ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

সন্দ্বীপে ক্রিকেট উৎসব এবং বদলে যাওয়া সন্দ্বীপ-৩ 

কানাই চক্রবর্তী 

প্রকাশিত : ০৯:২১ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ১০:০০ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

গোধূলি লগ্নে সন্দ্বীপের চর পরিদর্শনে লেখকের পরিবার

গোধূলি লগ্নে সন্দ্বীপের চর পরিদর্শনে লেখকের পরিবার

আপনি যদি খুব বেশি খাওয়া দাওয়া করেন তাহলে কিন্তু উগরে দেয়ার সম্ভবনা থাকে। আকন্ঠ নিমজ্জিত হলেও একই অবস্থা হতে পারে। অনেকে তাই করেন। সন্দ্বীপের চারপাশে এত জেগে উঠা ভূমি দেখে মনে হতেই পারে, নদী বা সাগর বা সমুদ্রেরও কি তাই হয়েছে? দীর্ঘদিন গো গ্রাসে গিলেছে। সাম্যবাদী মনস্ক সমুদ্র অবশ্য সবার প্রতি সমান আচরণ করেছে। ধনী দরিদ্র ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার বাড়ি ঘর জমি খেয়ে, অসংখ্য মানুষ পরিবারকে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তার সীমানাকে বিস্তৃত করেছে। কাল যিনি আমির ছিলেন, এক নিমিশে তাদেরকে পথের ফকির বানিয়ে ছেড়েছে। এই আগ্রাসী স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ নি:স্ব মানুষের চোখের জলও বাধা হতে পারেনি। তাই প্রশ্নটি আসা স্বাভাবিক শেষ পর্যন্ত এত বেশি খাওয়ার পর কি সব আবার উগরে দিয়েছে?

               নতুন চরে লেখকের শুভাকাঙ্ক্ষীরা 

অন্যভাবে চিন্তা করলে এ প্রশ্নটিও আসে, নাকি সমুদ্রের মধ্যে এমন কোন অনুতাপ, অনুশোচনা কিংবা অপরাধবোধ জন্মেছিল, যার ফলাফল পেটের মধ্যে জমা থাকা সব ভূমি পত্রপাঠ ফেরত দিয়েছে। এঘটনাকে সমুদ্রের দয়াও মনে হতে পারে। কেউ বলতে পারেন সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা। এটাতেও আমার আপত্তি নেই। সবই চিন্তার অধিকার। আসল কথা হলো, সন্দ্বীপের চারদিকেই বিশাল ভূমি জেগে উঠেছে। এই জেগে উঠা ভূমি সন্দ্বীপকে বদলে দিয়েছে এবং আরো বদলে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগের লেখায় আমি বলেছিলাম সন্দ্বীপে উন্নয়ন ও বদলে যাওয়ার সাথে প্রকৃতিরও যোগ আছে। এই প্রকৃতিই হচ্ছে আমার কাছে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা। তিনিই এই বিশাল ভূমি সন্দ্বীপকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এর আগে সন্দ্বীপের আশে পাশে আরো ভূমি জেগে উঠেছিল। যেমন ভাসান চর, জাহাজ্যার চর বা স্বর্ণদ্বীপ। সেগুলো ধরে রাখার জন্য আমরা বিশেষ ক্যারিসমা দেখাতে পারিনি। আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবে সেই ভূমিগুলো ছিল সন্দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন। নতুন করে জেগে উঠা ভূমি সন্দ্বীপের মূল ভূখন্ড লাগোয়া। সেই কারণে এসব জমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা কম। তবে পূর্বের ব্যক্তিমালিকের হাতছাড়া হয়ে ভূমিখোরদের কবজায় চলে যাওয়ার আশংকা কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায়না।

সাগর থেকে জেগে ওঠা চর পরিদর্শনে সাংবাদিক কানাই চক্রবর্তী 

আসলে সন্দ্বীপে নতুন করে প্রাণস্পন্দন শুরু হয়েছে মূলত দুটি কারণে। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে আসা দিবা রাত্র বিদ্যুৎ এবং চার পাশে জেগে উঠা জমি (আমি চর বলার বিপক্ষে)। যারা এর আগে ভিটা মাটি হারিয়েছেন, তারা আবার নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন এই ভূমিকে কেন্দ্র করে। আর যেহেতু সন্দ্বীপ ভাঙ্গছেনা, তাই মানুষের মধ্যেও স্থায়ীভাবে বসবাসের আস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙ্গনের ভয়ে যারা এতদিন পাকা বসতবাড়ি তৈরী করেন নি, তারাও এখন নবোদ্যমে তা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। একদিন ভেঙ্গে যাবে, চলে যেতে হবে চট্টগ্রাম বা অন্য কোথাও, যারা এ চিন্তা করেছিলেন, তারাও এখন থীতু হয়ে যাচ্ছেন। একজন জানিয়েছেন, একারণে সীতাকুণ্ড এবং হালিশহরে বর্তমানে জমির দাম একেবারেই কমে গেছে। এতে স্পষ্ট বিদ্যুৎ এবং চারদিকে জেগে উঠা ভূমি সন্দ্বীপের জন্য কি রকম আর্শীবাদ হয়েছে। একটি প্রাকৃতিক এবং অন্যটি মনুষ্যসৃষ্টির যোগফলে সন্দ্বীপে এখন আরো বদলে যাচ্ছে এবং যাবে।

তবে আরো বদলে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ কিন্তু ছোট খাট নয়। সন্দ্বীপের মূল ভূখন্ডের পরিমাণ খুবই কম। এমনিতেই এখন ঘনবসতি। কৃষি জমি কমতে কমতে চাষবাস এখন তেমন নেই বললেই চলে। সন্দ্বীপের মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য ফলমূল সবজি থেকে শুরু করে চাল ডাল তেল নুন সবই বাইরের থেকে আনতে হয়। এখনো রিসোর্স বলতে কিছু নেই। পোলট্রি এবং মাছচাষ একটু হলেও এত মানুষের চাহিদা পূরণ একভাগও  হচ্ছেনা। এখন বিদ্যুৎ এবং জেগে উঠা ভূমি একটা সম্ভবনা হলেও এখানেও জটিলতা আছে।

সন্দ্বীপে নতুন চর

প্রথমত এসব ভূমি কবে বসবাসযোগ্য হতে পারে তার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। সঠিকভাবে কেউ জানেনও না। যে যার মত করে ভাবনা চিন্তা করে এবং বলেন। ভূমির পরিমাণ নিয়েও কোন তথ্য নেই। সন্দ্বীপে কী ভূমি অফিস আছে? এ সংক্রান্ত যে মন্ত্রণালয় আছে তাদের কি জেগে উঠা এ জমি নিয়ে কোন পরিকল্পনা আছে? তা জানা দরকার। আর বসবাসযোগ্য হলেও এসব জমিতে ব্যাক্তি মালিকানা আছে। ইতিমধ্যেই জেগে উঠা এ ভূমি নিয়ে আগে যারা এসব জায়গায় বসবাস করতেন তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে। এখানে আবার অনেকে বাড়িঘর বানানোর জন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। অনেকটা গাড়ির আগে ঘোড়া অথবা ঘোড়ার আগে গাড়ির মত। এটাও নিশ্চিত তারা নিশ্চয় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন। সন্দ্বীপে অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কথা শুনা যাচ্ছে। সেটা কবে এবং কোথায় হবে তা নিয়ে পরিষ্কার কোন পরিকল্পনার কথা আমার জানা নেই। শুনেছি সন্দ্বীপের উত্তরে সন্তোষপুর ইউনিয়ন বরাবর হবে। তবে এটা কি সন্দ্বীপের মূল ভূমিতে হবে, না জেগে উঠা ভূমিতে হবে, তা জানার সুযোগও আমার হয়নি। জেগে উঠা ভূমি হলে সেখানেও আগের মালিকরা নিশ্চয় দাবি করবেন।

সন্দ্বীপকে পর্যটন কেন্দ্র বানানোর কথাও অনেকে বলেন। বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা একটা সহনশীল পর্যায়ে আসায় এ ভাবনা তৈরী হয়েছে। এ ভাবনার সাথেও ভূমির বিষয় আছে। পর্যটন নগরী হিসেবে যোগ্যভাবে গড়ে তুলতে হলে ভালো মানের হোটেল এবং রিসোর্ট বানাতে হবে। এর জন্যও প্রয়োজন ভূমি। এগুলো তৈরীর জন্য জমি কোথায় পাওয়া যাবে?

আমার মনে হয়, জেগে ওঠা ভূমি নিয়ে ভবিষ্যতে যে জটিলতার র্সষ্টি হতে পারে তার জন্য এখনই একটা সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহন প্রয়োজন। দরকার হলে এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। আরো আগে এসব জমিকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। অনেকে ব্লক বেরিবাঁধের পরে প্রায় নদীর কিনার ঘেঁষে নুনা বেরিবাঁধ নির্মাণের কথা বলেছেন। এতে কোন সুফল আসবে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। 

সন্দ্বীপের স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য সবাইকে এ নিয়ে এখন থেকে ভাবনা শুরু করতে হবে। চার দিকে জেগে উঠা জমি নিয়ে আরো উন্নয়নে এবং স্বাবলম্বি ও আত্মনির্ভলশীল সন্দ্বীপ গড়ে তোলার যে সম্ভবনা দেখা দিয়েছে তা চ্যালেঞ্জ নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। না হলে সব স্বপ্নই ফিকে হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, এ চ্যালেঞ্জটা যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ কিংবা ব্লক বেরিবাঁধ নির্মাণের চেয়েও কম নয়। আর এ চ্যালেঞ্জ কিন্তু মোকাবেলা করতে হবে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিকে, বিশেষ করে সন্দ্বীপ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতাকে। যিনি এর আগে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে বিদ্যুৎ এনে সন্দ্বীপকে আলোকিত করেছেন এবং সন্দ্বীপবাসিকে প্রতিনিয়ত উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

লেখক: উপ-প্রধান প্রতিবেদক, বাসস।