ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নাক ডাকা সমাচার

সমর ইসলাম

প্রকাশিত : ০৩:০৪ পিএম, ৪ অক্টোবর ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৪:৩০ পিএম, ৪ অক্টোবর ২০২০ রবিবার

এক
তখন কলেজে পড়ি। এলাকায় একটি বড়সড় সমাবেশ হবে। মন্ত্রী আসবেন। আসবেন অনেক জ্ঞানী-গুণীজন। তার জন্য চলছে নানা আয়োজন। আমরা স্বেচ্ছাশ্রমিক। আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা, মঞ্চ ও প্যান্ডেল তৈরিতে সহায়তায় করা। মাইকিং, পোস্টারিং, হ্যান্ডবিল বিলানো- কত কাজ। একদিন এসব করে করে অনেক রাত হয়ে গেলো। বন্ধু আনসারী বললো, বাড়িতে যেয়ে দরকার নেই। চলো মাঠের পাশের ভবনে শুয়ে পড়ি। বিছানা আছে। অনেকেই এখানে ঘুমায়।

বড় হয়েছি- তার প্রমাণ দিতে এখন মাঝে মধ্যে বাড়ির বাইরে থাকি। সেদিনও থেকে গেলাম। বারোটা একটার দিকে শুয়েছি। একটু ঘুমানো দরকার। সকালে অনেক কাজ। কিন্তু ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করেও কাজ হলো না। চোখের পাতা এক করতে পারছি না। একে তো নতুন জায়গা, দ্বিতীয়ত কিছুটা তফাতে শোয়া এক ব্যক্তির নাক ডাকার শব্দে খুবই বিরক্ত লাগছিল।

আমি পাশ ফিরে শুতেই আনসারী বললো, কী? ঘুম হচ্ছে না?

বললাম, নাক ডাকার আওয়াজে খুব বিরক্ত লাগছে।

: আমারও তো তাই। ব্যাটা পুচকে একটা শরীর! আওয়াজ কি বের হয় দেখছো নি? আনসারীও বিরক্তি প্রকাশ করলো। বললো, রাতটা মাটি হলো, ঘুমানো যাবে না।
আনসারীর কথায় আমিও হতাশ হলাম। তাহলে উপায়? জানতে চাইলাম, কে এভাবে নাক ডাকছে?

: কে আবার মস্তু!

মস্তু মানে মোস্তফা। আমরা মামা ডাকি। অনুষ্ঠানের মাইকিং করে বেড়াচ্ছে। বয়স তার পঁয়ত্রিশ চল্লিশের কোটায়। কিন্তু ওজন চল্লিশ কেজি হবে কি না সন্দেহ? চার সোয়া চার ফুট উচ্চতার মানুষটির লিকলিকে শরীর। হাড্ডির সাথে চামড়া লেগে আছে; মাংস বলতে নাই। নিজে ওঠে গিয়ে নাক ডাকার আওয়াজ এবং মানুষটিকে দেখে হিসাব মিলাতে পারছিলাম না। কারণ তখন পর্যন্ত আমার জানা ছিল মোটা মানুষেরাই শুধু নাক ডাকে।

বিরক্তি নিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখটা হয়তো লেগেও আসছিল। এরই মধ্যে ঘটনাটা ঘটলো। বিকট গোঙানির আওয়াজ। দুম করে বিছানা থেকে ওঠে কে যেন বারান্দায় আছড়ে পড়লো। ভয় পেয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি আনসারীও বারান্দায় যাচ্ছে। পেছনে পেছনে আমিও গেলাম। আনসারী সোজা কল পাড়ে। জগভর্তি পানি এনে মস্তুর মুখ ও মাথায় ঢালছে। কিছুক্ষণ পর হুশে আসলো মস্তু মিয়া। চোখে মুখে তার রাজ্যের আতঙ্ক।

আনসারী জিজ্ঞেস করলো- স্বপ্ন দেখছো নাকি? এত ভয় পাইছো যে?

:  হ্যাঁ, ভয়ানক স্বপ্ন দেখছি মামা। দেখলাম কে যেন আমার বুকে বসে গলা চেপে ধরেছে। তখনও হাঁপাচ্ছিল মস্তু মামা।

মস্তু মামাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে আনসারী বললো, নাও, পড়া পানি দিছি; খায়া শুয়া পড়ো। আর ভয় পাইতে অইবো না। ঘুমায়া যাও।

মস্তু চলে গেলো বিছানায়। আমাদের ঘুম আর আসবে বলে মনে হচ্ছে না। আধ-জোৎস্নার শরৎ রাতে আমি আর আনসারী সৌরজগতের বাইরের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়া আলোচনায় মেতে উঠলাম। আলোচনা পৃথিবীতে আসার পর জানতে চাইলাম মস্তু মামার কাহিনী। তার হয়েছিলটা কি?

আনসারীর চোখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক। বুঝলাম কিছু একটা আছে। বললো, ক্ষণে ক্ষণে নাক টিপে দিয়েও গর্জন বন্ধ করাতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে গুল-থেরাপি দিলাম। অর্থাৎ সামান্য এক চিমটি গুল ওর নাকের সামনে ছড়িয়ে দিলাম। তারপরই সব আওয়াজ এক সাথে বেরিয়ে এলো।

বললাম, সর্বনাশ! দম আটকে যদি কিছু একটা হয়ে যেতো?

: হতে পারতো! এতটা রি-অ্যাক্ট হবে- বুঝতে পারি নাই আগে। তবে অনেক আওয়াজ এক সাথে বের হয়ে গেলো। আশা করি অনেকটা সময় আওয়াজ বের হবে না। দেখছো না এখন আর শব্দ নেই। ঘরের অন্যরা ঘুমাতে পারছে।

দুই
এবারের ঘটনা ভারতের। উত্তরপ্রদেশের পিলভিট জেলার সৌধা গ্রামের। নাম রামস্বরূপ। স্ত্রী ও দুই ছেলে নবীন আর মুকেশকে নিয়ে থাকতেন সৌধা গ্রামে। রাতে ছোট ছেলেকে নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন রামস্বরূপের স্ত্রী। সে সুযোগে ঘটেছে ঘটনা।

এর আগেও বাবার সঙ্গে বড় ছেলে নবীনের একাধিকবার ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু সেদিনের ঝামেলা ভিন্ন মাত্রা পায়। বাবার সাথে ঝগড়াটা শুরু হয় নাক ডাকা নিয়ে। ছেলে ঘুমাতে পারে না, এই তার অভিযোগ। বাবা-ছেলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। এক পর্যায়ে মারমুখী হয়ে ওঠে ছেলে। লাঠি দিয়ে নিজের বাবাকে বেধড়ক মারতে থাকে। মারের চোটে খাট থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান বাবা। তা দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যায় নবীন। খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে আসে ওই বৃদ্ধের ছোট ছেলে মুকেশ। গুরুতর আহত বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন রামস্বরূপকে। (সূত্র- সংবাদ প্রতিদিন)

তিন
নাক ডাকার কারণে পশ্চিমা বিশ্বে ডিভোর্সের ঘটনাও ঘটেছে। সে ঘটনা সংবাদ হয়েছে। আমরা সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি। বোঝা যাচ্ছে এটা ব্যতিক্রম। না হলে সংবাদ হতো না। কারণ সাধারণ ঘটনা সংবাদ হয় না; সংবাদ হয় ব্যতিক্রমী ঘটনা। তাতে বোঝা যাচ্ছে নাক ডাকার কারণে ডিভোর্সের ঘটনা পশ্চিমা বিশ্বেও বিরল। আর আমাদের দেশে?

না, ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেনি। ঘটেছে তার চেয়েও বড় কিছু। অর্থাৎ হত্যাকাণ্ড। নাক ডাকার জন্য এক বৃদ্ধাকে হত্যা করেছে তাদেরই কাজের লোক। নড়াইলের সাংবাদিক ফরহাদ খান খবরটি পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে অনলাইন মিডিয়াতে এসেছে। খবরটি চমকপ্রদ সন্দেহ নেই।

৯ জানুয়ারি ২০১৯। ফরহাদ খানের পাঠানো খবরে জানা যায়, লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়নের সরোল-বাগডাঙ্গা গ্রাম। সেখানে ৯০ বছরের বৃদ্ধা হাজেরা বেগমকে গলাকেটে হত্যা করে বাড়ির কাজের ছেলে আল-আমিন ভুইয়া। ৪ জানুয়ারি রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন হাজেরা বেগম। ঘুমন্ত অবস্থায় ছুরি দিয়ে তার গলাকাটা হয়। এ কথা আল-আমিন পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। ৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার নিজের কার্যালয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। সেসময় গ্রেফতার আল-আমিন ভুইয়াও উপস্থিত ছিলেন। আল-আমিন ভুইয়ার বাড়িও নড়াইল সদর উপজেলার পাইকমারি গ্রামে।

পুলিশ সুপার জানান, প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করেছিলাম, বৃদ্ধার নাতিরা এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু আল-আমিনকে আটকের পর সে হাজেরাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। আল-আমিন পুলিশকে জানিয়েছে, বৃদ্ধা হাজেরার ‘নাক ডাকা’র শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে ছুরি দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। পরে ছুরি পুকুরে ফেলে দেয় সে। আল-আমিন হাজেরাদের বাড়িতে কাজ করত এবং একই ঘরে হাজেরার পাশের কক্ষে ঘুমাত। আর পরিবারের সদস্যরা অন্য ঘরে থাকে।

এদিকে, এলাকার সামাজিকতা ও বাড়িতে যাতায়াতের রাস্তা নিয়ে নিহত হাজেরার পরিবারের সঙ্গে পাশের গ্রামের নাতি আলিজানের বিরোধ চলছিল। এ ঘটনার জেরে নাতিরা নানি হাজেরাকে হত্যা করে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে পুলিশ। এমনকি হাজেরার ছেলে আকরামও এ হত্যাকাণ্ডে তার ভাগ্নে আলিজানের সম্পৃক্ততার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন প্রকৃত হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে তৎপর হন। ঘটনার তিনদিন পর প্রকৃত হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ। গ্রেফতার আল-আমিন নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে এ নির্মম খুনের বর্ণনা দেয়।

এমন তুচ্ছ ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের খবরে এলাকায় মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন তারা।

পুনশ্চ : আমি চিকিৎসক নই। নাক ডাকা বন্ধের চিকিৎসা আমার জানা নেই। তাই বলে যাদের নাক ডাকার অভ্যেস আছে এই লেখা পড়ে তাদের ঘাবড়াবারও কিছু নেই। অনলাইনে সার্চ দিন; দেখবেন কত এক্সপার্ট আপনাকে সহযোগিতার জন্য মুখিয়ে আছে। তাছাড়া সেদিনের সেই চপলমতি আনসারীও এখন অনেক প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ। আমার বিশ্বাস, এ বিষয়েও তাঁর জ্ঞান কাজে লাগানো যেতে পারে। অনলাইন কিংবা সরাসরি যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, নিউজরুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন, ঢাকা।

এসএ/