ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যে কারণে বাড়ছে নবজাতক ফেলে দেয়ার ঘটনা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:৫৮ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ৬ বছরে ২১০টি নবজাতককে পরিত্যক্ত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে গত ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই উদ্ধার করা হয়েছে ২০টি নবজাতকের মরদেহ। সম্প্রতি এমনই এক পরিসংখ্যানমূলক তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম।

মূলত দেশের শীর্ষ ১৫টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তারা এই তথ্য দিয়েছে। এসব ঘটনায় পুলিশ সাধারণ ডায়রির (জিডি) পাশাপাশি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠালেও এখন পর্যন্ত সুরাহা মেলেনি কোনও ঘটনার।

ময়লার ভাগাড়ে, নালা-নর্দমায়, ব্যাগে বন্দি অবস্থায় রাস্তার পাশে, ঝোপঝাড়, যানবাহন, শৌচাগার থেকে উদ্ধার হওয়া এসব নবজাতকের বেশিরভাগই গুরুতর আহত, নাহয় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। যেসব শিশু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাদের স্থান হয় নিঃসন্তান কোনও দম্পতির পরিবারে, নাহয় সরকারি শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে।

এমনই একটি ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ। এদিন মিরপুর এলাকার রাস্তার পাশে এমনই এক শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পান পেশায় শিক্ষিকা নাফিসা ইসলাম অনন্যা। তারপর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে মৃতপ্রায় শিশুটিকে টানা কয়েকমাসের চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলেন তিনি। পুলিশকে জানানোর ভিত্তিতে বর্তমানে তিনি শিশুটিকে একটি নিঃসন্তান দম্পতির কাছে দিয়েছেন এবং নিয়মিত খোঁজ রাখছেন। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে শিক্ষিকা নাফিসা ইসলাম বলেন, "আমি মিরপুরের রাস্তাটা ধরে রাতের বেলা হেঁটে যাওয়ার সময়ই বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাই। পরে দেখি রাস্তার পাশে কাপড়ে মোড়ানো ছোট একটা বাচ্চা। আমি কতক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করি। দেখি যে, কেউ নেই। পরে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়ার পর বুঝলাম- সে শ্বাস নিতে পারছে না।"

শিক্ষিকা অনন্যা আরও বলেন, "শিশুটির অবস্থা দেখে কোনও হাসপাতালই শুরুতে তাকে ভর্তি করতে চায়নি। পরে অনেক অনুরোধ করে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলি আমি। এখন সে একটা নিঃসন্তান পরিবারে অনেক যত্নে আছে।"

সবার কাছে অনুরোধের সুরে তিনি বলেন, "তো, যারা তাদের বাচ্চাকাচ্চা রাখতে চান না, তারা যদি সুস্থ অবস্থায় বাচ্চাটাকে হাসপাতালে রেখে যায়, মসজিদের সামনে রেখে যায়, কেউ না কেউ তাদের বাঁচাবে। একটা বাচ্চাকে তো তারা মেরে ফেলতে পারে না!"

সাধারণত এসব শিশুকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় উদ্ধারের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের কাছে শিশুর নমুনা পাঠানো হয়। সেই নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে শিশুটির প্রোফাইল তৈরি করেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।

যদি কেউ শিশুর মা অথবা বাবা হিসেবে পরিচয় দাবি করে, তাহলে তাদের সাথে সেই শিশুর ডিএনএ প্রোফাইল মেলানোর মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করা হয়। কিন্তু এই শিশুদের অধিকাংশকে স্বেচ্ছায় ফেলে যায় তাদের বাবা-মা। এজন্য এর তদন্ত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান সিআইডির পুলিশ সুপার রুমানা আক্তার।

এছাড়া বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশের সব মানুষের যদি ডিএনএ ডাটাবেজ থাকতো, তাহলে সহজেই শিশুর ডিএনএ ওই ডাটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে মা-বাবাকে শনাক্ত করা যেতো বলে জানিয়েছেন তিনি।

পুলিশ সুপার রুমানা বলেন, "আমাদের যে ডিএনএ ব্যাংক আছে সেখানে শুধুমাত্র অপরাধীদের প্রোফাইল করা আছে। যেটার পরিসর অনেক সীমিত। যদি এই ডাটাবেজে বাংলাদেশের সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতো, তাহলে মুহূর্তেই বেরিয়ে আসতো এই শিশুর বাবা-মা কে।"

কিন্তু কেন হচ্ছে এমন পরিণতি?
সাধারণত বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামী পরিত্যক্ত কিংবা ধর্ষণ থেকে জন্মানো শিশুগুলোর ক্ষেত্রেই এমন পরিণতি বেশি হচ্ছে বলে জানান অপরাধ বিজ্ঞানীরা। এছাড়া ছেলে শিশু প্রত্যাশা করার পর মেয়ে শিশু জন্মানোর কারণেও অনেক পরিবার শিশুদের রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে বলে তারা জানান।

অপরাধবিজ্ঞানী ফারজানা রহমান বলেন, বাংলাদেশে সরকারিভাবে এসব শিশুর আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও সচেতনতার অভাবে বা পরিচয় ফাঁস হয়ে সামাজিকভাবে হয়রানির মুখে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে বেশিরভাগই কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। এমন অবস্থায় পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিকতার শিক্ষা দৃঢ় করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

ফারজানা রহমান বলেন, "আমাদের সামাজিক কাঠামোতে অনেক বড় ধরণের প্রভাব পড়েছে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে গেছে, বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে, প্রযুক্তির অনেক বড় একটা প্রভাব আছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা জন্ম নিরোধ বিষয়ে সচেতনতার অভাবও একটা বড় কারণ। এছাড়া এই শিশুদের যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশ্রয় দেয়া যায়, সেটা জানা না থাকার কারণেও অনেকে এসবের দিকে ঝুঁকছে।"

বাংলাদেশের আইনানুযায়ী, কোনও শিশু মাতৃগর্ভে ৪ মাস পার করলে শিশুটি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য হয়। এবং জন্ম হওয়ার আগে তার নামে সম্পত্তিও লিখে দেয়া যায়। তাই এই শিশুগুলোকে কারা ফেলে গেছে সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বলে মনে করছেন অপরাধবিজ্ঞানীরা।

যেসব শিশু ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরছে তাদের বেশিরভাগই পরবর্তীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছে। যেমনটি হয়েছে মিরপুরে ওই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটির ক্ষেত্রে।

শিশুটিকে উদ্ধারের পর থেকে নাফিসা অনন্যার একটাই আশা যে- তিনি ভবিষ্যতে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবেন, যেখানে যেসব বাবা-মায়েরা তাদের সন্তান রাখতে চান না, তারা নাম পরিচয় গোপন রেখে অন্য কোনও নিঃসন্তান পরিবারকে তাদের সন্তানকে দিতে পারবেন। সূত্র- বিবিসি।

এনএস/