ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

একজন পদার্থবিজ্ঞানী ও আমাদের গর্ব

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২১ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার | আপডেট: ০২:২৪ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার

জার্মানি ও চীন উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে ম্যাগলেভ বা উড়ন্ত ট্রেনের জন্যে মাইলপ্রতি ব্যয় ছিল ১২০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বিজ্ঞানী ড. আতাউল করিম উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে ম্যাগলেভ ট্রেনের প্রতি মাইলের খরচ মাত্র ১১ মিলিয়ন ডলার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী অ্যাপ্লাইড অপটিকস-এর মতে, গত অর্ধশতাব্দীতে বিশ্বে বিজ্ঞান গবেষণায় সর্বোচ্চ অবদান রাখা ৫০ জন বিজ্ঞানীর একজন।

বড় মানুষেরা কাউকে ছোট ভাবেন না 
১৯৭২ সাল। আমি কলেজে পড়ি। টাইম ম্যাগাজিনে সে-সময় একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেখানে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বয়স হিসাব করে দেখানো হয়েছিল। ওটা পড়ে আমার মনে হলো, মহাবিশ্বের সত্যিকার বয়স এর চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি। আমার বাবা, যিনি সবসময় ছিলেন আমার প্রেরণা, আমাকে উৎসাহ দিলেন খ্যাতনামা পদার্থবিজ্ঞানী ড. আবদুস সালামকে এ বিষয়ে চিঠি লিখতে। 

অধ্যাপক সালাম তখনো নোবেল পুরস্কার পান নি। আমি সেই নিবন্ধের আলোকে তাকে বিস্তারিত লিখলাম— কীভাবে আমি দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় করেছি। এ নিয়ে তার মতামত জানতে চাইলাম। তিনি চিঠিটি হস্তান্তর করেন বিশ্বখ্যাত একজন জার্মান জ্যোতির্বিদকে। সেই বিজ্ঞানী পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করে আমাকে দুপৃষ্ঠার একটি উত্তর লিখলেন। যা পড়ে আমি আমার হিসাব পদ্ধতির ত্রুটি বুঝতে পেরেছিলাম।

এ ঘটনা থেকে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেলাম। তা হলো, বড় মানুষেরা কাউকে উপেক্ষা করেন না। ছোট ভাবেন না। কারো মতামতকে অবহেলাও করেন না। একজন কলেজ শিক্ষার্থীর চিঠি বিজ্ঞানী সালাম ডাস্টবিনে ফেলে দিতে পারতেন। তিনি তা করেন নি; বরং তুলে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যিনি সবচেয়ে ভালো জানেন, তার হাতে। আরো শিখলাম, বড় মানুষেরা কোনো বিষয়ে না জানলে অকপটে স্বীকার করতে জানেন। 

এক আলোচনায় জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও ভাবনা তুলে ধরেন বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত পদার্থবিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথের নির্বাহী উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আতাউল করিম। আলাপচারিতার ভিত্তিতে এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখি 
ড. আতাউল করিম তার আলোচনায় বলেন, তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আমি ক্রমাগত নতুন চিন্তা ও উদ্যম পাই। জীবনে যা-কিছু শিখেছি, তার অধিকাংশই আমার শিক্ষার্থীদের কাছে। জীবনের অনেকটা সময় ধরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছি। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ আমার হয়েছে। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি মনে করি, নিজে গবেষণা করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো গবেষণার উপযুক্ত একটি পরিবেশ তৈরি করা। এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা এবং যোগ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারে।

একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে কোরিয়া, মালয়েশিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসত। এখন আমাদের দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী ওখানে পড়তে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো, আমাদের তুলনায় শিক্ষাখাতে তাদের বিনিয়োগ বেশি, তাদের আছে গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ। ফলে তারা এগিয়ে গেছে। 

চাই বড় লক্ষ্য
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তরুণদের সামনে বড় লক্ষ্য রাখতে হবে। 

আর আমাদের কাজ হলো, তাদেরকে বড় চ্যালেঞ্জ দেয়া। পাঁচ ফুট উচ্চতায় লাফ দিতে সক্ষম একটি প্রজন্মকে যদি দুই ফুট উঁচুতে লাফ দিতে শেখানো হয়, পরের প্রজন্ম এসেও তাদের অনুসরণ করবে এবং একসময় ভুলেই যাবে যে, তাদের সামর্থ্য আছে আরো উঁচুতে লাফ দেয়ার। তাই জীবনের লক্ষ্যকে সবসময় বড় করতে হবে। 

দেশ এগিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ
বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ করিম বলেন, আমাদের সাধারণ মানুষই আমাদের সবচেয়ে বড় আশাবাদের জায়গা। তারাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেশটাকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমি অনেক সম্ভাবনা দেখেছি। কিছুদিন আগে সিলেটে গিয়ে দেখেছি, একটি জমিতে কয়েক ধরনের ফসল চাষ হচ্ছে। সবমিলিয়ে আমাদের কৃষি গবেষণা এখন বিশ্বমানের। 

দেশে একদিকে আবাদী জমি কমছে, অন্যদিকে মানুষ বাড়ছে কিন্তু আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংস¤পূর্ণ। এর নেপথ্যে রয়েছে কৃষকের সৃজনশীলতা আর কৃষি গবেষকদের অসামান্য ত্যাগ। আমি বলতে পারি, এদেশের কৃষক উদ্ভাবনী দক্ষতায় মার্কিন কৃষকের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ
অধ্যাপক আতাউল করিম বলেন, আজকের মার্কিন শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি করবে সেগুলোর অধিকাংশের ধারণাই এখনো গড়ে ওঠে নি। সেখানে কী ধরনের সমস্যার সমাধান করতে হবে তা আমরা জানিই না। এই সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব বর্তাবে তখনকার কর্মজীবী অর্থাৎ আজকের তরুণদের ওপর। তাই সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি বাস্তব জ্ঞান খুবই জরুরি। একজন শিক্ষার্থীর ভালো রেজাল্টের অর্থ হলো, প্রস্তুতি ভালো থাকায় পরীক্ষার দিনে সুস্থ থেকে সে সঠিক উত্তর লিখতে পেরেছে। অসুস্থ থাকলে হয়তো এমনটা না-ও হতে পারত। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে আমাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। সেই কঠিন পরিবেশে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে আমি কতটা যোগ্য, সেটাই হবে আমার সঠিক মূল্যায়ন। তাই প্রতিনিয়ত শেখার মানসিকতা ভালো রেজাল্টের চেয়েও বেশি জরুরি এবং সে শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করছি কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গিয়ে আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি! সীমিত সামর্থ্য নিয়ে এখানকার গবেষকরা যেসব জিনিস তৈরি করেছেন, তা সত্যিই অকল্পনীয়। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের সামর্থ্য আছে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার।