, চাকরি, পদোন্নতি, চিকিৎসা, জীবনের সকল ক্ষেত্রে আরও একটু স্বাচ্ছন্দ্যে কীভাবে থাকা যায়, একসাথে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়- সেই ভাবনায় নিরুর উৎসাহের কমতি ছিল না, আজও নেই। অথচ তুহিন কখনও পরিবার নিয়ে যুদ্ধ, কখনও গৃহ কর্ম নিয়ে, নিজের ইগোকে প্রতিষ্ঠিত করতে, কিংবা স্বামীত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে নিরুকে অবহেলা, অবজ্ঞা, অপমানই করে গেছে কেবল।

ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের হিসেবে আঠারো বছর কম লম্বা নয়। এই এতোটা কণ্টকময় পথ একাই হেঁটেছে নিরু। কত কত রাতজাগা বেদনা, চোখের জল, আর বুকের ব্যথারা তার সাক্ষী সেসব জমা আছে বুকের ভেতর ছোট্ট গহ্বরে। সন্তান জন্মের পরে সে বেদনা আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে গেছে নিরুর জীবনের সাথে। সন্তানকে পেয়ে তুহিন ব্যস্ত হয়ে গেলেও নিরুর প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা দিনে দিনে বেড়েছে বৈ কমেনি এক তিলও। 

অপরদিকে সন্তানকে বুকে নিয়ে নিরু যে যাতনার উপশম করবে সৃষ্টিকর্তা সেই সুখও কেঁড়ে নিলেন নিজের হাতে। উপরওয়ালা নিরুকে এক কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ করতেই হয়তো এক বিশেষ শিশুর মা হওয়ার সৌভাগ্য দিলেন।

জীবন এমনভাবে প্রহসন করে মানুষকে! পৃথিবীতে মানব শিশু সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে জন্ম নেয়; আর যে শিশুটি অটিজম নিয়ে জন্ম নেয়, ক্ষেত্র বিশেষে তার সারাজীবনই অন্যের সাহায্য নিয়ে বাঁচতে হয়। সেই অবোধ শিশুকে ছেড়ে নিরুর আর নিজের কথা ভাবা হয়ে ওঠে না। দীর্ঘ জীবনে ভালোবাসাহীন, শারীরিক সম্পর্কবিহীন, সম্মানহীন একটা নামকা ওয়াস্তে সম্পর্ক গলার কাঁটা করে ঝুলিয়ে বেড়ায় নিরু। সন্তানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে, একটা সুস্থ-সুন্দর পৃথিবীর সন্ধান দিতে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে, তার কোনো বিকল্প নেই। ঘুরে দাঁড়াতেই হবে নিরুকে। এই ভেবে সে এগিয়ে নেয় নিজেকে, হাসি দিয়ে ঢেকে দেয় তাঁর জাগতিক সকল বেদনা।

নিরুর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যই এমন; অনেক ঝড়-ঝাপ্টা সামলাতে সিদ্ধহস্ত সে, হঠাৎই অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে নিজেই নিজেকে এক ঝটকায় উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারে। এ বোধ হয় প্রতিটি জীবেরই এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, আত্মমর্যদার লড়াইয়ে নিজেকে টেনে তুলতে চায় প্রাণপণে। জীবনের এই দীর্ঘ পথে নিজের সন্তানকে নিয়ে নিরুর এই লড়াইটা একান্তই নিজের সাথে। সামাজিক প্রথা, পরিবার, কিংবা দশজনের পাঁচ কথায় কান দেওয়ার মতো মেয়েই নয় নিরু। নইলে সে তুহিনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না মাত্র সাতদিনের মাথায়।

বিয়ে ভেঙে গেলে একজন চাকরিজীবী মেয়ে অতটা অসহায় হয় না। নিজের কব্জির জোর থাকলে, পায়ের তলায় মাটি থাকলে, ভরণ-পোষণের চিন্তা না থাকলে কীসের দায়ে এক অকৃতজ্ঞ পুরুষের নামের পদবীটি ঝুলিয়ে রাখা কাবিন নামা নামক লোকাচারের খাতায়? তবে কেনো সে তুহিনকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্তে আরও একটু কঠোর হতে পারলো না? কেনো তাঁকে আজও তুহিনের অগ্নিদৃষ্টি, শ্লেষপূর্ণ তির্যক মন্তব্য, অকথ্য শব্দ চয়নে নিন্দামন্দ কথন শুনে শুনে সুখী দম্পতির চরিত্রে অভিনয় করতে হচ্ছে? শুধুই কি কন্যার কথা ভেবে? না কি এর অন্তরালে আরও কিছু ছিল? যা নিরু নিজেই জানে না, কিংবা নিজের অবচেতন মনের চাতালে খুব যত্নে তুলে রেখেছে তা? নিরুর মতো লড়াকু মেয়ের কি এসব ঠুনকো দুর্বলতা মানায়? এসব প্রশ্নের জবাব নিরুই খুঁজে বেড়ায় নিজের ‘আমি’র কাছে।

গতকাল যখন তুহিন ঘরে ফিরে রান্না না করার অপরাধে নিরুকে গালমন্দ করল, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে- স্ত্রী হবার কোনো যোগ্যতাই তাঁর নেই, তখন বিস্ময়ে হতবিহবল হয়ে নিরু ভাবতে লাগল- এইই তাঁর স্বামী! যাকে ছেড়ে যেতে চেয়েও সে যেতে পারেনি! কী দায় ছিল নিরুর? তুহিনের অবজ্ঞা আর অবহেলায় দিনের পর দিন নিজেকে অসুস্থ মানসিক রোগীতে পরিণত করে কী পেয়েছে নিরু? 

দীর্ঘ আঠারো বছর শরীর নামক যন্ত্রের ক্ষুধাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে পুরুষ সঙ্গ বিহীন ‘বাঙালি হিন্দু বিধবার’ জীবন কাটিয়েছে সে। কীসের অভাব ছিল নিরুর? কার ভয়ে নিজেকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছিল সে? জীবনের এই অপরাহ্নে এসে এই হিসেব কষাও বালখিল্য, তবু ধিক্কার দেয় সে নিজেকে! এই ভয়াবহ করোনা আতঙ্কের মধ্যেও বাসে-ট্রেনে চেপে অফিস করছে শুধু সংসারের কথা ভেবেই, তবু তাঁর প্রাপ্য বদলায়নি।

নাটক-সিনেমা-উপন্যাসে আমরা সম্পর্কের অনেক জটিলতার কথা দেখি, শুনি, পড়ি। কখনও সখনও জীবনের সাথে মিলেও যায় অনেক গল্প; দর্শক সারিতে বসে আমরা তখন বলি-একদম বাস্তব! জীবন থেকে নেওয়া! কেউ কেউ কেঁদেও ফেলি! নিরুর গল্প শুনে অনেকের মনে হবে- এ আর এমন কী? এমন তো হয়ই! নিরুর জীবনও আর দশটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোন। বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের গায়ের রঙ কালো অথচ স্বাধীনচেতা, আত্মম্ভরি, বুদ্ধিদীপ্ত এক মেয়ের এই সমাজে খুব ভালো বউ হবার যোগ্যতা থাকার কথা নয়।

ভালোবাসায় মোড়ানো ফুলবিছানায় সজ্জিত না হোক, নিজের মতো একটা জীবন হতে পারতো নিরুর। ছাত্রী হিসেবে খুব মন্দ ছিল না, খেলাধুলা, আবৃত্তি আর লেখালিখিতেও সিদ্ধতার পরিচয় দিয়েছিল সেই শৈশবেই। আর দশজন সাধারণ মানুষের থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা, দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ সামাজিক নানবিধ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহও চোখে পড়ার মতো। তবে, এর কোনোটিই সংসারী মেয়ে হবার সনদপত্র দেয়নি তাঁকে। অনেকের চোখে বুদ্ধিমতী, উচ্চ শিক্ষিতা নিরু গৃহ কর্মে যেন অকর্মার ঢেঁকি!

চুন থেকে পান খসলেই গৃহকর্মে অমনোযোগিতা, অসংসারী, অগোছালো, অকর্মণ্য অপবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে নিরুর প্রতিদিনকার জীবনে। আঠারো বছরের জীবনে নিজের টাকায় নিতান্ত দরকার ছাড়া শাড়িই কেনেনি সে। গয়নাও কেনেনি কোনোদিন, দশ টাকার পথ রিক্সায় না চড়ে হেঁটেই গিয়েছে। সকলে যখন গাড়ি চড়ে অফিস করে, নিরু তখন প্রতিদিন বাসে ঝুলেই অফিস করেছে। তুহিনের থেকে তিনগুণ বেশি রোজগার করেও নিজেকে বাড়তি জাঁকজমকে রাখার চিন্তাও করেনি কখনও। সংসারে বাড়তি দু’পয়সা সঞ্চয় করতে, কন্যার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে সকাল-সন্ধ্যা আজও পরিশ্রম করে নিরু।

‘সংসারী মেয়ে না’ বদনামের ট্যাগ পিঠে ঝুলিয়েও সারাদিন কর্মক্লান্তির পরে তুহিনের পছন্দের ডিশই রাঁধে, সেসব মুখে তুলে তুহিন ত্রুটি ছাড়া প্রশংসার উপাদান খুঁজে পায়নি। তবুও নিরু স্বপ্ন দেখে একদিন বদলাবে সব। পরিবারের সাথে যোজন যোজন যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তুহিনকে বিয়ে করার ফলে তা-ও একদিন ঘুচে যাবে। তাঁর প্রাণপ্রিয় বোন যে তাঁকে ভুল বুঝে দূরে সরে ছিল সেও একদিন ভুল ভেঙে কাছে আসবে।

চিত্রনাট্যে জীবনের না বলা বেদনার বক্তব্যগুলো ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো যায়, কিংবা তৃতীয় চরিত্রের উপস্থিতিতে ঘটনা পরম্পরার জটিলতাগুলোর অবসান হয়। যে জীবন নিজগুণেই নাটকের থেকেও নাটকীয় সেই জীবনের ভুল অঙ্কের জটিল হিসেব রাফ করে কেটে দিয়ে ফ্রেশ করার সুযোগ থাকে না। কোনো তৃতীয় চরিত্রের বয়ানে তুহিনের প্রতি নিরুর প্রচ্ছন্ন ভালোবাসার নিভৃত্য কোণটি পত্র-পল্লবে পরিণত হয়ে পুষ্প-মঞ্জরীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে না। ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন কেউই আর পাশে থাকে না। নিরুরা একাই হাঁটে অন্ধকারে...জীবনের অগণন দুর্লঙ্ঘ রাত্রিকে সাথী করে।

লেখক- শিক্ষা কর্মকর্তা, টরন্টো, কানাডা।

এনএস/