ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

দেশের নামটি বাংলাদেশ

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৬:২৪ পিএম, ৬ ডিসেম্বর ২০২০ রবিবার

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলেছে ন’মাস ধরে- স্বাধিকারের জন্যে, স্বাধীনতার জন্য, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্যে। সে যুদ্ধ সহায়তা পেয়েছে, সাহায্য পেয়েছে নানাজনের কাছ থেকে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্খার বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

এখনো মনে আছে- সময়টা সম্ভবত ছিলো সকাল ১০টা বা সোয়া ১০টা। বাবা তাঁর লেখার টেবিলে বসে কাজ করছিলেন। পাশে খুব হাল্কা করে রেডিও চলছিল। মা পেছনের বারন্দায় বসে কুটনো কুটছেন। আমি সামনের বারান্দায় বসে কি একটা বই পড়ছিলাম। অন্যান্য বোন-ভাইয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

হঠাৎ বাবার ঘর থেকে একটা চিৎকার। আমরা যে যেখানে ছিলাম দৌঁড়ে তাঁর কাছে চলে গেলাম। ভাবলাম, তাঁর নিশ্চয়ই খারাপ কিছু একটা হয়েছে। কাছে যেতেই দেখি, ভদ্রলোক আনন্দ-উত্তেজনায় টইটুম্বুর। মুখে শুধু একটাই কথা- ভূটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভূটানের রাজা জিগমে দরজি ওয়াংচুকের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি-বার্তা এসেছে। এই মাত্র তিনি শুনেছেন আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্রের খবরে। 

আমরা আহ্লাদে আটখানা। মা রেগে আগুন- না, ভূটানের ওপরে নয়, বাবার ওপরে। ‘এতো জোরে কেউ চেঁচায়? আমি তো ভাবলাম, শরীর খুব খারাপ হয়ে গেলো কি না’? আমরা সংবাদটির গুরুত্ব বুঝিয়ে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করি, কিন্তু বাবার ওপরে তাঁর রাগ আর পড়ে না।
 
‘এই প্রথম বিশ্বে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেল’, -বলতে বলতে বাবার গলা ধরে এলো। চোখের কোণে তাঁর জল। সারা ঘরে কেমন এক নীরব প্রশান্তি নেমে এলো। মা আর কিছু না বলে তাঁর কাজের দিকে পা বাড়ালেন। বোন-ভাইয়েরা চলে গেল নিজ নিজ জায়গায়। আমি শুধু দাঁড়িয়ে থাকলাম বাবার টেবিলের পাশে।

‘ভূটান যখন স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন ভারতের স্বীকৃতিও এসে গেলো বলে’ -প্রজ্ঞাবাণ মানুষটি যেন দৈববানী করলেন। ‘বড় দেশ স্বীকৃতি দেয়ার আগে তারা ছোট দেশকে দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়ায়’ -বাবার মাঝের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কথা কয়ে ওঠে।

আমি কোনও কিছু না বলে রেডিওটি তুলে আমার ঘরে চলে গেলাম। বোধহয় ঘণ্টাখানেক পরেই বাবার ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। ভারতের স্বীকৃতি এলো সম্ভবত সাড়ে ১১টার দিকে- একেবারে ঠিক মনে নেই। ভারতীয় লোকসভায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। 

ভারতের স্বীকৃতি আসা মাত্রই যেন বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তখনও বরিশালে উপস্থিত। কিন্তু সে সবকিছু বিস্মৃত হয়ে সারা পাড়া যেন ফেটে পড়লো। নানান বাড়ী থেকে আনন্দধ্বনি, ঘটি-বাটির আওয়াজ, ‘জয়বাংলা’ চিৎকার সারা পাড়াকে নাড়িয়ে দিল। ঘর-বাড়ী থেকে বেরিয়ে লোকজন রাস্তায় নেমে এলো। মানুষ পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে, চোখ সবার অশ্রুসজল, একে অন্যকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছ। মনে হলো- সব শৃঙ্খল ভেঙ্গে আমরা সবাই একটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছি- অবরোধের খাঁচা, আতঙ্কের খাঁচা, অনিশ্চয়তার খাঁচা।

কতক্ষণ বাদে পাশের বাড়ীর লতু’দি হুড়মুড় করে আমাদের বাড়ীতে ঢুকলো। হাতে ওর ঝক ঝকে এক কাঁসার থালা। তাতে গোল করে সাজানো এক সারি নারকোলের সন্দেশ। সোজা সে চলে গেল বাবার ঘরে। ওর চেঁচামেচি আর ডাকা ডাকিতে আমরা সবাই জড়ো হলাম সেখানে। লতু’দি সজল চোখে সন্দেশ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমাদের সবাইকে খাওয়ালো। আমরাও ওর মুখে সন্দেশের টুকরো পুরে দিলাম। আমাদের কারও চোখই শুকনো ছিল না।

সবকিছুর শেষে লতুদি গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করলো মা’কে আর বাবাকে। মা লতু’দিকে জড়িয়ে ধরলেন পরম মমতায়। বাবা লতু’দির কপালে বড় নরম করে চুমু দিলেন। আমরা কাঁসার থালার সন্দেশ কাড়াকাড়ি করতে করতে হৈ হৈ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

বেরিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, মা বড় মায়াময়ভাবে বাবাক জড়িয়ে ধরেছেন। সে কি বাবাকে আগে বকার জন্যে, নাকি অন্য কোনও কারণে, কে জানে? কিন্তু এটা জানি যে, আমাদের জীবনে আমাদের মা-বাবাকে আর কখনও অমন অন্তরঙ্গভাবে আর কখনও দেখিনি। 

আজ বহুকাল পরে ভাবি- সেদিনের সে আলিঙ্গন, সেও তো এক স্বীকৃতি বটে- একটি ভালোবাসার সম্পর্কের স্বীকৃতি। 

এনএস/