ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মিজানুর রহমান খানের তিন ফ্ল্যাট!

কার্ত্তিক চন্দ্র দাস

প্রকাশিত : ০৮:২৪ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ১১:২৪ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান (১৯৬৭–২০২১)

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান (১৯৬৭–২০২১)

বন্ধুবর মনির ভাইর সাথে ১৬ বছর আগে ঢাকায় এসেছি। প্রথমে তাঁর আরামবাগের মেসে উঠলাম। একদিন পরে মসিউরের সাথে দাদার কাকরাইলের বাসায় (আমরা সবাই মিজান ভাইকে দাদা বলে সম্বোধন করতাম) দেখা করতে গেলাম। মিজান ভাই তখন বাসায় ছিলেন না। ভাবি জানতে চাইলেন কি জন্য ঢাকায় আসা। আমি বললাম- জীবিকার জন্য। ভাবির আবারও প্রশ্ন; কিসে চাকুরি করতে চাই? আমি দ্রুত উত্তর দিলাম, সংবাদপত্রে। আমি ছোটবেলা থেকে মোহামেডান এর পাগলা ভক্ত! নিজে নিজে ফটো সাংবাদিক হতে চেয়েছি। কারণ স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে পারব তাই। ভাবি খুব বিরক্তি নিয়ে বললেন, মিডিয়ায় চাকরি করিও না!

আমি বললাম কেন? তিনি বললেন- তোমার দাদাকে দেখেও বুঝনা? সে তো কিছুদিনের মধ্যে পাগল হয়ে যাবে। এটা কেমন চাকুরি! দাদা তখন যুগান্তর পত্রিকায় ছিলেন। আমি বললাম এই শহরে আমি কিছুই চিনিনা! ভাবি বললেন, তোমার চিনতে হবেনা। মসিউর-সিদ্দিক-আনিস আছে ওরা তোমাকে চিনিয়ে দিবে। তার মানে ধ্যানি মিজানুর রহমান খানের সাংবাদিকতার তপস্যায় ভাবি তাকে সংসারে ঠিক মত পাচ্ছিলেন না! সেই ১৬ বছর আগে থেকেই! কয়েক দিন পরে মিজান ভাইর আব্বা মারা গেলেন। আমি বললাম, দাদা একটা গাড়ি ভাড়া করুন। সে আমার কাছে জানতে চাইলেন- গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে কোনখানে গেলে!  

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! এত বড় সাংবাদিক অথচ এটা জানেন না! আমি নিরুত্তর, কারণ সবেমাত্র ঢাকা এসেছি। তিনি আমাকে তার বাসায় রেখে লঞ্চে উঠলেন। দাদার লেখার সাথে পরিচিত হই যখন তিনি সাপ্তাহিক রোববারে লেখা দিতেন। আমি, মসি ইত্তেফাকে রোববারের বিজ্ঞাপন দেখে কপি সংগ্রহ করার চেষ্টা করতাম। বিজ্ঞাপন- এ লেখকদের নাম লেখা থাকত। সেখানে মিজান ভাইর নাম দেখেই মহা আনন্দ অনুভব করতাম। ভালো লাগা, ভালবাসা সেই থেকেই। পারিবারিক প্রোগ্রাম ছাড়া দাদার সাথে খুব একটা দেখা হতোনা। ২০১৮ সালে ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়ে বসুন্ধরা সিটি থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বললো সেখানে আসতে। আসার পর নিজ থেকে ফতুয়া পছন্দ করে দিলেন। আমি বার বার না করলাম। আমাকে বললো আমি তোমার বড় ভাই না? অগত্যা চুপ হয়ে গেলাম, আমি বললাম ফতুয়া আমার ব্যবহার করা হবেনা তারচেয়ে একটা প্যান্ট নিলে কাজে দিবে। দাদা এতে বেশি খুশি হলেন। তিনি আমাকে ফ্যামেলি ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। এটা আমাকে অনেক অনেক হ্যাপি করেছে তারথেকেও বেশি ঋণি করে গিয়েছেন। 

দাদার সঙ্গে শেষ সাক্ষাত হয় গত আগস্ট মাসে। আমি তার গাড়িতে করে বাড়িতে গেলাম। দাদার সঙ্গে অসুস্থ হওয়ার ৫ দিন আগে গত ৩০ নভেম্বর শেষ কথা হয়। ডিআরইউ নির্বাচনে মসিউর জয়ী হওয়ায় তাকে বেশ খুশি মনে হচ্ছিল। তিনি কথা শেষ করেছেন এই বলে যে, মসিউরকে বলবে এই সম্মান ধরে রাখা কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জিং। দাদার বাল্য বন্ধু বিশ্বজিৎ দাস তার বাসায় যাওয়ার পরে তার সরলতা দেখেছি। ১৮ থেকে ২০ বছর পর বন্ধুর সঙ্গে দেখা। স্কুল-কলেজ জীবনে একসঙ্গে ঘুরতেন, ঘুমাতেন। তাকে পেয়ে টেনে বেড় রুমে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকটা শিশুসুলভ। এত সরল মানুষ খুব কম দেখা যায়। অথচ পেশাগত স্থানে তিনি দেবতুল্য।

যিনি শুধু নিজের দেশের সংবিধান নয়, বিশ্বের ১০ থেকে ১৫টি দেশের সংবিধান নিয়ে তার গবেষণা ছিলো। বি এম কলেজ থেকে তিনি হিসাব বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন- অথচ লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করা অনেক আইনজীবী তার কাছ থেকে বিভিন্ন রেফারেন্স জেনে নিতেন।

মিজানদা বলতেন, আমার তিনটা ফ্ল্যাট আছে- একটা গুলশান, একটা বনানী আর একটা উত্তরা। এই তিন নাম হচ্ছে তাঁর সন্তান- সাদমান, তাসনিম ও আনান। এই সন্তানদের নিয়ে তার খুব গর্ব ও ভাল লাগা ছিল। আমি বিশ্বাস করি এরা তার বাবা'কে ছাড়িয়ে যাবে। দাদা - আপনি অনেকের সাথে আমাকেও একাধিক বার কাঁদিয়েছেন। আপনার সাথে আমার রক্তের বন্ধন নেই এটা সত্য। তবে আত্মার বন্ধন ছিলো। এটা আছে, থাকবে। আপনার রেখে যাওয়া সন্তানদের সাথে থাকবো, কথা দিচ্ছি।

এসি