ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

‘মুড়িরটিন’ বাস সার্ভিস

আনোয়ার কাজল

প্রকাশিত : ০১:৪৮ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

আধুনিক যানবাহনের সয়লাবে ঢাকা থেকে তথা দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ঐহিত্যবাহী ‘মুড়িরটিন’ বাস।  এক সময় মুড়িরটিন ছাড়া চলাচল অকল্পনীয় হলেও আজ আর এ গাড়িটিকে নিয়ে কাউকে কথা বলতে শোনা যায় না।

বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর মানুষের আজ আর পেছনের দিকে  তাকানোর কারোরই সময় নেই। আকাশের বিদ্যুৎকে বেঁধে চাকরের মত কাজে লাগাচ্ছে, নদীর গতিপথকে  রুদ্ধ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে শূণ্যের বুকে পাড়ি দিয়ে চাঁদে গিয়ে ফিরে আসছে,  হিমালয়ের স্ফিত বুকে সে তার দাপুটে পা মাড়িয়ে আসছে, ঊর্ধ্বলোকে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে আসমান ও  জমিনে নজরদারি করছে। 

যা শুনে অবাক মনে হলেও এটাই আজকের বাস্তবতা। ষাট-সত্তর বছর বয়স্ক নারী-পুরুষদের কাছ থেকে তাদের সময়কার যানবাহন তথা চলাচলের কথা শুনে অবাক হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বদলে গেছে মানুষের জীবন যাত্রা। নতুন নতুন আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নতুন সমাজ। পাল্টে গেছে মানুষের রুচিবোধ, অভ্যাস ও প্রাত্যহিক কর্মজীবনের রুটিন ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র। 

এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওযার মাধ্যম পায়ে হাঁটা, নৌকা, পালকি, গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ি থেকে বিবর্তন ঘটলো যন্ত্রচালিত যানে। যন্ত্রচালিত যান হিসাবে ঢাকাসহ এ অঞ্চলে আর্বিভূত হলো ঐতিহ্যবাহী যান ‘মুড়িরটিন’ বাস। মুড়িরটিন বাস সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা ইতিহাস সবার মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ও রুটে চলাচল করতো ঐতিহ্যবাহী মুড়িরটিন বাস। আজ তা স্মৃতি জাগানিয়া অতীতের প্রতিচ্ছবি বৈকি!

মুড়িরটিন বাসের ইতিহাস ও নামকরণ
মুড়িরটিন স্টার্ট বাসের গল্প বা ইতিহাস হলো- ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন এ অঞ্চলে মিত্রবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু যানবাহন ইংরেজরা এদেশের কিছু বিত্তশালীদের কাছে নিলামে বিক্রি করে দেয়। সেসব যানবাহনের মধ্যে ছিলো- মালামাল পরিবহনের ট্রাক, জীপ গাড়ি, কাসিম বা কচ্ছপ মার্কা টেক্সিসহ আরও অন্যান্য তাদের কিছু ব্যবহারিক ভাঙাচোরা গাড়ি। এসব ভাঙাচোরা গাড়িগুলো তখনকার সময়ের বিত্তশালীরা ইংরেজদের কাছ থেকে কম দামে কিনে রাখে।

তারপর বিত্তশালীরা ওইসব ভাঙাচোরা কাঠের বডি ট্রাকগুলো বাসের আদলে তৈরি করে এক ধরনের নাকবোঁচা বাস। কাঠের বডির ওপর মুড়ে দেওয়া হয় টিন। একটা ছৈয়া (ছাউনি) নৌকা যেভাবে বানানো হয়, ঠিক সেভাবেই টিন দিয়ে ট্রাকের চারদিক মুড়িয়ে দেওয়া হয়। যাতে চলন্ত পথে বৃষ্টি এলে যাত্রীরা ভিজে না যায়। সেই থেকেই বাসগুলোর নাম হয় ‘মুড়িরটিন’।

আবার ওইসব মুড়িরটিন বাসগুলো হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট দেওয়া হতে বলেই এগুলোর আরেক নাম ছিলো ‘স্টার্ট বাস’। যা দেখতে একরকম গৃহস্তের ঘরে থাকা মুড়িরটিনের মতনই দেখা যেতো। তাই অনেকেই ওই বাসগুলোকে মুড়িরটিন বাস বলতো। আবার অনেকে মুড়িরটিন বাসের নাম নিয়ে অন্য মতও পোষণ করে থাকতো। তাদের মতে, গৃহস্তরা একটা মুড়ির টিনে যেভাবে ঠাসাঠাসা করে মুড়ি ভরে রাখতো, ঠিক তখনকার সময়ে মুড়িরটিন বাসে সেভাবেই ঠাসাঠাসা করে যাত্রী ভরা হতো বলেই বাসটির নাম হয় মুড়িরটিন।

ঢাকায় মুড়িরটিন বাস
ঢাকা শহরে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচলের জন্য শুরুতে সদরঘাট, নবাবপুর, ইসলামপুর, চকবাজার, গুলিস্তানের মধ্যে চলাচল করত মুড়িরটিন বাস। পরে নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর, ডেমরা, রামপুরা রুটে মুড়িরটিন বাস চলতো। এ ছাড়া গুলিস্তান থেকে কালিয়াকৈর, নয়ারহাট, আরিচায়ও যাতায়াত করত এই বাস। মুড়িরটিন বাস সত্তর ও আশির দশকে বেশি চলেছে। ঢাকায় ঘোড়া আর গরুর গাড়ি থাকলেও গণপরিবহন হিসেবে মুড়িরটিনই ছিল ভরসা। 

জগন্নাথ কলেজের (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) পেছনের গেটে স্ট্যান্ড ছিল এই মুড়িরটিন বাসের। সেখান থেকে ছেড়ে চিত্রামহল-নাজিরা বাজার-ফুলবাড়িয়া-গুলিস্তান-পল্টন হয়ে রামপুরা যেত। প্রতি ট্রিপে ২৫ মিনিট সময় বরাদ্দ ছিল। প্রতি মিনিট দেরির জন্য পাঁচ টাকা জরিমানা দিতে হতো।

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে সামনের নাক উঠে গিয়ে গাড়ি বড় হয়, সিটও বাড়ে। ২৫ বছরের পুরনো গাড়ির ফিটনেস বাতিল করা হলে আশির দশকের পর ঢাকা থেকে মুড়িরটিন প্রায় উঠে যায়। তবে মুড়িরটিনের পরবর্তীতে কাঠের তৈরি বডির বাস ২০০০ সাল আগ পর্যন্ত থাকে। তখন সর্বশেষ বাহাদুর শাহ পার্ক বা সদরঘাট রামপুরা-কুড়িল রুটে ও গাজীপুর থেকে সায়দাবাদ রুটে নিয়মিতভাবে চলাচল করতে দেখা গেছে।

এতোটুকু জায়গা, তাতে মুড়ি-মুড়কির মতো যাত্রী ওঠে। কি একটা হাশফাঁস অবস্থা। লোকে তাই মজা করে বলতে শুরু করে এগুলো বাস নয় মুড়িরটিন! এই গাড়িগুলো স্টার্ট দিতে হতো হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে। পরে অবশ্য চাবি সিস্টেম করা হয়। হর্ণ ছিল পিতলের। আর গতি? খুব বেশি তা নয়, ঘন্টায় ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যেই ওঠানামা করত।

বাসের কন্ডাক্টরদের কাঁধে ঝুলত লম্বা ফিতাওয়ালা একটা ব্যাগ। ভাড়া আদায় করে রাখা হতো সেখানে। টিকেট আর টাকা রাখার জন্য তিনটা পকেট থাকত এসব ব্যাগে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা অন্যরকম ক্ল্যাসিক ব্যাপার ছিলো।

ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হতো ইঞ্জিন। কাঠের বডি তৈরি করতো স্থানীয় মিস্ত্রিরা। ভেতরে চারধারে বেঞ্চের মতো করে সিট বসানো হতো। ২০-২২ জন বসার সুযোগ পেত। তবে ৫০ জনের বেশি যাত্রী দাঁড়িয়েই থাকত। স্টিলের জানালার পুরোটাই খোলা যেত বলে বাতাস চলাচলের সুযোগ ছিল বেশি। গাড়ির গতি থাকত ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার। স্টিয়ারিং ছিল শক্ত। পিতলের হর্ন চাপ দিয়ে বাজানো হতো। এই মুড়িরটিন বাসগুলো তখন শহরের একমাত্র গণপরিবহন হওয়ায় বিশাল চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। 

বাংলা সাহিত্য মুড়িরটিন বাস সার্ভিস
আমাদের সাহিত্যে মুড়িরটিন অনেকভাবে এসেছে বিভিন্ন সময়। বাংলা সাহিত্যের অনেক উপন্যাসে ঘুরে ফিরে এসেছে মুড়িরটিন প্রসঙ্গ। হুমায়ূন আহমেদও তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে মুড়িরটিন পরিবহনকে এনেছেন। সেই থেকে অদ্ভুত নামধারী এই পরিবহনটার প্রতি অনেকের কৌতূহল ছিল। হুমায়ূন আহমেদের ‘অনীল বাগচির একদিন’ উপন্যাস অবলম্বনে হওয়া সিনেমাতে একাত্তর সালকে ধারণ করতে দেখানো হয়েছে এই মুডিরটিন বাস সার্ভিসকে।

কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনও মুড়িরটিন নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি তার স্মৃতিচারণমূলক লেখায় লিখেছেন, “এই ধরনের বাসগুলোর একটা ডাকনাম ছিল মুড়িরটিন। আসল নাম ‘টাউন সার্ভিস’। ছ’ আনা বা আট আনায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ। গুলিস্তান থেকে ছাড়ত, ভিক্টোরিয়া পার্কের ওদিক থেকে সদরঘাট থেকেও চলাচল করতো।”

আশির দশকের পর থেকে উঠে যেতে থাকে এই মুড়িরটিন বাসগুলো। তবে কাঠের বডির বাসগুলো তারও পরে কিছুসময় ধরে চলে। কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্যবাহী মুড়িরটিন এখন অনেকের স্মৃতিতে নেই বলেই মনে হয়। এখন ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বাস, এই বাস, সেই বাস, ননস্টপ বাস, বিরতিহীন বাস, গেইটলক বাস, এসি বাস, বলভো বাস, কলম্বো বাস, সরকারি বিআরটিসি বাস-সহ আরও কতরকমের বাস আর বাস। এতো এতো বাসের ভীড়ে সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী যাত্রীবাহী মুড়িরটিন বাস কোথায় যে হারিয়ে গেলো, তা আর নিজের স্মৃতিতেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এএইচ/ এসএ/