ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বই আলোচনা

রাজনীতির উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

প্রকাশিত : ০৫:৫৭ পিএম, ৬ মার্চ ২০২১ শনিবার

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী, বর্তমানে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক। তিনি ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন এবং ছাত্রাবস্থায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহাকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের পিতা। বঙ্গবন্ধু-প্রেমী প্রফেসর মাহবুব অত্যন্ত চমৎকারভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচ্য গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। ২৫টি প্রবন্ধ এবং একটি কবিতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে সহজ-সরল ভাষায় এ গবেষণাকর্মটি পাঠকদের দরবারে লেখক অত্যন্ত সুন্দর ও বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি অযথা টিক্কা-টিপ্পনী দিয়ে পাঠকদের ভরাক্রান্ত করতে চাননি বলে ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন।

আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটি হচ্ছে: ‘রাজনৈতিক উদ্যোক্তা: বাংলার বঙ্গবন্ধু মুজিব’। উক্ত প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন যে, ‘সকল শোষণ-বঞ্চনা দূর করে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন ও সামষ্টিক অর্থনীতিকে মজবুত করাই তাঁর প্রয়াস। তাঁর এ নিখাদ প্রয়াসে কোনো ফাঁক-ফোকর ছিল না (পৃ: ১৬)।’ বস্তুত বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর ভালোবাসায় দেয়া শ্রদ্ধার্ঘ্য লেখক সুন্দরভাবে এতে পরিস্ফুট করেছেন। 

‘৭ই মার্চের ভাষণ: অর্থনৈতিক তাৎপর্য’ প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে জোর দিয়েছিলেন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির- এগুলো একে অন্যের পরিপূরক (পৃ: ১৯)।’ গবেষণামূলক এ প্রবন্ধে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অর্থনৈতিক তাৎপর্য সুন্দরভাবে পরিস্ফুট করে তুলেছেন লেখক। বেদনায় আক্রান্ত ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এদিনের স্মরণে লেখক লিখেছেন ‘শোকাবহ পঁচাত্তর: জাতিকে অমলিন করে দেয়’ শিরোনামের প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে লেখক দাবি করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িতদের তালিকা করা হোক (পৃ: ২৭)।’ ঘাপটি মারা এ সমস্ত পরোক্ষভাবে মদতদানকারী অনেকেই ছলচাতুরী করে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। 

‘বঙ্গবন্ধু ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখক বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী সম্পর্কে তার মন্তব্য বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বেশ জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতকদের কারণে নিহত হওয়ায় অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল দেশের মানুষের উন্নয়নের কর্মকাণ্ড। আজ তার মেয়ের সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে (পৃ: ৩৩)।’ অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য কন্যার মূল্যায়ন লেখক করেছেন। ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সর্বপ্রয়াস নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশকে পুনর্গঠনে বিভিন্নমুখী প্রয়াসের এবং সুশাসক ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ডের বর্ণনা করেছেন। এতে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ‘দেশ-জাতির মানস গঠনে তার সে ভূমিকা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা অব্যাহত থাকবে। জয়তু বঙ্গবন্ধু, জয় বাঙলা (পৃ: ৩৮)।’ 

বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষে... শিরোনামের প্রবন্ধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নমালা লেখক উপস্থাপন করেছিলেন। ‘তারুণ্যের শক্তি হোক দেশের অগ্রগতির পাথেয়’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ও কর্ম উন্নয়নের গতিপথকে সুসংহত করতে পারলে দেশ এগিয়ে যাওয়ার আরো অধিক সংখ্যক সৎ নির্ভীক বাঙালির সৃষ্টি হবে (পৃ: ৪৮)।’ ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ: ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি একটি বিশ্লেষণ’ শিরোনামের প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ফেরত এসে অত্যন্ত নির্ভীক চিত্তে এবং স্বপ্নের বাস্তবায়নের কারিগর হিসেবে দেশ পুনর্নির্মাণ করবেন সে ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। ‘৪৯ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ভাবনা’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন যে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সচরাচর কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অবহেলা করে চলেছে। আমাদের দেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফল বাস্তবায়ন করতে হলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যম মেয়াদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এবং উপযোগী পাঠ্যক্রম তৈরি করে সাধারণ স্বল্প শিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে যে হযবরল অবস্থায় চলছে তার থেকে মুক্তি ঘটাতে হবে। ‘নির্ভার হোক উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখক যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু যেমন সবসময় কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন এখন তার কন্যা শেখ হাসিনাও কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে চলেছেন (পৃ: ৬২)।’ অত্যন্ত বাস্তবসম্মত বক্তব্য। 

‘বাকশাল: দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রয়াস’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখক জোরালো ভাষায় উল্লেখ করেছেন যে, ‘যারা লুটেরা, তদবিরকারী, স্বজনপ্রীতি করে থাকে তারা কখনো জাতির পিতার আদর্শ ধারণ করতে পারে না। সে যুগের জন্যে বাকশাল ছিল একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ যা প্রতিটি মানুষকে সুখী করে তুলতে পারত (পৃ: ৬৮)।’ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারিগর প্রবন্ধটিও বাঙালির আত্মমর্যাদা ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয় ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যা বিধৃত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও প্রয়োজন- শিরোনামের প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু সবসময় এদেশের মানুষের জন্যে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলনের প্রয়াস করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ চেয়েছিলেন। ইউজিসি ও উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রবন্ধটিও বঙ্গবন্ধুর পরিশ্রম ও প্রয়াসকে তুলে ধরা হয়েছে। শতবর্ষে শেখ মুজিবুর রহমান অদম্য অগ্রযাত্রায় লেখক মন্তব্য করেছেন যে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। 

‘বঙ্গবন্ধু ও মানব উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি যথার্থ অর্থে মানবহিতৈষী বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে উদ্যোক্তা উন্নয়ন সহজ কথায় বর্তমান সরকারের চিন্তা-চেতনাকে পরিস্ফুট করেছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু ও পররাষ্ট্রনীতি’, ‘বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অঙ্গীকার শিরোনামের প্রবন্ধটিও অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। বঙ্গবন্ধুর রচনা ‘আমার দেখা নয়া চীন’ সম্পর্কে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা রয়েছে। বস্তুত একজন আদর্শবান শিক্ষক, গবেষক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার মুহম্মদ মাহবুব আলীর বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থটি। ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধুর ওপর আরেকটি বই রচনা করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু থেকে অবিসংবাদিত নেত্রী শেখ হাসিনা।’ আশা করব বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে তার এই গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডকে আরো পরিচিত করে তুলবে।

লেখক: শিক্ষক ও সমাজকর্মী

আরকে//