ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কাশির শিষ্টাচার 

ডা. নুজহাত চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৫:১৬ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৫:২২ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী। ‘কাশির শিষ্টাচার’ শিরোনামে তার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম অনলাইন সংবাদ পোর্টালে (১৫ মার্চ ২০২০)। সময়োপযোগী এ নিবন্ধের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো—

নভেল করোনাভাইরাস মানুষের আচরণের ত্রুটিগুলো স্পষ্ট করে সামনে নিয়ে এসেছে। মানুষের কিছু আচরণ যা তাকে সভ্য ও সামাজিক জীবনে সহনীয় করে তোলে, সেই আচরণগুলোর ঘাটতি আজ আমাদের এক ভয়াবহ মহামারির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কীভাবে হাত ধুতে হয়, কীভাবে কাশি দিতে হয়, কীভাবে জীবাণু ছড়ায় তার পদ্ধতি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এই লেখা সেটা নিয়ে নয়। এই লেখা আমাদের দেশে সামাজিক জীবনে স্বাভাবিক শিষ্টাচারের অভাবের প্রকটতা নিয়ে।

বলছি ব্যক্তিগত ও সামাজিক শিষ্টাচারের কথা। বিশ্বের অনেক দেশে এগুলো প্রাইমারি স্কুলে শেখানো হয়। খাবার টেবিলের কিছু আচরণ যাকে টেবিল ম্যানার্স বলে, শৌচাগার ব্যবহারের ভব্যতা, সামাজিক পরিবেশে হাঁচি-কাশির কিছু ভদ্রতা, যেখানে প্রয়োজন সেখানে ‘ধন্যবাদ’ অথবা ‘স্যরি’ বা ‘দুঃখিত’ অথবা ‘এক্সকিউজ মি’ বা ‘কিছু মনে করবেন না’ বলা, শিশু-বৃদ্ধ-নারীদের প্রতি যত্নশীল আচরণ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে এই ভদ্রতার শিক্ষাগুলোর মারাত্মক ঘাটতি আছে। না পরিবারে, না শিক্ষাক্ষেত্রে কোথাও এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় না। আমরা যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলি, কফ-থুতু-পানের পিক যত্রতত্র ফেলা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমি এমন করতে দেখলেই আমার চাকরিক্ষেত্রে প্রতিবাদ করি এবং বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আপনার থুতুতে যে জীবাণু আছে তা আশেপাশের মানুষের ক্ষতির কারণ হবে। খুব কম ক্ষেত্রেই আমি কাউকে দুঃখিত হতে দেখি। বরং তারা অবাক হয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকান যেন আমি শুধু শুধুই গায়ে পড়ে ঝগড়া করছি। আবার অনেকে উল্টো তেড়ে আসেন। একবার একজন জিজ্ঞেস করল, ‘থুতু এলে কী করব? গিলে ফেলব?’ কী অদ্ভুত! সেটাও বলে দিতে হবে। সামনে আসছে রোজার মাস। এই থুতু ফেলার বিষয়টা আরো বাড়বে। কেন এমন করেন তারা, কোন শিক্ষায়—আমার জানা নেই।

ডা. নুজহাত চৌধুরী

এই মারমুখী, কিছুতেই ভালো কিছু শিখব না, নিজের ভুল মানব না—এ ধরনের আচরণ আমাদের মধ্যে খুব বেশি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বিমানগুলোর টয়লেটের দুরাবস্থা যারা দেখেছেন, তারা জানেন আমাদের দেশবাসীর শৌচাগার ব্যবহারের শিষ্টাচারের কী অভাব! আপনি শৌচাগার ব্যবহারের পরে এমনভাবে রেখে আসবেন যেন আপনার পরবর্তী ব্যক্তি আপনার ওপর বিরক্ত না হয়। এ-ক্ষেত্রে তারা প্রান্তিক মানুষ, এই যুক্তি আমি মনে করি না সমর্থনযোগ্য।

সামাজিক শিষ্টাচারের শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক করার দাবি করছি। জাপানে প্রথম কয়েকটি বছর শিশুদের মানবিক ও সামাজিক আচরণের শিক্ষা দেয়া হয় বলে শুনেছি। আমাদের দেশে মানবিক শিক্ষা দেয়ার আলাদা কোনো সিলেবাস নেই। আর সামাজিক আচরণের শিক্ষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাও আমাদের মাথায় আসে নি বলেই প্রতীয়মান হয়।

নারীকে সম্মান জানিয়ে বাসের সিটটি ছেড়ে দেয়া, বৃদ্ধদের হাত থেকে ভারী বোঝাটি নিয়ে তাকে এগিয়ে দেয়া, অন্ধকে রাস্তা পার হতে সহায়তা করা—এ ধরনের সামাজিক সভ্যতা আমরা কোনো বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে কীভাবে বাচ্চাদের পড়াতে পারি তা ভেবে দেখতে হবে। না হলে আমরা সামাজিক জীবনে সেই অভদ্রতা করে যাব, যা এখন করে চলেছি। নারীদের দেখলে সিটি মারা, গর্ভবতী নারীকে ধাক্কা মেরে লাইন ভেঙে বাসে উঠে পড়া, বৃদ্ধদের অসম্মান করা, পুরুষ হয়ে নারীদের সিটে বসে যাওয়া আর কেউ কিছু বললে সম-অধিকার নিয়ে মুখ খিঁচড়ে যুক্তিহীন কুতর্ক করা— এসব সামাজিক শিষ্টাচারবিরোধী ব্যবহার আমাদের দেশে সাধারণ ঘটনা।

এমন নিম্নবর্গের অসামাজিক প্রাণী থেকে মানবিক বোধসম্পন্ন রুচিশীল মানুষ হিসেবে জাতিগতভাবে আমরা যদি উন্নত হতে চাই, তবে প্রাইমারি লেভেলের শিক্ষার সিলেবাসে সুচিন্তিতভাবে এই বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চলুন না, আমাদের

পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের চেয়ে রুচিশীল মানবিক সভ্য মানুষ করে গড়ে তুলি। আচরণের সভ্যতা দেখলেই আমরা ধরে নিই তিনি ভালো পরিবার থেকে এসেছেন, ভালো শিক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু তা-ও যেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ। দুঃখ মনে নিয়েই স্মরণ করছি, আমার এক শিক্ষিকা ছিলেন যিনি ক্লাস নিতে নিতে অনবরত নাক খুঁটতেন। বিভীষিকার মতো এই স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে রয়ে গেছে কারণ, আমি তার ঐ আচরণের জন্য ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারতাম না। আমার খালি ভয় হতো, কখন তিনি আমার বেঞ্চের সামনে চলে আসবেন, আর আমার বেঞ্চটা ছুঁয়ে দেবেন ঐ হাত দিয়েই। ভাবতে আমার এখনো গা গুলিয়ে আসে।

ভাবুন তো, আপনার কোনো আচরণের জন্যে যদি আপনাকে এভাবে কেউ মনে রাখে! কী দুঃখজনক, তাই না? তেমনি, অনেক শিক্ষিত মানুষ, বড় বড় অফিসার আমি দেখেছি যারা মুখের ওপর কাশি দেন। করোনাভাইরাসের কারণে এই ব্যাপারটা খুব আলোচিত হচ্ছে। সরকারি ব্রিফিং-এ কাশির শিষ্টাচার বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। ‘কাশির শিষ্টাচার’ এই কথাটি আমার খুব ভালো লেগেছে। আসলেই কাশির শিষ্টাচার আমাদের দেশে বিরাট বড় একটি সামাজিক প্রয়োজন।

শুধু এখন এই করোনা মহামারি প্রতিরোধেই নয়, অন্য মানুষকে সম্মান করে তার পরিচ্ছন্নতার বাধ যেন আমি না হই, আমার আচরণের জন্যে অন্য মানুষ যেন রোগাক্রান্ত না হন, আমি যেন কারো বিরক্তির কারণ না হই—এ রকম দায়িত্বশীলতার সাথে ভাবাটাই সভ্যতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচার। এটা যেন সবাই হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করে তার জন্যেও ‘কাশির শিষ্টাচার’-এর কথা বার বার বলা দরকার ও অভ্যাস করা দরকার। করোনাভাইরাসের এই দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে থেকে বাংলাদেশিরা যদি ‘কাশির শিষ্টাচার’-টুকু অন্তত শেখে তো সেটাও অনেক বড় অর্জন হবে।

সেদিন বিদেশি এক চ্যানেল দেখছি। সেখানে একটি কলেজ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ছাত্রের সাক্ষাৎকার নিয়ে করোনাভাইরাসের মহামারির বিষয়ে তাদের মন্তব্য শুনছিলাম। মাস্ক পরা এক ছাত্র বলছিল, তার সবচেয়ে বড় চাওয়া, সে নিজে যেন অন্য কারো ক্ষতির কারণ না হয়। সে কারণেই সে মাস্ক পরেছে এবং অনেকেই এই মনোভাব ব্যক্ত করছিল। আমার খুব ভালো লেগেছে তাদের চিন্তার ধারাটি। আমরা নিজেদের মৃত্যুর ভীতিতে মাস্ক পরে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে ঘুরছি। আমার যেন কিছু না হয় এই শুধু আমাদের চিন্তা। আমাদের থেকে অন্য কারো যেন কিছু ক্ষতি না হয়, তা কিন্তু আমরা ভাবছি না। একবার যদি সকলে ভাবত, তবে রাস্তায় আর কেউ থুতু ফেলত না। তেমনিভাবে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ময়লা বর্জ্য ফেলত না। ভাবতেই অবাক লাগে, আমাদের অন্যদের বিষয়ে কোনো দায়িত্ববোধই নেই। এত স্বার্থপর হয়ে আমরা কত দিন ভালো থাকব? একা কি ভালো থাকা সম্ভব? কখনোই না।

খুব বড় একটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি সকলে। চলুন না, এর থেকে বড় একটি শিক্ষা নিয়ে নিজেদের পূর্বের চেয়ে উন্নত করে তুলি। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে এসেছে দেখে আমাদের টনক নড়েছে। এ-ছাড়াও আরো কত ভাইরাস আছে, জীবনসংহারী কত ব্যাকটেরিয়া আছে! আমাদের দায়িত্বজ্ঞান বিবর্জিত, স্বার্থপর, অপরিশীলিত, অসভ্য আচরণ আমাদের পুরো সমাজকে সর্বক্ষণই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। করোনার মহামারির মতো সবসময় তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান না হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তার ঝুঁকি কম কিছু নয় আমাদের নিজেদের জন্যে, অন্যদের জন্যে। চলুন, সবসময় সেই শিষ্টাচারের চর্চা করি, নিজেদের সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি।

লেখক- অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। 

আরকে//