ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে…

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

প্রকাশিত : ১১:৩৮ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:৫১ এএম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ শনিবার

১.

একজন রাজনৈতিক নেতা, কর্মী বা বিশ্লেষক অথবা অর্থনীতিবিদ বা ইতিহাসবিদ হয়তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টুকু সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। আমি সে-রকম কেউ নই, আমি বড়জোর নিজেকে ইতিহাসের একজন সাক্ষী হিসেবে দাবি করতে পারি। বাংলাদেশের জন্ম হতে দেখেছি, বাংলাদেশকে ধ্বংসের শেষপ্রান্তে পৌঁছাতে দেখেছি আবার সেখান থেকে প্রবল আত্মসম্মান নিয়ে পুনর্জন্ম হতে দেখেছি। কোনো কিছু নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই, কারণ আমি এক চক্ষু হরিণের মতন। আমার সম্বল একটিমাত্র ফিল্টার, আমি যেটাকে বলি ‘মুক্তিযুদ্ধ ফিল্টার’। আমার চারপাশে যা কিছু ঘটে আমি তার সবকিছু সেই ফিল্টারের ভিতর দিয়ে পাঠাই। যদি কোনো কিছু ফিল্টারে আটকা পড়ে আমি সেটা ছুড়ে ফেলে দিই, যদি বের হয়ে আসে আমি সাগ্রহে সেটাকে গ্রহণ করি।

মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমাদের প্রজন্মের এই তীব্র আবেগ আসলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই সময়টি এতই অবিশ্বাস্য ছিল যে মনে হয় তার স্মৃতি আমাদের রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মাঝে রয়েছে অসাধারণ বীরত্ব, অবিশ্বাস্য অর্জন এবং সব থেকে বেশি স্বজন হারানোর বেদনার ইতিহাস। আমাদের বাংলাদেশের সেই জন্ম ইতিহাসটুকু এতই গৌরবের যে সেটি না জানলে একজনের জীবনটাই অপূর্ণ থেকে যায়।

একটি দেশ এবং একজন মানুষ সমার্থক হওয়ার উদাহরণ পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না আমার জানা নেই, কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় সেটি শতভাগ সত্যি, এই দেশটি বঙ্গবন্ধুর সাথে সমার্থক। তার জন্ম না হলে আমরা বাংলাদেশ পেতাম না। আমরা যদি তার রাজনৈতিক জীবনটি দেখি তাহলে দেখব তিনি তার পুরো জীবনটিই উৎসর্গ করেছেন বাঙালিদের একটি সুখী সমৃদ্ধ বাসভূমির জন্য। ১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য ৬-দফা ঘোষণা করলেন। ৬-দফার সেই সনদটি ছিল স্বাধিকারের মোড়কে ঢাকা স্বাধীনতার ডাক। দেশের মানুষ ৬-দফাকে লুফে নিল। অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানের শাসকেরা তাকে কারাগারে আটকে রাখা শুরু করেছে, এখন তাকে শুধু কারাগারে আটকে রাখা তাদের কাছে যথেষ্ট মনে হলো না, পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক এই মানুষটিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চাপিয়ে দেওয়া হলো। 

১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলন করে তাকে মুক্ত করে আনা হলো, ’৭০-এর নির্বাচনে তিনি অবিশ্বাস্য বিজয় দিয়ে পাকিস্তানের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিলেন। শুরু হলো ষড়যন্ত্র, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণপরিষদ স্থগিত করে দিল তখন পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়ে দেখল একজন মানুষ কেমন করে একটি দেশ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর একটি তর্জনী হেলনে পুরো দেশ থমকে দাঁড়াল। কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি ছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মুখের ভাষার কথা বলে মাত্র ১৯ মিনিটের একটি ভাষণে তিনি পুরো জাতিকে তাদের স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে দিলেন।

পরের ইতিহাসটুকু আমরা সবাই জানি। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে মধ্যরাত থেকে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যাটি শুরু হয়ে গেল, সেইসাথে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর বাংলাদেশের মাটিতে সোনালি বাংলাদেশ আঁকা লাল সবুজ পতাকাটি উড়তে শুরু করে। সেই পতাকার লাল সূর্য যে কত মানুষের বুকের রক্তে রঞ্জিত সেটা তখন পর্যন্ত জানে শুধু স্বজনহারা আপনজন। রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো মূল্য দিয়ে বুঝি আর কোনো দেশ এভাবে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেনি। 

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু তার দেশের মানুষের কাছে ফিরে এলেন জানুয়ারির ১০ তারিখে, সেই দিনটিতে মানুষের ভালোবাসার যে অনুপম স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, সে-রকম কিছু এভাবে পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু দেখলেন এখানে লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা মানুষ, পিতৃহারা পরিবার, সন্তানহারা মা, লাঞ্ছিতা নারী, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। মানুষের ঘর নেই, বাড়ি নেই, পরনে কাপড় নেই, মুখে খাবার নেই। রাস্তাঘাট নেই, সেতু নেই, যানবাহন নেই। স্কুল নেই, কলেজ নেই, লেখাপড়ার বই নেই, খাতা-কলম নেই। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, শুধু মানুষের বুকে বিশাল একটি প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করার জন্য বঙ্গবন্ধু বুক বেঁধে দেশ পুনর্গঠনে হাত দিলেন।

অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এক বছরের ভেতর বঙ্গবন্ধু দেশকে পৃথিবীর আধুনিকতম একটি মানবিক সংবিধান উপহার দিলেন। তিনি জানতেন দেশকে পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষার পুনর্গঠন, তাই তিনি দেশে ফিরে আসার সাত মাসের মাথায় শিক্ষা কমিশন তৈরি করে দিলেন। সমাজতন্ত্রের জন্য তার গভীর ভালোবাসা, সেটি বাস্তবায়নের জন্য দেশকে উপহার দিলেন প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিলেন। কৃষি উপকরণ সরবরাহ করার উদ্যোগ দিলেন, শিল্পের জাতীয়করণ করলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ গ্যাসফিল্ডগুলো মালিকানা ছিল বিদেশি কোম্পানির, ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখ সেগুলো কিনে নিল বাংলাদেশ সরকার। 

সপ্তাহ না ঘুরতেই আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ ভোরবেলা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম একটি হত্যাকা-ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। অবোধ শিশু থেকে শুরু করে নববিবাহিতা বধূ কিংবা অন্তঃসত্ত্বা নারীটিও রক্ষা পেল না। বঙ্গবন্ধু এবং তার আপনজনের রক্তে রঞ্জিত হলো এই দুর্ভাগা দেশের মাটি। বিদেশের মাটিতে থাকার জন্য তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে গেলেন, কিন্তু সেই বেঁচে থাকাটি যে মৃত্যু থেকেও কত বেশি কষ্টের সেটি পৃথিবীর আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না।

বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক, তাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আসলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করা বাংলাদেশকে হত্যা করা হলো। যে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক এবং আধুনিক একটা দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার কথা ছিল সেটি চোখের পলকে অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেল। যে পাকিস্তানকে পদানত করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কয়েক ঘণ্টার মাঝে সেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। যে চীন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে তার হত্যাযজ্ঞে সাহায্য করে এসেছে, সেই চীন এই ভিন্ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। 

মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এসেছে, সেই দেশগুলোও এক এক করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করল। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আরও একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য আটকে রাখা হয়েছিল, তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। পিলপিল করে তারা কারাগার থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে, রাতারাতি এই দেশটি যুদ্ধাপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুনর্বাসন করেই শেষ হলো না, তাদের যেন কখনো বিচার করা না যায় সেজন্য সংবিধানকেই পাল্টে দেওয়া হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো কী এ-রকম ঘটনা ঘটেছে, যেখানে হত্যাকারীদের এভাবে রক্ষা করা হয়? এক সময় তারা দেশে ফিরে এসে সদর্পে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এখানেই শেষ নয়, হত্যাকারীরা রীতিমতো রাজনৈতিক দল খুলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে বসতে লাগল।

আর বঙ্গবন্ধু? এই দেশে তার শেষ চিহ্নটিও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলো। রেডিও, টেলিভিশন, সকল গণমাধ্যমে আর পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম সরিয়ে দেওয়া হলো। এই দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হতে লাগল বঙ্গবন্ধুর কথা না জেনে, তার ৭ মার্চের সেই জগদ্বিখ্যাত ভাষণটি না শুনে। তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, দেশের জন্য ভালোবাসা নেই। বাংলাদেশের মাটিতে তারা পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা দেখে মুখে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে উদ্বাহু নৃত্য করে। মুক্তিযোদ্ধারা মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তাদের বুকভরা অভিমান। তাদের সন্দেহ হতে থাকে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ করে তারাই কি অন্যায় করে ফেলেছেন?

বঙ্গবন্ধুর হত্যার ছয় বছর পর, সেই ভয়াবহ দুঃসময়ে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলেন। বিদেশের মাটিতে শরণার্থীর মতো ঘুরে ঘুরে একাকী, নিঃসঙ্গ, দুঃখী, অনভিজ্ঞ, কম বয়সী শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরে এসেছিলেন তখন কি কেউ কল্পনা করেছিল, একদিন তিনিও ঠিক তার বাবার মতো দৃঢ়ভাবে দেশের হাল ধরবেন? একদিন এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করবেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন?

১৯৯৬ সালে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর শেখ হাসিনা প্রথমবার নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এলেন। আমার মনে আছে, আমি সেদিন আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘চল আমরা একটি টেলিভিশন কিনে আনি, এখন টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে দেখাবে।’ সত্যি সত্যি টেলিভিশন কিনে এনে বাসায় সেই টেলিভিশন অন করে বসে আছি। মনে আছে প্রথমবার বঙ্গবন্ধুকে দেখে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। শুধু যে বঙ্গবন্ধুকে টেলিভিশনে দেখানো হলো তা নয়, পাঠ্যবইগুলোতেও প্রথমবার সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হলো, বঙ্গবন্ধুর কথা বলা হলো। মনে আছে, সেই কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আমিও ধৈর্য ধরে পাঠ্যবইগুলোর সংস্কার করেছিলাম।

সবচেয়ে বড় কথা, এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে বঙ্গবন্ধুর যে হত্যাকারীরা ছিল, তাদের গ্রেফতার করা হলো। শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের সেই দুরূহ প্রক্রিয়া। কত ধৈর্য নিয়ে কত টালবাহানা সহ্য করে ২০১০ সালে সেই বিচারকাজ শেষ করা হয়েছিল, সেই কথাটি কি সবার মনে আছে?

পরবর্তী নির্বাচনের আগে এই দেশের জন্য আরেকটি দুর্ভাগ্যের সূচনা হলো, যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে জিতে আসার জন্য বিএনপি এবং জামাতে ইসলামী একত্র হয়ে গেল। যে জামাতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু যে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল তা নয়, পাকিস্তানের আজ্ঞাবহ পদলেহী হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, তারা বিএনপির ঘাড়ে চেপে সত্যি সত্যি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় চলে এলো। কী অবিশ্বাস্য কথা, কী ভয়ঙ্কর কথা! যারা এক সময় বদর বাহিনীর নেতা হয়ে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, তারা এই দেশের মন্ত্রী? তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে? এই দেশের জাতীয় পতাকার এর চাইতে বড় অপমান আর কী হতে পারে?

এই দেশের অনেক শিশু-কিশোর এতদিনে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস জেনে গেছে। তারা এখন অবাক হয়ে আমার কাছে জানতে চায়, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? যারা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, যারা বাংলাদেশকে চায়নি, তাদের গাড়িতে কেন জাতীয় পতাকা?’ আমি তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না, মাটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সরকারের সহযোগিতায় জামাতে ইসলামীর তখন প্রবল প্রতাপ। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিয়ন্ত্রণে, জামাতপন্থি না হলে আর শিক্ষক হওয়া যায় না। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যায় না, গান গাওয়া যায় না, নাটক করা যায় না। একদিন শুনতে পেলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল, তারা তাদের বকেয়া বেতনের জন্য আবেদন করেছে। এই আমাদের বাংলাদেশ?

শেখ হাসিনা তখন ক্ষমতায় নেই, বিরোধী দলের নেত্রী। যারা এই দেশকে আরেকটি পাকিস্তান তৈরি করতে চায়, তারা কিন্তু ঠিকই অনুমান করেছিল বেঁচে থাকলে তিনি হবেন সবচেয়ে বড় বাধা। তাই কতবার তার জীবনের ওপর কতভাবে হামলা হয়েছিল, সেটি মনে হয় হিসাব করেও বের করা যাবে না। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য এবারে ইনডেমনিটি আইন পাস না হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসএফ, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে শুরু করে একজন বিচারপতি এবং ধরে বেঁধে আনা একজন হতভাগ্য জজমিয়া কারও চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না।

ধীরে ধীরে দেশে একটা পরিবর্তন হলো। তার অনেক কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা নিয়ে টালবাহানা, উল্টো ১৫ আগস্ট বিছানার মতো বড় সাইজের কেক কেটে আনন্দোল্লাসে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন, হাওয়া ভবনের দৌরাত্ম্য, জামাতে ইসলামীর রাজত্ব, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের নিয়ে কটাক্ষ, তাদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ সব মিলিয়ে দেশের মানুষের ভেতর প্রবল বিতৃষ্ণার জন্ম নিতে শুরু করল, সবাই একটা পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। সেক্টর কমান্ডার ফোরাম দিয়ে শুরু করে, সাধারণ মানুষ, ছাত্র-জনতা, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সবাই ধীরে ধীরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে শুরু করল। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আইন বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবীরা মাথা নেড়ে আমাকে বোঝালেন যে এটি আসলে সম্ভব নয়। তারা পৃথিবীর নানা দেশের উদাহরণ দেন, রুয়ান্ডার কথা বলেন, কম্বোডিয়ার কথা বলেন, আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলেন, আইনি জটিলতাগুলো দেখান। আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন এটি শেখ হাসিনার একটি নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য। রাজনীতি করতে হলে এভাবে বলতে হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার এর বেশি কিছু নয়। আমার তখন শহিদ জননী জাহানারা ইমামের কথা মনে পড়ে। আমেরিকায় আমি জাহানারা ইমামের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি। তিনি যখন গাড়িতে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতেন, অনেক সময় আমি তার সাথে ছিলাম। 

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তার সেই অভূতপূর্ব আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে তিনি আমাকে বলতেন, শেখ হাসিনা ছিলেন তার ঢাল, সেই আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা তার দলের মানুষ দিয়ে তাকে রক্ষা করে গেছেন। তাই আমার একটি বিশ্বাস ছিল যে শেখ হাসিনার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারটি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি তার অন্তরের কথা। আমি তাই গভীর বিশ্বাসে অটল হয়ে রইলাম, এখন পর্যন্ত একবারও হয়নি যে তিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন নি, এবারেও শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন।

এর পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। দুই বছরের মিলিটারি এবং সিভিলিয়ানদের একটি সম্মিলিত হাইব্রিড সরকারের যন্ত্রণা শেষে নির্বাচন হলো। শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এলেন। তিনি তার কথা রাখলেন, সত্যি সত্যি এই দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলো। তরুণদের ভেতর জাদুমন্ত্রের মতো কোথা থেকে জানি মুক্তিযুদ্ধের জন্য গভীর আবেগ এসে ভর করল, শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠল। সারা পৃথিবীতে যেখানে বাংলাদেশের মানুষ আছে, তারাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে একত্র হয়ে গেল।

সেই সময়টির কথা কী সবার মনে আছে? মুক্তিযুদ্ধের সময় জামাতে ইসলামী যতটুকু হিংস্র ছিল প্রায় সে-রকম হিংস্র হয়ে তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করার চেষ্টা করল। ২০০১ থেকে শুরু করে পাঁচ বছর বিএনপি সরকারের অংশ হিসেবে থেকে তারা এখন অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে, মিথ্যা প্রচারণায় তাদের মতো কেউ নেই। বিচারের রায় হওয়ার সাথে সাথে তারা অবিশ্বাস্য পাশবিকতায় দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল, বোমা, আগুন, হত্যা, রেললাইন খুলে ফেলা, পথে-ঘাটে যানবাহন আক্রমণ কিছুই বাকি থাকল না। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল, তারা দেশটিকেই বুঝি অচল করে দিতে চায়।

শেখ হাসিনা নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে দৃঢ় হাতে বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলেন। যে যুদ্ধাপরাধীরা প্রায় ৪০ বছর আগে এই দেশের সোনার সন্তানদের হত্যা করেছে, তারা একে একে ফাঁসিকাষ্ঠে তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে থাকল। বাংলাদেশ তার জন্মের পর প্রথমবার গ্লানিমুক্ত হলো। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখনো আমার কাছে আসে। আমি তাদের বলি, ‘দেখেছ? ৪০ বছর পরে হলেও আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছি! পারবে আর কোনো দেশ?’ তারা মাথা নাড়ে, বলে, ‘না, পারবে না!’ আমাদের দেশ এখন গ্লানিমুক্ত। বিজ্ঞজন, গুণীজন শেখ হাসিনার শাসনকালকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করবেন, তারা কোনো কোনোটি ভালো হয়েছে সেটি বলবেন, কোনো কোনোটি খারাপ হয়েছে সেটিও বলবেন। কেউ কেউ প্রশংসা করবেন, কেউ কেউ সমালোচনা করবেন। আমি আগেই বলেছি, এক চক্ষু হরিণের মতো আমার পুরো জীবনের সম্বল হচ্ছে একটি ফিল্টার, যেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ফিল্টার। আমি এর বাইরে কিছু দেখতে পারি না, এর বাইরে কিছু দেখতেও চাই না।

তাই শেখ হাসিনা যেদিন তার কথা রেখে ভয়ঙ্কর একটা পরিবেশকে সামাল দিয়ে এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন, সেদিন থেকে তার কাছে আমার আর কিছু চাইবার নেই। আমার জীবনে যা কিছু পাওয়ার ছিল, আমি সেটা পেয়ে গেছি। এখন আমি এই দেশের শিশু-কিশোরদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। তার পিতা আমাদের এই দেশটি দিয়ে গিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা সেই দেশটিকে গ্লানিমুক্ত করেছেন। এই দেশকে গ্লানিমুক্ত করার জন্য তিনি যেটুকু করেছেন এর থেকে বেশি একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় করতে পারে না।

২.

ছোট একটি ঘটনার কথা বলে আমি শেষ করে দিই। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠান দেখার সময় একজন জঙ্গি পিছন থেকে আমাকে আক্রমণ করেছিল। উপর্যুপরি আঘাত করে সে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, সেই গুরুতর আঘাত নিয়ে আমাকে সিলেট হাসপাতালে নেওয়া হলো। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খবরটি পাওয়ামাত্র এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টারে আমাকে ঢাকা সিএমএইচ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। একদিন পরে আমি যখন একটু সামলে উঠেছি, তখন খবর পেলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখতে আসবেন। নির্দিষ্ট সময়ে তিনি এলেন, তার সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার খবর নিলেন, ডাক্তারদের সাথে কথা বললেন, আমার স্ত্রীকে সাহস দিলেন। যখন তিনি চলে যাচ্ছেন তখন হঠাৎ করে আমার মনে হলো, তিনি আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য এতকিছু করেছেন, আমার তো তাকে সেই কৃতজ্ঞতাটুকু জানানো হলো না। মানুষ যখন অসুস্থ থাকে তখন সে হয়তো খানিকটা শিশুর মতো হয়ে যায়। আমি আসলেই একেবারে শিশুর মতো খপ করে তার হাত ধরে ফেললাম, বললাম, ‘আপনি ১৬ কোটি মানুষের একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী আর আপনি আমার মতো একজন মানুষকে দেখতে চলে এসেছেন?’

প্রধানমন্ত্রী এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকালেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি আজকে প্রধানমন্ত্রী আছি, কালকে থাকব না। কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, কেউ সেটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।’

আমি কখনোই তার সেই কথাটি ভুলতে পারি না। মনে হয়, সত্যিই তো, এই দেশের জন্য তিনি যেটা করেছেন সেটা বুঝি শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর একজন মেয়েই করতে পারে।

লেখক : শিক্ষাবিদ

এমবি//