ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আরও প্রণোদনার দাবি 

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ১০:১১ পিএম, ৩ মার্চ ২০২১ বুধবার

গত ২ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার হোটেল পূর্বাণীতে করোনা প্রেক্ষাপটে পোশাক শিল্পখাতে যে বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা পাবার লক্ষ্যে বিকেএমইএ’র সদস্যদের নিয়ে এক বিশেষ সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা-১০-এর সংসদ সদস্য এবং এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও টাস্কফোর্স ফর আরএমজি’র প্রধান শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএ’র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এবং বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি এসএম মান্নান কচি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিকেএমইএ সভাপতি এ.কে.এম সেলিম ওসমান।
 
প্রায় পাঁচশতাধিক শিল্প উদ্যোক্তাগণের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় নেতৃবৃন্দ ও অনেক শিল্প উদ্যোক্তাগণ বক্তব্য রাখেন। সভায় উঠে আসে বিগত কয়েকমাস ধরে করোনার বৈশিক প্রেক্ষাপটে ক্রেতারা (বায়ারগণ) তাদের রপ্তানি আদেশকৃত পণ্য নিতে পারছেন না। ফলে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাক স্টক হয়ে গেছে। অন্যদিকে সুতার লাগামহীন এবং অনির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধি, জাহাজের পণ্য পরিবহন ব্যয় প্রায় ২০০-৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি, প্রণোদনার বিপরীতে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যাংকের চাপ এবং অন্যদিকে কাস্টমস্, ভ্যাট, ট্যাক্স ও বন্ড কমিশনারেট সংক্রান্ত নানাবিধ অযৌক্তিক চাপের কারণে তৈরি পোশাক শিল্প ধারাবাহিকভাবে ২০২০ সাল থেকে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে চলছে। ফলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের নীতি সহায়তা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। উল্লেখ্য যে, এমনিতেই রপ্তানি আদেশ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, অনেক ক্ষুদ্র-মাঝারি প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছে। তার উপর উদ্যোক্তা এবং তার ব্যাংকের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ১৪-১৫ বছর করার ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কোনো আপত্তি না থাকলেও, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ০৮ বছরের অধিক কাউকে কিস্তি পরিশোধের সময় না দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণে অনেক উদ্যোক্তাই এখন ‘ক্লাসিফাইড’ হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই দীর্ঘমেয়াদী ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বৃদ্ধি করা না হলে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তৈরির পোশাক শিল্পখাতের অনেক উদ্যোক্তাই ‘ক্লাসিফাইড’ হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে; যা প্রকারান্তরে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। তাই সভায় উপস্থিত শিল্পোউদ্যোক্তগণ এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এবং একইসাথে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা কমপক্ষে ১৪-১৫ বছর করার জোর দাবি জানিয়েছেন। 

সভায় উপস্থিত উদ্যোক্তাবৃন্দ এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, আগামী সেপ্টেম্বর-এর আগ পর্যন্ত তৈরির পোশাক শিল্পখাতের চলমান অচলাবস্থার উন্নয়ন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তার উপর এ সময়ের মধ্যেই পবিত্র রমজান ও ঈদ-উল আযহা - দুটি ঈদ রয়েছে; যেখানে উক্ত সময়ের মধ্যে শ্রমিকদেরকে বেতন এর পাশাপাশি বোনাস ও অন্যান্য ভাতাদি প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০২০ সালে করোনা শুরুর সাথে সাথেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব বিবেচনায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ প্রদানের কারণে শিল্প উদ্যোক্তাগণ সেই সময়ে কারখানা চালু রেখে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং শ্রমিকদেরও বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতি এখনও ফিরে আসেনি। অথচ এর মধ্যেই ঐ লোনের কিস্তি পরিশোধের জন্য ব্যাংকের চাপের মুখে পড়েছে উদ্যোক্তাগণ। বাংলাদেশের মূল রপ্তানিবাজার ইউরোপে অর্থনীতি সংকোচনের মুখে পড়ায় এখনো পর্যন্ত রপ্তানি আদেশ সেই অর্থে বৃদ্ধি পায়নি। তাছাড়া যা কিছু রপ্তানি আদেশ হাতে রয়েছে তাও আবার সূতার অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্বির কারণে কার্যাদেশ সমূহ বাস্তবায়ন করতে পারছেনা। এ নিয়েও বক্তাগন ক্ষোভে ফেটে পরেন। তাই আসন্ন দুটি ঈদে শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঐ ধরনের আর একটি নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে শিল্প উদ্যোক্তাগণ। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে এই নতুন প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজ এবং পূর্বের প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজের পরিমাণ একীভূত করে উদ্যোক্তগণকে আরও একবছর সময় দিয়ে এর বিপরীতে ১৮ মাসের পরিবর্তে কমপক্ষে অন্তত: ৩৬ মাসের কিস্তি পরিশোধের সময় দিলে পোশাকখাত আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। অন্যথায় এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল পঁয়তাল্লিশ লক্ষ মানুষ এবং পরোক্ষভাবে দুই কোটি মানুষ ও তাদের পরিবারের জীবন ও জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। 

সভায় নগদ সহায়তা প্রাপ্তিতে জটিলতার বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অনেক শিল্প উদ্যোক্তা। সাধারণ বোধগম্যতা অনুযায়ী রপ্তানির পরে তার বিপরীতে প্রত্যাবাসিত মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আসার সাথে সাথে নগদ সহায়তার টাকা উদ্যোক্তাগণের ব্যাংক হিসাবে চলে আসা উচিৎ। অথচ তা না করে তৃতীয় পক্ষের একটি অডিট সিস্টেম চালু থাকার কারণে এই নগদ সহায়তার অর্থ শিল্পোদ্যোক্তাগণ সময়মত পাচ্ছেন না। উপরন্ত বিভিন্ন পক্ষ দ্বারা প্রতিনিয়ত নানাবিধ হয়রানীর স্বীকার হচ্ছেন রপ্তানিকারকগন। ফলে নগদ সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের মূল ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল-এর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এমনিতেই করোনাকালীন সময়ে শিল্প মালিকরা লভ্যাংশের কথা চিন্তা না করে এবং অনেকেই আবার ব্যক্তিগত মূলধন খাটিয়ে কারখানা চালিয়ে রেখেছে। সেই সময় নগদ সহায়তার অর্থ পেতে যদি এত জটিলতর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়, তবে সেক্ষেত্রে শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই, সামনের এই কঠিন সময়কে পাড়ি দিতে শিল্প উদ্যোক্তাগণ অডিট ব্যতিরেকে রপ্তানির বিপরীতে সরাসরি প্রত্যাবাসিত মূল্যেও উপর নগদ সহায়তার অর্থ উদ্যোক্তাগণের ব্যাংক হিসাবায়নে দিয়ে দেয়ার জোর দাবি জানান। 

বিকেএমইএ’র অধিকাংশ সদস্যই শতভাগ স্থানীয় কাঁচামাল দ্বারা তৈরী পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে থাকে যাদের মূল্য সংযোজনও শতভাগ। সরকার এবং আমরা এটাকে উৎসাহিত করে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি গাইড লাইন’ এর বাস্তব বিবর্জিত একটি ধারার উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ঐ সকল প্রতিষ্ঠানকে বন্ড লাইসেন্স করতে বাধ্য করছে, অন্যথায় তাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসি করা বন্ধ করে দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন বক্তাগন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাছাড়া এ বিষয়টি নিয়ে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তর কর্তৃক অন্যায়ভাবে হয়রানীর আশংকাও ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।

এছাড়াও সভায় সুতার মূল্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে বিকেএমইএ, বিজিএমইএ ও বিটিএমএ’র সাথে যৌথভাবে আলোচনা করে একটি কাঠামো নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা হয়। একইসাথে কাস্টমস্, ভ্যাট, ট্যাক্স ও বন্ড কমিশনারেট সংক্রান্ত এই শিল্পখাতে বিরাজমান সমস্যাগুলো নিরসনের জন্য টাস্কফোর্স ফর আরএমজি’র প্রধান শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন, এম.পি. মহোদয়ের নেতৃত্বে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া পরিবেশ বান্ধব শিল্প তৈরিতে কারখানায় স্থাপিত ইটিপি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় রাসানিক কাঁচামাল ডিউটি ফ্রি আমদানির সুযোগ দেয়ার জোড় দাবী জানান হয়। এ বিষয়েও ভবিষ্যতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করার অনুরোধ জানানো হয়। 

সভায় উপস্থিত উদ্যোক্তাগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময়ই শিল্পবান্ধব এবং তৈরি পোশাক শিল্পখাতকে রক্ষা করার জন্য সবসময়ই এই শিল্পের পাশে ছিলেন এবং থাকবেন। উদ্যোক্তাগণ একমত যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাস্তব সম্মত উপরোক্ত দাবিগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করা গেলে, তিনি অবশ্যই সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন। আর এর মাধ্যমেই এই শিল্পের অচলাবস্থা দূর হবে এবং এই শিল্পখাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রাখতে পারবে। একইসাথে করোনাকালীন সময়ে এইখাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ প্রদানের জন্য শিল্প উদ্যাক্তাগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।  

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মশিউল আজম সজল, সাবেক সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, বিটিএম’র সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন, বিকেএমইএ’র তৃতীয় সহ-সভাপতি গাওহার সিরাজ জামিল, সহ-সভাপতি (অর্থ) মোর্শেদ সারওয়ার সোহেল, সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল হক ও ফজলুল হক, সাবেক প্রথম-সহ-সভাপতি এ.এইচ আসলাম সানি ও মনসুর আহমেদ, পরিচালক আবু আহমেদ সিদ্দিক, ফজলে শামীম এহসান, মোস্তফা জামাল পাশা, আশিকুর রহমান, খন্দকার সাইফুল ইসলাম, মোস্তফা মনোয়ার ভুঁইয়া, মোঃ তারেক আফজাল, মোঃ মুজিবর রহমান, মোঃ শাহাদৎ হোসেন ভুঁইয়া (সাজনু), এম. আই. সিদ্দিক (সেলিম মাহবুব), নাসিমুল তারেক মঈন, রতন কুমার সাহা, নন্দ দুলাল সাহা, মোঃ কবির হোসেন, আহমেদ নুর ফয়সাল, ইমরান কাদের তুর্য, মোঃ আখতার হোসেন অপূর্ব এবং বিকেএমইএ, বিজিএমইএ ও বিটিএমএ’র সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিল্প উদ্যোক্তাগণ। 

আরকে//