ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

`পুঁজিবাজারের অনিয়মে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে`

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:৩১ পিএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ শনিবার

যতই শক্তিশালী হোক, শেয়ারবাজারে কারসাজি করে আর পার পাওয়া যাবে না। এখান থেকে টাকা নিয়ে পালানোর দিন শেষ। এক্ষেত্রে যারা আগে, বিভিন্নভাবে অনিয়মে যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে, ব্যবস্থা নেয়া হবে। শেয়ারবাজার বিষয়ক এক ভার্চুয়াল সেমিনারে শনিবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এসব কথা বলেন।  

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিএমবিএ) এবং ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিষ্টস ফোরামের (সিএমজেএফ) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম, ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট শরীফ আনোয়ার হোসেইন, এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ এসেসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হাসান ইমাম। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, বিএমবিএ সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান এবং সিএমজেএফ সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমবিএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন, সিএমজেএফের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন। 

অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের ব্যবসা সহজ করার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার বিএসইসির পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে, সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার থেকে অনিয়ম এবং বিভিন্ন কারসাজি দুর করতে ডিএসইর তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগে সংস্কার জরুরি। ডিএসইর ওয়েবসাইট নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো তার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে। শিগগিরই তারাআমাদের কাছে এই রিপোর্ট জমা দেবেন। রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিতে বলবো। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিএসইসি। এককভাবে ২ শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার নেই এমন কোম্পানির ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। অনেক বোর্ড ভেঙেও দেয়া হতে পারে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালকদের কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যবেক্ষন করা হবে। এছাড়া সম্প্রতি ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাজারকে আরও বড় করতে হবে, যাতে তিন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দৈনিক লেনদেন হয়।

বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারে শতভাগ সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে, মানুষ এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকি নেবে না। পুঁজির নিরাপত্তা দিতে না পারলে, তারা কষ্টার্জিত অর্থ শেয়ারবাজারে নিয়ে আসবে, প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ কারণে সবার আগে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। তিনি আরও বলেন, মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর কিছু কোম্পানি ঠিক মতো কাজ করছে না। হঠাৎ কোম্পানি করে বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করেছেন, সেসব কোম্পানিতে সম্ভবত আমাদের বোর্ডও ভেঙ্গে দিতে হতে পারে। সেখানে আমরা স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করবো। আইনের মধ্যে থেকেই এগুলো করা হবে। না হলে শেয়ার বাইব্যাক (পুণ:ক্রয়) করে নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, শেয়ারবাজারে বৈচিত্র আনতে হবে। শুধু সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকলে হবে না। এই বাজারটাকে অনেক বড় করতে হবে। তারমতে, বর্তমানে প্রতিদিন ১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই লেনদেনকে দ্রুত ৩ থেকে ৫ হাজার কোটিতে নেয়ার জন্য কাজ করতে হবে। এজন্য সারাদেশে ব্রোকারেজ হাউজের শাখা ছড়িয়ে দিতে হবে। এমনকি দেশের বাইরেও ডিজিটাল আউটলেট করার ব্যাপারে চিন্তা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ইক্যুইটিভিত্তিক শেয়ারবাজার থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি। গত সাড়ে ৩ মাসে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সাব-অর্ডিনেটে এবং পার্পিচুয়াল বন্ড এবং ৮৫০ কোটি টাকার জিরো কূপন বন্ডের অনুমোদন দিয়েছি। এতে বাজারের সব কিছু বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরও বলেন, কিছু দুষ্ট লোক নিয়মনীতি না মেনে অপকর্মে লিপ্ত হলে, ওই ধরনের ২-৫ শতাংশের জন্য সাধারন বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেবো না। সেই সুযোগ ইনশাআল্লাহ আর হবে না। এ নিয়ে আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে পারি। এ ব্যাপারে আপনাদেরকেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। যাতে কাউকে ক্ষতি করে বা চালাকি করে টাকা পয়সা নিয়ে যেতে না পারে। স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়ে আগামীতে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে জানান তিনি। আইনে কাভার করলে কিছু স্বতন্ত্র পরিচালককে সরিয়ে দিতে হতে পারে। তাদের জায়গায় সঠিক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হবে। এই স্বতন্ত্র পরিচালকদেরকে যে উদ্দেশ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটা এখনো পূরন হয়নি। আমরা এই সপ্তাহে স্বতন্ত্র পরিচালকদের অনলাইনে আবেদন নেয়া শুরু করব। যারা যোগ্য হবেন, তাদেরকে নেয়া হবে।

সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির যে কাজ, সেটা তারা সঠিকভাবে করতে পারছে না। এ কারণে সরকারের নির্দেশে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের পর আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে আইসিবি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে। তখন সরকার থেকে আইসিবিকে আরও তহবিল দেয়া হবে। তার মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখতে আইসিবির যে ভুমিকা, সেটা রাখতে পারবে।

ডিএসইর চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নে বিশে^র রোল মডেল অথচ পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতে উল্টো চিত্র। আর্থিকখাতে যেটুকু উন্নতি করেছে তাও প্রান্তিক জনগনের দ্বারা হয়েছে। এখানে শিক্ষিত জনগোষ্ঠির কোনো অবদান নেই বললেই চলে। নতুন কমিশন আসার পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে এতে দীর্ঘ মেয়াদে তেমন আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই। আর মেয়াদে উন্নতি করতে হলে সুশাসন জরুরি। টেকসই পুঁজিবাজার করতে হলে এখানে স্বচ্ছতা দরকার। তাই বিএসইসি, ডিএসই, সিএসইসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করার প্রস্তাব করেন তিনি। যে কমিটি বাজার সংশ্লিষ্ট নতুন সিদ্ধান্ত বা নীতিমালা তৈরি করাসহ নানাভাবে ভুমিকা রাখবে। আসিফ ইব্রাহীম বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার পেশাদারদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় না। এটি গুজবভিত্তিক মার্কেট। 

ড. হাসান ইমাম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাংকিং খাতের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। তাই শক্তিশালী পুঁজিবাজার গঠনের বিকল্প নেই। তাছাড়া বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কম। ৯০ শতাংশ বিনিয়োগই ব্যক্তি পর্যায়ের। এজন্য এখানে বাজার পতনমূখী হলে ১০ বছর লেগে যায়, ঘুরে দাঁড়াতে। অথচ উন্নত বিশে^ ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে বাজার ঘুরে দাাঁড়ায়।

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে গত ১০ বছরে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা বার বার প্রতারিত হয়েছেন। বাজারে টাকার কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু আস্থার সঙ্কট ছিল। গত ১০ বছরে যে কোম্পানিগুলোর আইপিও এসেছে সেগুলো অত্যন্ত মানহীন। এসব আইপিওর ক্ষেত্রে যেসব ইস্যু ম্যানেজার, আন্ডার রাইটার, অডিটর যারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তাদের পুঁজিবাজার থেকে অন্তত তিন বছর দূরে রাখতে হবে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানির শেয়ার এবং অপ্রদর্শিত অর্থ বাজারে আনার বিষয়ে জোর দেন। 
সিএমজেএফের সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল বলেন, গণমাধ্যমে হল, সুপার রেগুলেটর। তথ্য গন্ত্রণায়তন জন্য কাজ করে গণমাধ্যম। তারমতে, সঠিক তথ্য প্রচার হলে বাজারে গুজব নির্ভরতা কমে আসে। এ কারণে গণমাধ্যমের তাদের জন্য অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, আমাদের প্রত্যাশা আগামী দিনে শেয়ারবাজার ভালো অবস্থানে যাবে। তার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমরা যদি থাইল্যান্ড, ভারত ও সিঙ্গাপুরের কথা চিন্তা করি, সেই তুলনায় আমাদের মার্কেট মূল্য-আয় অনুপাত (পিই) অনেক কম। সেই তুলনায় আমাদের মার্কেট অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নতুন কমিশনের নেতৃত্ব আমাদেরকে সেই জায়গায় আশান্বিত করেছে। 

বিএমবিএ সভাপতি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাজারে নেতিবাচক অবস্থা দেখে আমাদের যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে আমরা কিছুটা আলোর আশা দেখতে শুরু করেছি। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও নতুন কমিশনের সঠিক নেতৃত্ব আমাদেরকে আলোর মুখ দেখাচ্ছে। এছাড়া এরই মধ্যে বাজারে নতুন গতি দেখছি। বাজারের গতি বাড়াতে বিএসইসি চেয়ারম্যানের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব রাখেন তিনি। এরমধ্যে বাজারে প্রবাসীদের অংশগ্রহন বাড়ানোর জন্য বিএসইসির উদ্যোগ নিতে পারেন বলে জানান। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রবাসিরা যেভাবে বিনিয়োগ করে, সেটা আসলে জটিল প্রক্রিয়া। শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারীরা ফরেন কারেন্সি ডিল করতে পারলে প্রবাসিদের জন্য বিনিয়োগ সহজলভ্য হবে।

তিনি বলেন, ভালো শেয়ারের সরবরাহ নিয়ে অনেক সময় আলোচনা করা হয়। এখানে কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এর কারন বিবেচনা করা দরকার। আগে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ব্যবধান ১০ শতাংশ ছিল। তবে সেটা কমিয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আমাদেরকে কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে চাইলে ট্যাক্সসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। না হলে ওইসব প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে পাবো না। সেক্ষেত্রে আমরা শেয়ারবাজারকে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় পাবো না। ছায়েদুর রহমান বলেন, আর্থিক হিসাব নিয়ে অনেক সময় সমালোচনা শুনা যায়। অনেক কোম্পানির আর্থিক হিসাব বিশ্বাস করা যায় না। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে সব কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টের জন্য একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেজ তৈরী করা দরকার। 

ডিএসই পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, নতুন কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে। সামনেও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যে সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলাম, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলো বুঝতে পেরেছেন। তার সেই রেজাল্ট আমরা পাচ্ছি। তিনি বলেন, অনেক দাবি করা যেতে পারে, কিন্তু যার হাতে মূল ক্ষমতা, যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই বিএসইসির চেয়ারম্যানকে সমস্যাগুলো বুঝতে হবে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ডিএসইর সদস্য আহমেদ রশীদ লালী এবং বিএমবিএর সাধারণ সম্পাদক মো. রিয়াদ মতিন প্রমুখ।

আরকে//