ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বেলকুচিতে মাঝি-মাল্লাদের বৈঠার ছন্দে উৎফুল্ল যমুনার দুই তীর 

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০১:২০ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০২০ বুধবার

নদ-নদী, খাল-বিল ঘেরা গ্রামীণ বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক অন্যতম অনুসঙ্গের সেই ধারাবাহিকতায় সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে এবারও অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ। সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের আয়োজনে প্রতিযোগিতার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। 

এনায়েতপুর-বেলকুচির মেঘুল্লায় যমুনার নদীর বক্ষে এ প্রতিযোগিতায় ঢাক-ঢোলের বাজনার সাথে তাল মিলিয়ে জারি-সারি ও ধুয়া গানের সাথে মাঝিদের জোরে টানো ছন্দময় বৈঠার সেই চিরচেনা দৃশ্যে অতীত অবলোকন করে উৎফুল্লতায় মেতেছিল কয়েক জেলার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। 

এতে পাবনা, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অংশ নেয়া প্রতিযোগী ৩৯টি নৌকাকে উৎসাহ দিতে উপস্থিত এসব দর্শকের আবেগ, উত্তেজনা এবং মুহু-মুহু করতালীতে মুখরিত ছিল পুরো এলাকা। 

গত ২ সপ্তাহ আগে (১৬ সেপ্টেম্বর) বেলকুচির মেঘুল্লার যমুনা নদীতে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালায় জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ। এ জন্য বাইচের দিন মঙ্গলবার সকালেই টাঙ্গাইল, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, চৌহালী, এনায়েতপুর, বেলকুচি এবং উল্লাপাড়ার নৌকা ও সড়ক পথে প্রতিযোগিতা স্থল মেঘুল্লা ঈদগা মাঠ যমুনার তীরের ৪ কিলোমিটারজুড়ে সমবেত হয় অন্তত অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। 

পাবনা, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার প্রতিযোগি পানসী, কোষা ও বৃহৎ আকারের খেলনা নৌকাও দুপুর ১টার মধ্যে চলে আসে। এরপর বেলা ৩টায় শুরু হয় মূল আকর্ষণ বাইচ। ঘন্টির ঝনঝনানী, ঢাক-ঢোল, বাদ্যযন্ত্রের তালে-তালে উদ্বুদ্ধ করণদাতাদের ‘জোড়সে বল হেইও, আরো জোড়ে হেইও, বাইয়া যাও হেইও’র ছন্দে-ছন্দে মাঝিরা বৈঠা হাতে বেয়ে চলে নৌকা। এ সময় দুই তীরে করতালি, হর্ষধ্বনি, পানি ছিটিয়ে পরিশ্রান্ত মাঝিদের উৎসাহ জোগায়। 

বাইচে এনায়েতপুরের রুপনাই ৭ তারাকে হারিয়ে টাঙ্গাইলের ‘আল্লাহ ভরসা’, বেলকুচির ভেন্নাগাছীর প্রথম আলোকে হারিয়ে শাহজাদপুরের আগনুকালী করতোয়া এক্সপ্রেস, মুকন্দগাতী সোনারতরীকে হারিয়ে চরবেলের একতা, ভেন্নাগাজীর সবুজ বাংলাকে হারিয়ে লক্ষীপুরের একতা, উল্লাপাড়ার ভেংড়ির বাংলার বাঘকে হারিয়ে পাবনার জনতা এক্সপ্রেস, টাঙ্গাইলের নাগরপুরের দাদা-নাতি এক্সপ্রেসকে হারিয়ে আজুগড়ার শের-এ বাংলা জয়লাভ করে। আর এভাবেই ৩৯টি নৌকা জোড়া বাইচে অংশ নিয়ে ২০টি বিজয়ী হয়। 

টাঙ্গাইলের নাগরপুরের দাদা-নাতি এক্সপ্রেস ও আজুগড়ার শের-এ বাংলা খেলনা নৌকাটি ঘিরেই ছিল সবার আগ্রহ। দৃষ্টিনন্দন পুরো কাঠের নৌকাটি যখন ৯০ জন মাঝি-মাল্লা নিয়ে প্রতিযোগীতায় টান শুরু করলো তখনই বাধ ভাঙ্গা মানুষের সে কি উচ্ছ্বাস। 

শের-এ বাংলা নৌকার তত্ত্বাবধায়ক আবু বক্কার, ধুকুরিয়া বেড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সুলতান হোসেন, দৌলতপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদীব কুমার, শিক্ষক সেলিম রেজা, শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম, ব্যবসায়ী কামাল আহমেদ জানান, ‘এমন স্বতঃফুর্ত জনতার উৎসবমুখর আয়োজনের নৌকা বাইচ আগে কখনো দেখিনি। করোনাকালীন সময়ে মানুষের ভীতি আতঙ্ক মলিন করে পুনঃ জাগরণে উজ্জীবিত করেছে এই বাইচ। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি বন্যার সময় হলেই চারদিকে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার ধুম পড়তো। কিন্তু এখন আর খুব একটা এ আয়োজন হয় না। তবে ব্যতিক্রম লতিফ বিশ্বাস গ্রামীণ ঐতিহ্যকে লালন করে প্রতিবার নৌকা বাইচের আয়োজন করছে। আমরা চাই নির্মল আনন্দের এ ধারা যেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লতিফ বিশ্বাস অব্যাহত রাখেন।’

এদিকে এই বাইচকে ঘিরে যমুনার তীর জুড়ে মেঘুল্লায় বসেছিল নানা মুখরোচক খাবারের দোকানের মেলা। সেখানেও ছিল নারী-পুরুষ বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। এনায়েতপুরের আনিসুর রহমান কমান্ডার, খামারগ্রামের আব্দুল মান্নান মোল্লা, বেলকুচির জিধুরীর জীবন তালুকদার, দৌলতপুরের হাজী শহিদুল ইসলাম জানান, ‘আসলেই নৌকা বাইচের এই বিশাল আয়োজন আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সকল ভেদাভেদ ভুলে অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য সবাই আমরা এক কাতারে মিশে ছিলাম। এই আয়োজনের মাধ্যমে মাদক, যৌতুক, জঙ্গী, সন্ত্রাস বন্ধ করে সবাইকে এক হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করার যে আহবান জানানোয় পুরো উদ্যোগটি পূর্ণতা পেয়েছে।’

এছাড়া ঐতিহ্যের এই বাইচ উপলক্ষে মেঘুল্লা, আজগরা, জামতৈল, ক্ষিদ্রমাটিয়া, বংখুড়ি, চর মেঘুল্লা সহ আশ পাশের গ্রামের বাড়িতে-বাড়িতে নায়রে আনা হয়েছিল ঝি-বেটি সহ আত্বীয় স্বজনদের। এ যেন ঈদের মতই আরেক আনন্দ। 

এ ব্যাপারে মেঘুল্লা গ্রামের বারেক বিশ্বাস, গাজী ইসমাইল হোসেন, অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, নান্নু বিশ্বাস, নজরুল ইসলাম নজু জানান, ‘ঈদের আনন্দ দিনের জন্য হলেও নৌকা বাইচের আনন্দ আমাদের এলাকার ৮/১০টি গ্রামের মানুষ ৩ দিন উপভোগ করছে। প্রতি বাড়িতেই স্বজনদের এনে তালের পিঠার আয়োজন চলছে।’
    
খেলায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে জেলা পরিষদ প্রধান নির্বাহী ইকতেখার উদ্দিন শামীম, বেলকুচি পৌর মেয়র বেগম আশানুর বিশ্বাস, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমুল হক মিরু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউসুফজী খান, সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক সরকার, জেলা পরিষদ সদস্য সেলিনা পারভীন পান্না, গাজী গোলাম মোস্তফা, শাহজাহান আলী মিয়া, ইকবাল হোসেন নয়ন, ওসি গোলাম মোস্তফা সহ জেলা, থানা আওয়ামীলীগের নেতৃবিন্দ এবং জেলা পরিষদের সদস্য ও অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

পরে তারা বিজয়ী নৌকার মালিকদের হাতে ফ্রিজ এবং পরাজিতদের এলইডি টিভি উপহার তুলে দেন।

আয়োজন প্রসঙ্গে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস বলেন, ‘নৌকা উন্নয়ন অগ্রগতী ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক। এই নৌকাই আখিরাতের কান্ডারী। সেই নৌকা বাইচেরই আমরা আয়োজন করেছিলাম সকল পাপাচারের বিরুদ্ধে। সবার স্বতঃফুর্ত অংশগ্রহণ আমাদের মুগ্ধ করেছে। আগামীতেও বাল্য বিবাহ, সন্ত্রাস, জঙ্গী মুক্তে সোনার বাংলা গড়তে সকলে উৎসাহ যোগাতে এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।’

এআই/এমবি