ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সত্তরের ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও ঐতিহাসিক নির্বাচনের স্মৃতিকথা

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত : ১১:১৬ এএম, ১২ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

প্রতি বছর ১২ নভেম্বর যখন আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে, তখন স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে ’৭০-এর প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়ের ছবি। যে জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলে ১০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে; অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়; অনেকে আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়।

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর এ দুঃসময়ে সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি আমাকে আবেগাপ্লুত করে। সেদিন ভয়ংকর সেই বিপর্যয় মোকাবেলায় আমাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। কারণ আমরা ছিলাম পরাধীন, পাকিস্তানের অধীন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ না করলে আজ হয়তো আমাদের অবস্থা হতো রোহিঙ্গাদের মতোই।

’৭০-এ ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর থেকে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহৃত হয়। তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসুর ভিপি। সে সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সকল এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিব।’

এ কথাটা ভীষণভাবে আমার হৃদয়কে আলোড়িত করে। ’৭০-এর ২ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ভোলা সফরে যাই এবং ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে- তখন ভোলায় রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না- ব্যাপকভাবে গণসংযোগ চালাই। বঙ্গবন্ধু ১ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে একটা মোটরবাইক কিনে দিয়েছিলেন। এ মোটরবাইক ছিল আমার বাহন। ভোলার মনপুরার সম্ভ্রান্ত পরিবারের ব্যক্তি জনাব বসরতউল্লাহ চৌধুরী, আমরা যাকে শাহজাদা ভাই বলে শ্রদ্ধা জানাতাম- তার একটি জিপ ছিল।

এ জিপটি তিনি আমার নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। এ জিপটি নিয়েই তিনি ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতে চলে যান এবং ৯ মাস আমার সঙ্গে থেকে সক্রিয় ছিলেন। এপ্রিল মাসে ভোলার ৭টি থানায় নির্বাচনী সভা করি। কখনও হেঁটে কখনোবা মোটরবাইক চালিয়ে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে। আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ভোলা থানা, দৌলতখাঁ থানা, তজুমুদ্দি থানা এবং মনপুরা। আরেকটি এলাকা ছিল বোরহানউদ্দিন, লালমোহন এবং চরফ্যাশন।

নির্বাচনী এলাকাটি ছিল বড়। নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত ছিলাম আমার এলাকায়। কয়েকদিন ধরে গুমট আবহাওয়া, বৃষ্টি এবং সেসঙ্গে ছিল ঝড়ো বাতাস। এরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া, মওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজুর রহমান মিয়া ও রিয়াজউদ্দীন মোক্তারসহ অন্য প্রবীণ নেতাদের নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকাসহ ভোলায় ব্যাপক গণসংযোগ করি।

আমি ছিলাম ছোট। বয়স কম। বয়স্ক নেতাদের নিয়ে গেলে মানুষ সন্তুষ্ট হতো। ভোলার যেখানে গেছি, হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। তাদের সামনে বক্তৃতা করেছি। এভাবে যখন ১৭ এপ্রিল ৭টি জনসভা শেষে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাবাকে জানালাম- বাবা, বঙ্গবন্ধু আমাকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এমএনএ পদে মনোনয়ন দিতে চেয়েছেন। তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তুই এত অল্প বয়সে এমএনএ হবি। তোর বয়স মাত্র ২৬।’ আমি বাবার দোয়া নিয়ে ঢাকা আসি।

তারপর দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভায় যোগদান করি। ২৫ এপ্রিল আমার জনসভা ছিল চট্টগ্রামের মীরেরসরাই। যেখান থেকে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তখন ’৭০-এ এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) এবং আমাদের ফজলুল হক বিএসসি সাহেব এমএনএ (জাতীয় পরিষদ সদস্য) পদপ্রার্থী।

মীরেরসরাইয়ের জনসভায় আমাদের প্রিয়নেতা চট্টগ্রামের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এমএ আজিজসহ যখন সভা করছি, তখন বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়েছেন অনতিবিলম্বে আমি যেন ভোলা চলে যাই। বক্তৃতা শেষ করে প্রয়াত নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সাহেবের ভাইয়ের যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন- গাড়িতে করে চাঁদপুর পৌঁছাই এবং ২৬ তারিখ সকালে গ্রামের বাড়ি পৌঁছি।

ততক্ষণে বাবার দাফন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে যেতে বলেছিলেন; কিন্তু বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন, এটি জানাননি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা আর নেই। বাবার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১৭ এপ্রিল।

প্রতি মাসে ভোলা যাই, গণসংযোগ ও জনসভা করি। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ নির্বাচন যখন ঘনায়মান, তার ২৫ দিন আগে ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয় দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত। ১২ নভেম্বরের তিন-চার দিন আগ থেকে বিভিন্ন স্থানে জনসভা করেছি।

১০ তারিখ আমার জনসভা ছিল তজুমুদ্দি এবং ১১ তারিখ লালমোহনে মঙ্গল শিকদারে জনসভা করতে যাই। সেখানে জনসভায় যখন বক্তৃতা করছি, তখন শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি এবং প্রচণ্ড ঝড়। জনসভা শেষে প্রবীণ নেতারাসহ জিপে ভোলায় ফিরে আসি। ১২ তারিখ জনসভা ছিল তজুমুদ্দির দাসের হাট।

যখন শাহজাদা ভাইয়ের জিপে করে দৌলতখাঁ হয়ে তজুমুদ্দি যাওয়া যেত- রওনা করেছি, তখন দৌলত খাঁ যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। সবাই জনসভায় যেতে নিষেধ করল। কিন্তু আমি তো রিকশা করে মাইক পাঠিয়েছি। আমার লোক চলে গেছে দাসের হাটে। আমার মা সংবাদ পেয়ে- শ্রদ্ধেয়া মা যিনি আমার জীবনে প্রেরণার উৎস- নিষেধ করলেন, আমি যেন জনসভা বাতিল করি।

বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। মধ্যরাতে শুরু হয় তুমুল ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস। সকালবেলা নদীর পাড়ে গিয়ে অবাক হলাম। শুধু কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ। অসংখ্য লোকের মৃতদেহ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আমরা দিশেহারা হয়ে গেলাম।

স্মৃতির পাতায় আজও ভাসে, শিবপুর ইউনিয়নে রতনপুর বাজারের পুকুরপাড়ে শতশত মানুষকে দাফন করার সেই করুণ দৃশ্য! এত মৃতদেহ দাফন করে কুলাতে পারছি না। চারদিকে মানুষের হাহাকার আর ক্রন্দন। শিবপুর ইউনিয়নে একটি বাড়ি, যেখানে ৯০ জনের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ৩ জন।

যখন তজুমুদ্দির খবর পাই; তখন শুনি, ৪০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যে দাসের হাটে জনসভা করার কথা ছিল, সেখানে কিছুই নেই। আমার মাইক বহনকারী মৃত্যুবরণ করেছেন। দাসের হাটে বড় বড় ব্যবসায়ীরা সবাই সর্বস্বান্ত। বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচনী গণসংযোগে সাতক্ষীরায় অবস্থান করছেন।

সেখান থেকে লোক মারফত টাকাসহ বার্তা পাঠালেন, আমি যেন সর্বত্র দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং শুকনো খাবার বিশেষ করে চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছে দেই এবং বলেছেন, ‘তুই দুর্গত এলাকার প্রত্যেকটা জায়গায় ক্যাম্প র্ক এবং লিখে রাখ্- ‘‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ’।

অনেক মানুষ রিলিফ নিয়ে যাবে; কিন্তু এ দুর্গত অবস্থায় তারা মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছাতে পারবে না। কিছুটা বিলি করে বাকিটা তোর কাছে দিয়ে আসবে। তুই সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিবি।’’

হয়েছেও তাই। ১২ নভেম্বরের পর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পানি, শুকনো খাবার, কেরোসিন তেল পৌঁছে দিয়েছি। হাবিবুর রহমান তালুকদার নামে একজন পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষ ছিলেন। তার একটি লঞ্চ ছিল। সেই লঞ্চে নদীর পাড়ে পাড়ে মানুষের সেবা করেছি। যখন রাস্তা দিয়ে যেতাম, হাট-বাজার ভেঙে মানুষ ছুটে আসত।

মানুষের জন্য কাজ করলে মানুষ তার যে প্রতিদান দেয়, সেদিন তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। ১৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ভোলায় এলেন। সেখান থেকে লঞ্চে করে বঙ্গবন্ধুকে আমরা দুর্গত এলাকায় নিয়ে গেলাম। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, লাখো মানুষের মৃতদেহ আর সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষের পাশে তিনি দাঁড়ালেন। য

খন মনপুরায় গেলাম দেখি, বহু লোকের ভিড়ে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে। পরনে স্রেফ একটা লুঙ্গি। লঞ্চ থেকে নেমেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি প্রিয় শাহজাদা ভাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে টেনে আদর করলেন।

লঞ্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট ছিল, সেগুলো তিনি শাহজাদা ভাইকে দিলেন। ফেরার সময় নদীর পাড়ে লাখ লাখ লোকের মৃতদেহ দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আর আমার পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভব নয়! আমাকে তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠিয়ে দাও।’

যে বিশেষ লঞ্চে বঙ্গবন্ধু ভোলা গিয়েছিলেন, সেই লঞ্চে ঢাকা ফিরে এলেন। উপকূলীয় দুর্গত এলাকা ভোলা, রামগতি সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি।

প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। এভাবে আমরা মানুষকে মরতে দিতে পারি না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এখনও দুর্গত এলাকায় আসেননি। আমরা যে কত অসহায়, এ একটা সাইক্লোন তা প্রমাণ করেছে। আরও একবার প্রমাণিত হল, বাংলার মানুষ কত অসহায়! একবার পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে।

আরেকবার এ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রমাণিত হল। সুতরাং, আমরা এভাবে আর জীবন দিতে চাই না। আমরা স্বাধিকারের জন্য, আমাদের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করতে চাই।’ আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করব।

এ নির্বাচন হবে আমার জন্য একটা গণভোট। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে, কে বাংলাদেশের নেতা এবং কীভাবে এ অঞ্চল পরিচালিত হবে।’ ভোলাসহ উপকূলীয় দুর্গত এলাকা সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে বাংলার মানুষকে তিনি এক কাতারে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি তখন আর্তের সেবায় উদয়াস্ত কাজ করছি। ভোলাসহ দুর্গত এলাকার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রতিনিয়ত আমার খোঁজ নিতেন। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এলেন ভোলায়।

১৪ দিন পর অর্থাৎ ২৬ নভেম্বর ভোলায় এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। নামলেন চকিঘাটে। চকিঘাটে গেলাম। চকিঘাট থেকে তিনি দৌলত খাঁ গেলেন। চারদিকে হাজার-হাজার লোক। প্রেসিডেন্টের গাড়িতে ছিলেন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ও গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসান।

সাহেবজাদা ইয়াকুব আমাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বললেন, ‘হি ইজ মিস্টার তোফায়েল আহমেদ।’ জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘হু ইজ তোফায়েল? স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল!’ তিনি বললেন, ‘ইয়েস, স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল।’ ইয়াহিয়া খান আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের জন্য কী করতে পারি?’

আমি বলেছিলাম, তবুও তো আপনি এসেছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দুর্গত এলাকায় এসেছেন ঘটনার ১৪ দিন পর। আপনি এখনও নদীতে ভাসমান ও রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের মৃতদেহ দেখতে পাবেন। এ হল আমাদের বাঙালিদের অবস্থা। তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন।’

বললাম, আমি কেন ঘোষণা দেব? আপনার কর্মকর্তারা রয়েছেন। আপনি যা দান করবেন, তা তাদের বলেন ঘোষণা করতে। তখন প্রবেশনারি অফিসার সা’দত হুসাইন, যিনি পরে কেবিনেট সেক্রেটারি হয়েছিলেন; কিছুদিন আগে মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনি একটি জিপের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনাদের জন্য ২৫ হাজার টাকা সাহায্য হিসেবে বরাদ্দ করেছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনসাধারণ চিৎকার দিয়ে উঠল- ‘না’ ‘না’ ‘না’।

আমি দু’হাত তুলতেই মানুষজন শান্ত হয়ে গেল। ইয়াহিয়া খান চলে গেলেন। সেনাবাহিনী রিলিফ তৎপরতা আরম্ভ করল। তারপর ভোলায় এলেন ভোলারই কৃতী সন্তান মোকাম্মেল হক, আনিসুজ্জামান সিএসপি (পূর্ব পাকিস্তানের রিলিফ কমিশনার), সুলতানুজ্জামান খান, (খুলনার কমিশনার)-বরিশাল তখন খুলনার অধীনে- আইয়ুবুর রহমান ছিলেন বরিশালের ডিসি, তিনি এলেন।

সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তের সেবা করেছি। শ্রদ্ধেয় নেতা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এক বিরাট লঞ্চভর্তি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ভোলা এসেছিলেন ত্রাণকার্যে। কিছু তিনি বিলি করতে পেরেছেন, বাকিগুলো রেখে এসেছিলেন আমার কাছে। সেগুলো আমি বিলি-বণ্টন করেছি। খাবার পানি, মুড়ি, চিড়া, ওষুধপথ্য বিলি করেছি দুর্গত এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে। এছাড়াও এসেছিল কম্বল, শাড়ি-কাপড়। এর সবই অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।

তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। আমার নির্বাচনী এলাকাসহ উপকূলীয় এলাকার জাতীয় পরিষদের ১৭টি আসনে ৭ ডিসেম্বরের পূর্বঘোষিত নির্বাচন স্থগিত হয়ে তা অনুষ্ঠিত হয় ১৭ জানুয়ারি। ইতোমধ্যে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণকার্য পরিচালনার মধ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন পাই। তার আগে বঙ্গবন্ধু আমায় ডেকে নিয়ে আসেন। সারা বাংলাদেশ সফর করেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। একই ট্রেনে গিয়েছি। তার পাশে থেকেছি।

একই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর আগে বক্তৃতা করেছি। আবার তিনি বক্তৃতা করার সময় চলে গিয়েছি আরেক জনসভায়। বঙ্গবন্ধু যখন এক জনসভা শেষ করে আরেকটিতে আসছেন, তখন আমি চলে গেছি আরেকটি জনসভায়। এভাবে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। নির্বাচনের দিনও আমি বঙ্গবন্ধুর পাশে।

বিদেশি সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি কতটি আসনে জয়ী হওয়ার আশা করেন?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি অবাক হবো, যদি আমি দুটি আসনে হারি।’ সত্যি দুটি আসনেই আমরা হেরেছিলাম। জাতীয় পরিষদে সরাসরি নির্বাচনে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম।

স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম যান ভোলা। ’৭০-এ তিনি দেখে এসেছিলেন জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত ভোলা। ১৪ ফুট জলোচ্ছ্বাসে সবই ভেসে গিয়েছিল। যে জায়গায় বেড়িবাঁধ ছিল না, সেই স্থানকে জিরো পয়েন্ট বলতাম। সেখান দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করেছে এবং নিমেষের মধ্যে সব তলিয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধু ছোট্ট একটি হেলিকপ্টারে করে ভোলা এসেছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। ভোলায় সেই জিরো পয়েন্টে বঙ্গবন্ধু মাটি কেটে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ভোলা থেকে রামগতি গিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্বোধন করেছেন। আজকে বেড়িবাঁধ দিয়ে আমরা জলোচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করি, ঘূর্ণিঝড় হলে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় গ্রহণ করি।

আগে এ সাইক্লোন শেল্টারকে বলা হতো ‘মুজিব কেল্লা’। এটি বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু চর কুকরি-মুকরি গেছেন, সাইক্লোন শেল্টার করেছেন, জনসাধারণকে ডিপটিউবওয়েল দিয়েছেন, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন করেছেন, যেটি আজ ফরেস্ট হয়েছে।

এসব বঙ্গবন্ধুর অবদান। বঙ্গবন্ধু ভোলাকে খুব পছন্দ করতেন। মনপুরায় তিনি ‘চিন্তানিবাস’ নামে একটি আবাসস্থল করতে চেয়েছিলেন। তার কাজও শুরু হয়েছিল। বসরতউল্লাহ সাহেব একটি দীঘি কেটে মাটি ভরাট করে কাজটি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন যুগোস্লাভিয়া সফরে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছি মার্শাল টিটো একটা দ্বীপে থাকতেন। দ্বীপটার নাম ছিল ‘ব্রিওনি’।

ওখান থেকে বঙ্গবন্ধু মনে করলেন, ভোলার একটি দ্বীপে এরকম আবাসস্থল করবেন, যেখানে বিদেশিরা গেলে তাদের সঙ্গে মিটিং হবে। তিনি এটি করে যেতে পারেননি। মনপুরায় অবকাশ যাপন কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। আলী মিয়া মাস্টার ছিলেন মনপুরার চেয়ারম্যান। তিনি আমার প্রিয় মানুষ ছিলেন। তার পরিবারে ২৭ জন সদস্য ছিল।

ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পর তিনি একাই বেঁচে ছিলেন। কত প্রিয় মুখ আমি হারিয়েছি। যার সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছে, পরদিন তাকে পাইনি। ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রামগতি, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি পোস্টার হয়েছিল- ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ এই পোস্টারটিতে ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের কথা ব্যক্ত হয়েছিল। দুটো ঘটনা বাংলার মানুষকে পথ দেখিয়েছে। এক, ’৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ- যখন আমরা ছিলাম ‘অরক্ষিত’; আর ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস- যখন আমরা ছিলাম ‘অসহায়’। বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা।

সেই দায়িত্বটা এখন বর্তেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্কন্ধে। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করত, ঘরবাড়ি হারাত। সেসব এখন আর নেই। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসনীয়।

যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার যে ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি, তা এখন সারা বিশ্বের জন্য মডেল। বাংলাদেশে এখনও প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়; কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগে হতো, এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হল বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ
tofailahmed69@gmail.com
এসএ/