ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রথম স্কুল পরীক্ষা আর আমার দুরন্তপনা

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ০৩:৩৩ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:৫৬ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

বড় বোনের বয়স ৬ বছর তাই স্কুলে যাবার বয়স হয়েছে কিন্তু সাড়ে ৪ বছরের আমি কেন স্কুলে যাব? যেতেই হবে কারণ বোন একা এতদূর (১মাইল) হেটে যেতে পারবে না, রাস্তা পার হতে পারবে না তাছাড়া আমার স্কুলের অভ্যাস এর দরকার (?) আছে। তাই সাব্যস্ত করা হলো দুই বোন একসাথে স্কুলে যাব। সেই মোতাবেক দুবোনকে নিয়ে আব্বা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বড় আপু ক্লাস ওয়ান আর আমি শিশু শ্রেণিতে। সে সময় প্লে, নার্সারি, কেজি এসব ছিল না। শিশু বা বেবি শ্রেণি তারপর ওয়ান। আমি মাত্র ছড়ায় ছড়ায় আদর্শলিপি মুখস্থ করছি। ‘পাখি সব করে রব’, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’। আবার আ কার, ই কার, ঈ কার। অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর, আলস্য দোষের আকর। অনেক পরে বুঝেছি আকর এর অর্থ!

প্রথম দিন আব্বা ইচ্ছে করেই আমাদেরকে হাটিয়ে স্কুলে নিয়ে গেলেন যাতে আমরা রাস্তাটা চিনে পরদিন থেকে নিজে নিজে যেতে পারি। যাবার পথে কিছু দোকান ও বাড়ি চিহ্ন হিসেবে মনে রাখতে বললেন। আমরাও সেভাবেই কাজ করেছি। প্রথমেই ডানে রোজীদের বাসা, বায়ে কুদ্দুস দারোগার বাসা, ডানে লিলি আপাদের বাসার ভিতর দিয়ে, ম্যাজিস্ট্রেট এর কোয়ার্টার, মিউনিসিপালিটির পুকুর, ফায়ারবিগ্রেড,পশু হাসপাতাল, চৌমুহনা বাসস্ট্যান্ড হয়ে বামে হাফিজা খাতুন স্কুলের পরেই আমাদের স্কুল ‘মৌলভীবাজার প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয়’। সময়টা ছিল ১৯৭৪ সনের মাঝামাঝি।

স্কুলটা ছিল খ্রিস্টান মিশনারী স্কুল যার প্রধান ছিলেন খ্রিস্টান একজন ভদ্রমহিলা। কোনদেশি ছিলেন সেটা মনে নেই। ন্যানদের মতো পোশাক পরতেন। (নীল সাদা, মাথায় মাদার তেরেসার মতো কাভার) ভাঙা বাংলায় কথা বলতেন। প্রথম দিন স্কুলে ইউনিসেফ এর আকাশি রং এর প্লেইন ও রোল টানা খাতা সাথে লাল পেন্সিল দিলেন একজোড়া। প্রধান শিক্ষিককে সবাই মাসীমা বলতাম। প্রতি রোববার উনি আমাদের বাসার পাশের গীর্জায় প্রার্থনা করতে যেতেন। মাসীমার রুমে সে সময় বড় শার্পনার দেখেছি যেটা টেবিলের কিনারাতে ফিক্সড করা ছিল। কারও পেন্সিল শার্প করতে হলে চৌকিদার এখান থেকে শার্প করে নিয়ে যেত।

আমি প্রথম দিন থেকেই আপুর সাথে বসতে চাইতাম। ক্লাস ওয়ান এর কিছুই পারি না তবুও! কান্নাকাটি করার এক পর্যায়ে ঠিক করা হলো যেদিন শিশু ক্লাসে সব পারবো তার পরদিনই আমি ওয়ান এ বসবো। সেভাবেই চলতে থাকলো মাসখানেক। আমরা দুবোন একসাথে সকালে স্কুলে যাই হেটে হেটে। পথে জায়গায় জায়গায় থেমে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেখতাম। বিশেষ করে ফায়ার ব্রিগেড এর লাল গাড়ির মোটা পাইপগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া আর পশু হাসপাতালের গরুর (কি সব এডাল্ট) অপারেশন সব বলতে পারতাম!

কোনো কোনো সময় এসব পুরো দেখতে গিয়ে স্কুলের দেরী হয়ে যেত। একবার তো পশুর অপারেশন দেখার জন্য এক দৌঁড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে রিক্সার নীচে ডান পা টা পড়ে গেল! সে যে কি অবস্থা! অনেক ব্যাথা পেয়েছিলাম। এখনো ডান পায়ের পাতায় তিনটা দাগে সেই দুঃখের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছি। দুই সপ্তাহ স্কুলে যেতে পারিনি। মাঝে মাঝে হযরত শাহ মোস্তফা (সঃ) এর মাজারেও যেতাম ছুটির পরে। স্কুলের পাশের বড় জোড়া পুকুরে সাতার, ডুব প্রতিযোগিতা দেখতে যেতাম। খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতাম একজন মানুষ কিভাবে ২৪/৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকে, খায় না ঘুমিয়ে! 
 
টিফিন এর জন্য আম্মা চারআনা দিতেন। তখন কমলার হালি ছিলো ২০পাই। আমরা ১০পাই দিয়ে দুটো কমলা কিনে খেতে খেতে স্কুলে যেতাম। বাকী ১৫ পাই এর ১০ পাই দিয়ে আইসক্রিম কিনে বাকি ৫ পাই (যেহেতু দুই ভাগ করা যাবে না) এর কোনো কাজ নেই তাই ছুড়ে ফেলে দিতাম। কতদিন অন্যমানুষ ওই পাচপাই কুড়িয়ে এনে আমাদেরকে দিয়েছে কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবারও আমরা ফেলে দিতাম! দুই বোন সমান সমান ভাগ নিতাম যে!

আমাদের পাশের হাফিজা খাতুন স্কুলে বড় জামগাছ ছিলো। টসটসে কালো জামের থোকাগুলো যেন আমাকে হাত ইশারায় ডাকতো! আমি যেহেতু গেছো মেয়ে ছিলাম তাই উঠে সবাইকে পেড়ে দিতাম। কত যে জামা নষ্ট করেছি এই জামের রসে! একবার তো গাছের নরম ডাল ভেঙে পড়ে গিয়েছিলাম। বা হাত ভেঙেছিল। ব্যাথার চেয়ে লজ্জাটা বেশি কাঁদিয়েছিল।


 
প্রতি রোববার মাসীমার জন্য গীর্জার বাইরে ফুল নিয়ে অপেক্ষা করতাম যত ঝড় বা শীত ই থাকুক না কেন! এমনও হয়েছে যে আমি অনেক জ্বর নিয়েও উনার জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষা করতাম। বাচ্চাদের খুব মায়া করতেন। নিজে সংসারী ছিলেন না। সব বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন। সবাই কে চকোলেট দিতেন। 

এবার ফাইনাল পরীক্ষার পালা। আমাকে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ওয়ান এ উঠতে হবে। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা ছিলো ‘চট্রগ্রাম’। যে শিশুর শিক্ষার দৌঁড় শুধুমাত্র মুখে কিছু ছড়া কবিতা ১,২,৩ আর 1,2,3 বড়জোড় অ,আ,ই,ঈ, আর ইংরেজি A,B,C,D তার সাধ্য কী এই শব্দ লেখার? আমি তো আর এসব বানান পারি না তাই পরীক্ষার খাতা পেন্সিল নিয়ে আপুকে না বলেই সোজা বাসায় চলে এসেছি। আম্মা তো আমাকে দেখেই ‘ঈভা কোথায়? তুই ওকে কোথায় ফেলে এসেছিস?’ ইত্যাদি নানান প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করে চলেছেন। 

আমার নির্বাক জবাব ‘আপু পরীক্ষা দিচ্ছে, আমি কিচ্ছু পারি না তাই মাসীমা খাতা, পেন্সিল নিয়ে চলে যেতে বলেছ ‘। (মিথ্যা কথা, উনি আসলে কিছুই জানেন না)। সাথে সাথেই আম্মা আব্বাকে ফোন দিয়ে (বাসার ফোন থেকে ১৮ এ কল করলেই আব্বার কাছে চলে যেতো) আমার চৌদ্দ গুষ্টি শ্রাদ্ধ করলেন! আমি নির্বিকারভাবে নিজের খেলা নিয়েই ব্যাস্ত। ভাবখানা এমন যে আমাকে জোর করে স্কুলে পাঠিয়েছো? এবার বুঝো তোমাদের আদরের বড় মেয়ে কিভাবে বাসায় আসবে? (আপু প্রথম সন্তান তাই সবার আদর পেত আর আমি মেঝ মেয়ে তাই কম আদর পেতাম সেই ক্ষোভ তো ছিলই, তার উপর আবার আপু আমার রাস্তা পার হতে পারতো না) পরে আব্বা তার পিয়নকে পাঠিয়ে আপুকে আনিয়েছিলেন। এই কথা ছোট্ট শহরের সবাই জেনে গিয়েছিল যেটা ছিলো আমার জন্য খুব লজ্জার ব্যাপার। যেখানেই যেতাম সবাই বলতো ‘ও বা তুমি খিতা ম্যানেজার সাবের ঔ ফুরি নি বা যিগু ইস্কুলর থাকি খাতা পেন্সিল লইয়া আইছলায়’?

আমার ওই শিশুবেলার দুই বন্ধু রেদোয়ান আর রিপা যাদের কথা মনে পড়ে কিন্তু কোথায় আছে জানি না। কেউ যদি ওদের দেখা পাও তবে বলো আমি আমার প্রথম স্কুলের প্রথম বন্ধুদের আজও ভুলিনি!

লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

এমবি//